মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
"আমার চোখ ছোট বলে আমি কি চীনা হতে পারবো না?" চীনা মডেল চাই নিয়াংনিয়াং সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্টে আবেগপূর্ণ ভাষায় এরকম প্রশ্নই ছুঁড়ে দিয়েছেন তার কিছু পুরনো ছবি একেবারেই ভুল কিছু কারণে ভাইরাল হওয়ার পর।
চাই নিয়াংনিয়াং একটি চীনা খাবারের ব্র্যান্ড 'থ্রি স্কুইরেলস' এর বেশ কিছু বিজ্ঞাপনের মডেল হয়েছিলেন। একারণে কয়েকদিন ধরে তাকে অনলাইনে এই বলে আক্রমণ করা হয় যে, তিনি ইচ্ছেকৃতভাবে 'আপত্তিকর' এবং 'দেশ-বিরোধী' কাজ করেছেন। তাঁর অপরাধ? কারণ তার চোখ ছোট এবং সরু।
সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু মানুষ এই বিজ্ঞাপন নিয়ে এতটাই ক্ষোভ প্রকাশ করে যে, এই কোম্পানি বাধ্য হয় অনলাইন থেকে বিজ্ঞাপনটি সরিয়ে নিতে। তারা জনগণের কাছে এই বলে ক্ষমা চায় যে, বিজ্ঞাপনটি তাদের মধ্যে 'অস্বস্তি' তৈরি করেছিল।
তবে মিজ চাই বলছেন, তিনি আসলেই জানেন না, তার অপরাধটা কী ছিল, যার কারণে অনলাইনে এরকম আক্রমণ এবং হয়রানির শিকার হতে হলো। তিনি বলেন, তিনি তো একজন মডেল হিসেবে কেবল তার কাজটাই করছিলেন। "আমার চেহারা তো আমি পেয়েছি আমার বাবা-মা'র কাছ থেকে"- চীনা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে এক পোস্টে লিখেছেন ২৮ বছর বয়সী এই মডেল। "তাহলে কি বলতে হবে, যেদিন আমি জন্মেছিলাম, সেদিনই আমি আমার দেশকে অপমান করেছি আমার চেহারার কারণে?" 'পশ্চিমারাই এখন আর সবকিছু ঠিক করে দিতে পারে না'
এই বিজ্ঞাপনগুলোর চিত্রায়ন হয়েছিল ২০১৯ সালে। বিজ্ঞাপনে চীনাদের কীভাবে চিত্রিত করা হয়, তা নিয়ে যখন দেশটিতে মারাত্মক সংবেদনশীলতা দেখা যাচ্ছে, তখন অনলাইনে সক্রিয় জাতীয়তাবাদীরা এই বিজ্ঞাপনগুলো খুঁজে বের করে। গত নভেম্বরে চীনের একজন শীর্ষস্থানীয় নারী ফ্যাশন ফটোগ্রাফারকে তার 'অজ্ঞতার' জন্য ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। কারণ দামী ফরাসি ব্র্যান্ড 'ডিওর' এর জন্য তার তোলা একটি ছবির বিরুদ্ধে তীব্র বিতর্ক শুরু হয়েছিল। এই ছবিতে 'সরু চোখের' এক চীনা মডেলকে দেখা যাচ্ছিল।
সম্প্রতি এরকম আরও কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। মার্সিডিজ বেঞ্জ এবং গুচ্চির মডেলে এরকম 'সরু চোখের' চীনা মডেলকে দেখা গিয়েছিল, আর এর বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় তীব্র ঝাল ঝেড়েছেন কিছু মানুষ। চীনে যখন 'অনলাইন জাতীয়তাবাদ' আর পশ্চিমা-বিরোধী মনোভাব বেশ প্রবল হচ্ছে, তখন কিছু কিছু মানুষ এসব বিজ্ঞাপনকে চীনা-বিরোধী বর্ণবাদের উদাহরণ হিসেবে হাজির করছেন। সমালোচকরা বলছেন, পশ্চিমারা যেরকম গতানুগতিক ধাঁচে চীনাদের দেখাতে চায়, এসব বিজ্ঞাপনে 'সরু চোখের' চীনা মডেলদের দেখিয়ে সেই ধারণাকেই যেন আরও পোক্ত করা হচ্ছে।"আমার চোখ ছোট বলে আমি কি চীনা হতে পারবো না?"
অনেকেই প্রশ্ন তোলেন চীনা বিজ্ঞাপনে সচরাচর যে ধরণের মডেলদের দেখা যায়- যাদের ত্বকের রঙ ফর্সা এবং যাদের চোখ গোল- চীনা সংস্কৃতিতে যাদেরকে সুন্দর বলে ভাবা হয়, তাদেরকে কেন এসব বিজ্ঞাপনে দেখা যায় না। চায়না ডেইলি বলে একটি সরকারি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয়তে সম্প্রতি লেখা হয়, "অনেক দীর্ঘ সময় ধরে পশ্চিমারাই ঠিক করেছে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা, তাদের পছন্দ-অপছন্দ আর তাদের রুচিরই ছিল প্রাধান্য। বিজ্ঞাপনে এশিয়ান নারী মানেই যে সরু চোখের কেউ, সেটাও তাদেরই ঠিক করা।" "কিন্তু সবকিছু পশ্চিমারাই ঠিক করে দেবে, সেই যুগ আর নেই।"
এই সম্পাদকীয়তে আরও মন্তব্য করা হয়, "সৌন্দর্য কাকে বলে, আর কোন ধরণের নারীকে সুন্দরী বলা হবে, সেজন্য চীনাদেরকে পশ্চিমাদের মানদণ্ড অনুসরণের কোন দরকার নেই। একটা চীনা ব্র্যান্ড হিসেবে 'থ্রি স্কুইরেলসের" জানা উচিৎ ছিল চীনা ভোক্তাদের স্পর্শকাতরতার জায়গাটা কোথায়, এবং কীভাবে বিজ্ঞাপনে চীনাদের চিত্রিত করা উচিৎ।" উনিশ শতকে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে এশিয়ানদের যেভাবে 'সরু চোখের' স্টিরিও-টাইপ হিসেবে চিত্রিত করা হতো, এই বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে সেই বিষয়টি। আজকের যুগের এশিয়ানরা এই ধরণের ধারণাকে খুবই অবমাননাকর বলে গণ্য করে।
হলিউডের ছবিতে ভিলেন হিসেবে ফু মানচুর যে অপরিহার্য চরিত্র, তাকে দেখানো হয় সরু চোখের মানুষ হিসেবে। পীত বর্ণের মানুষেরা বিপদজনক, এরকম যে বর্ণবাদী ধারণা বহু বছর ধরে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে লালন করা হয়েছে, প্রচার করা হয়েছে- এই ফু মানচু চরিত্রটিতে সেই বর্ণবাদী ধারণাই ফুটিয়ে তোলা হয়। এর মোদ্দা কথা হচ্ছে, এশিয়ান সংস্কৃতি পশ্চিমা সমাজের জন্য হুমকি। তাইওয়ানের একাডেমিয়া সিনিকার ডঃ লিউ ওয়েন বিবিসিকে বলেন, "এরকম 'সরু চোখের' চিত্রায়নের মাধ্যমে এশিয়ানদের বিরুদ্ধে বর্ণবৈষম্যের ইতিহাস আসলে অনেক পুরনো।"
তবে আদর্শ চীনা সৌন্দর্য বলতে চীনের কিছু মানুষ যে ধারণাটির কথা বলছেন, সেটি আবার বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্য নিয়ে সম্প্রতি যেসব বিতর্ক চলছে, তার একদম বিপরীত। সুন্দরের সংজ্ঞায় এখন প্রাধান্য পাচ্ছে বৈচিত্র্য, এবং গণমাধ্যমে আরও বেশি করে, ব্যাপকভাবে এশিয়ান মুখ দেখানোর জন্য চাপও বাড়ছে। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, কিছু ভোক্তা যে চীনের এসব বিজ্ঞাপনকে আপত্তিকর বলে মনে করছেন, তার কারণটা বোঝা কঠিন নয়। কিন্তু এসব বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে যেরকম শোরগোল তোলা হচ্ছে, সেটিও আবার খুব মোটা-দাগের বিষয় হয়ে যাচ্ছে। কারণ একজন চীনা দেখতে আসলে বহু বিচিত্র রকমের হতে পারেন।
হংকং ব্যাপটিস্ট ইউনিভার্সিটির ডঃ রোজ লুকিউ বলেন, "সরু চোখকে প্রত্যাখ্যান করার বিষয়টি খুবই বিপদজনক। কারণ এর মাধ্যমে সৌন্দর্যের বহুমাত্রিকতা এবং বৈচিত্র্যকে প্রত্যাখ্যান করা হচ্ছে।" "একটা নির্দিষ্ট মানদণ্ডে না টিকলে এখানে সৌন্দর্যকে খারিজ করে দেয়া হচ্ছে।"
বিশেষজ্ঞরা একথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে, চীনে সৌন্দর্যের যে সনাতনী ধারণা, সেখানেও কিন্তু সরু চোখের প্রতিই পক্ষপাতিত্ব ছিল। যেমন, চীনে চিত্রকলা এবং সংস্কৃতির সোনালী যুগ বলে ধরা হয় যে সময়কালকে, ৬১৮ খ্রিস্টাব্দ হতে ৯০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ট্যাং বংশের শাসনকালেও লম্বা এবং সরু চোখের নারীদেরই চিত্রায়িত করা হয়েছে। "বিভিন্ন রাজবংশের শাসনামলে কিছু পার্থক্য থাকলেও, প্রাচীন চীনে কিন্তু সরু চোখের নারীদের প্রতিই পক্ষপাতিত্ব বেশি ছিল", বলছেন ডেলাওয়ের ইউনিভার্সিটির ভোক্তা আচরণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ডঃ জেহি জাং।
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, চীনে এখন সৌন্দর্যের জন্য বড় গোল চোখকেই যে পছন্দ করা হয়, সেটা কিন্তু পশ্চিমা প্রভাবের কারণে একটা সাম্প্রতিক প্রবণতা। কিছু বিশেষজ্ঞের ধারণা, সৌন্দর্যের ধারণায় এই পরিবর্তনের সূচনা হয় ১৯৭০ এর দশকের শেষ দিকে। চীন যখন বাকী বিশ্বের জন্য তার দরোজা খুলে দিল, তখন বিদেশি বিজ্ঞাপন আর বিনোদনের প্রভাবে এটি ঘটেছিল।
ডঃ জাং বলেন, "আজকের চীনে নারীরা কিন্তু নারীর সৌন্দর্য বলতে পশ্চিমের গণমাধ্যমে যেরকম ধ্যান-ধারণা চালু আছে, সেগুলোই অনুসরণ করে।" চীনে এখন বড় বড় গোল চোখ এত বেশি কাঙ্ক্ষিত যে, চীনের তরুণীরা মেক-আপের মাধ্যমে নিজেদেরকে সেভাবেই তুলে ধরতে চায়, অনেকে এমনকি প্লাস্টিক সার্জারি পর্যন্ত করে। তবে এই বিতর্ক যাকে ঘিরে, সেই নারী মডেল চাই নিয়াংনিয়াং আশা করেন, যারা দেখতে একটু ভিন্ন, তাদের সঙ্গে মানুষ যেন আরেকটু ভালো আচরণ করে।
চীনা সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ওয়েইবুতে তিনি বলেন, কেউ যদি তার চেহারা পছন্দ নাও করেন, সেজন্যে তাকে আক্রমণ করার কোন দরকার নেই। "আমার চোখ দেখতে এরকমই। সত্যি কথা বলতে কী, বিজ্ঞাপনে যা দেখা যাচ্ছে, বাস্তবে আমার চোখ তার চেয়ে আরও ছোট...প্রত্যেকেই তার মতো করেই আকর্ষণীয়!" সূত্র: বিবিসি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।