শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মুহম্মদ মতিউর রহমান
নজিবর রহমান যখন সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন তার পাঁচ-ছয় দশক পূর্বেই আধুনিক বাংলা সাহিত্য পূর্ণ জ্যোতি নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে। বাংলা কাব্য, উপন্যাস, নাটক, ছোটগল্প, প্রহসন, জীবনী, প্রবন্ধ ইত্যাদি সাহিত্যের সকল শাখায় প্রচুর এবং পরিণত সাহিত্যকর্ম লক্ষ করা গেছে। তবে শিক্ষা-সাহিত্য-সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিমগণ হিন্দুদের তুলনায় অনেকটা পিছিয়ে ছিলেন। প্রায় অর্ধশতাধিক পরে তাঁরা সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হন। নজিবর রহমানের পূর্ববর্তী মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন উনিশ শতকের শ্রেষ্ঠ মুসলিম গদ্য লেখক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৮-১৯১২) এবং মহাকবি মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী, কায়কোবাদ (১৮৫৮-১৯৫১) নামেই যিনি সমধিক পরিচিত। এরপর নজিবর রহমানের সমসাময়িক উল্লেখযোগ্য মুসলিম কবি-সাহিত্যিকদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য হলেন কবি মোজাম্মেল হক (১৮৬০-১৯৩৩), মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ (১৮৬১-১৯১৪), মুনশী মোহাম্মদ রেয়াজউদ্দিন আহমদ (১৮৬২-১৯৩৩), আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৬৯-১৯৫৩), মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী (১৮৭৫-১৯৫০), মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ (১৮৭৭-১৯৬৬), বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২), সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী (১৮৮০-১৯৩১), কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬), একরামউদ্দিন (১৮৮২-১৯৩৫), ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) প্রমুখ। নজিবর রহমান এঁদের সমকালে সাহিত্যচর্চায় ব্রতী হন।
উল্লেখিত মুসলিম কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের মধ্যে সকলেই স্ব-স্ব স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল। নজিবর রহমান এঁদের মধ্যে একটি বিশেষ কারণে বৈশিষ্ট্য অর্জন করেন, তা হলো গল্প-উপন্যাস রচনায় তিনি এঁদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়তার অধিকারী। নজিবর রহমানের প্রখ্যাত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস একসময় অবিভক্ত বাংলার সাহিত্যমোদীদের নিকট বিশেষত মুসলিম শিক্ষিত সমাজে সবিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটক লেখার ক্ষেত্রে হিন্দু লেখকগণ অনেক আগে থেকেই অবদান রেখে চলেছেন। তাই নজিবর রহমান যখন গল্প-উপন্যাস রচনায় প্রবৃত্ত হন, তখন তাঁর সামনে বাংলা ভাষায় উৎকৃষ্টমানের গল্প-উপন্যাস যথারীতি রচিত হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি নতুন কিছু করেছেন বলেও দাবী করা সম্ভব নয়। তবে মুসলিম লেখক হিসাবে তিনি এক্ষেত্রে প্রথম এবং অসাধারণ সাফল্য ও জনপ্রিয়তার অধিকারী। যদিও তাঁর আগে ঊনবিংশ শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি মুসলিম লেখক মীর মশাররফ হোসেন ‘রতœাবতী’ (১৮৬৯) এবং ‘বিষাদ সিন্ধু’ (মহররম পর্ব ১৮৮৫, উদ্ধার পর্ব ১৮৮৭, এজিদবধ পর্ব ১৮৯১), ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’, ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ (১৮৯১) ইত্যাদি কাহিনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছেন, তবু শিল্পবিচারে এগুলো উপন্যাসের পর্যায়ে পড়ে না। তাঁর ‘রতœাবতী’ উপকথা জাতীয় রচনা। ‘বিষাদসিন্ধু’ ঐতিহাসিক ঘটনা ও কাহিনীর ভিত্তিতে রচিত উপাখ্যান। ‘উদাসীন পথিকের মনের কথা’ উপন্যাসের ঢঙে লেখা হলেও প্রকৃতপক্ষে এটা উপন্যাস নয়, এখানে নীল অত্যাচারের অনেক কাহিনী গল্পাকারে সংযোজিত হয়েছে। ‘গাজী মিয়ার বস্তানী’ সর্বমোট ২৪ নথিতে সমাপ্ত এক বিশালকার গ্রন্থ। এটাকে উপন্যাস না বলে নকসা জাতীয় রচনা বলাই যুক্তিযুক্ত। তাই সমকালীন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নজিবর রহমানই সর্বপ্রথম মুসলিম কথাসাহিত্যিক হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর লেখা এগারটি গল্প ও উপন্যাস গ্রন্থ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
ইতঃপূর্বে নাটক-উপন্যাস-ছোটগল্প এমনকি গানের ক্ষেত্রে বাঙালি মুসলিম সমাজে নানারূপ বাধা-নিষেধ ছিল। কারণ হিন্দু লেখকগণই এগুলো রচনা করেছেন। তাদের রচনায় হিন্দুধর্ম, হিন্দু সামাজিক রীতি-নীতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, দেব-দেবীর পূজা-অর্চনা ইত্যাদি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে। উপরন্তু নর-নারীর অবাধ মেলামেশা এবং বিবাহ-বহির্ভূত প্রণয় ইত্যাদির ভিত্তিতে রচিত কাহিনী ও চরিত্রের সমাবেশ ঘটায় মুসলিম সমাজে তা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা অগ্রহণযোগ্য ছিল। সঙ্গত কারণেই কোন মুসলিম লেখক তখন নাটক-নভেল-গল্প রচনায় উৎসাহবোধ করেননি। নজিবর রহমান এক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এলেন। যেসব কারণে মুসলিম সমাজে নাটক-নভেল-গল্প লেখা এবং পড়া নিষিদ্ধ ছিল, সেসব কারণ দূর করে তিনি নতুন ধারায় গল্প-উপন্যাস লিখে সমাজের চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ পরিবর্তন করে দিলেন। মুসলিম চরিত্র, পারিবারিক-সামাজিক চিত্র এবং দাম্পত্যপ্রেম ও ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনা করায় মুসলিম লেখকগণ এক্ষেত্রে এক নতুন আলোর সন্ধান পেয়েছেন।
নজিবর রহমানের লেখার ভাব-বিষয় ইসলাম ও মুসলিম জীবন থেকে নেয়া। তাঁর উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্বকারী নারী ও পুরুষ। তিনি মুসলিম সমাজের ধর্মীয় বিধি-বিধান, আচার-আচরণ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনধারার চিত্র তুলে ধরলেন তাঁর লেখায়। ইসলামের মাহাত্ম্য বর্ণনা এবং অধঃপতিত মুসলিম সমাজের দৈন্যদশা দূর করে তাদেরকে সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসার প্রয়াসই তাঁর সাহিত্য-চর্চার মূল লক্ষ্য। শুধু তাই নয়, তিনি প্রসাদগুণসম্পন্ন অলংকারবহুল লালিত্যময় উৎকৃষ্ট সাধু বাংলা ব্যবহার করলেও মুসলিম সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দ সংযোগে তাঁর ভাষাকে সমৃদ্ধ ও ভিন্নতর রূপ দান করেন। বিশেষত বাঙালি মুসলিম সমাজে যেসব ইসলামী পরিভাষা ব্যবহৃত হয়, মুসলিম চরিত্রের বর্ণনায় তিনি সফলভাবে সেগুলো ব্যবহার করে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যদিও একশ্রেণির গোঁড়া হিন্দু তাঁর এ ভাষা-রীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন, কিন্তু উদারপন্থী কতিপয় হিন্দু প-িত ও লেখক এক্ষেত্রে তাঁকে জোরালো সমর্থন দেয়ায় তিনি উৎসাহবোধ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি এ ভাষা-রীতি যথাযথরূপে অনুসরণ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এক নতুন ধারার প্রবর্তন করেন।
এভাবে ভাব-বিষয়-শব্দসংযোজনা ও জীবন-অভিব্যক্তির ভিন্নতর উচ্চারণে নজিবর রহমান এক বিস্ময়কর অবদান রাখেন। তাঁর এ অবদানে বাঙালি মুসলিম সমাজের মন-মানসিকতা ও চিন্তাধারায় পরিবর্তন ঘটে। তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রচলিত হিন্দুয়ানি রূপের বদলে একটি সুন্দর মুসলমানি রূপ বা ঢং রয়েছে। অর্থাৎ পানিকে যে পাত্রে রাখা যায়, পানি সে পাত্রের আকারই ধারণ করে। ভাষা ও সাহিত্যও অনেকটা তাই। বাঙালি হিন্দু যখন বাংলা ভাষা সাহিত্য রচনা করেন, তখন তাতে হিন্দুর ধর্মীয় বিশ্বাস, জীবনাচার, আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার পরিচয় ফুটে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। অনুরূপভাবে এ ভাষায় যখন কোন বাঙালি মুসলিম সাহিত্য রচনা করেন, তখন সেখানে মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাস, জীবনাচার, আচার-আচরণ ও সাংস্কৃতিক জীবনধারার পরিচয় ফুটে উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। নজিবর রহমান তাঁর সাহিত্যের মাধ্যমে বাঙালি মুসলিম সমাজের চিন্তাধারাকে এভাবে সম্পূর্ণ পাল্টে দিলেন এবং বাংলা সাহিত্যের চর্চা, বিশেষত নাটক-নভেল-গল্প-গান ইত্যাদি রচনার ক্ষেত্রে এতদিন পর্যন্ত যে অলিখিত নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা রহিত হয়। এভাবে তিনি বাঙালি মুসলমানদেরকে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করেন। এজন্য পরবর্তী সকল মুসলিম কথাসাহিত্যকই তাঁর নিকট বিশেষভাবে ঋণী।
অনেকে নজিবর রহমানের বিভিন্ন গ্রন্থে অলৌকিক বিষয়ের অবতারণা করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। উপন্যাস যেহেতু বাস্তব জীবনের আলেখ্য, সেহেতু এখানে অবাস্তব-অলৌকিক বিষয়ের অবতারণা করলে উপন্যাসের শিল্পগুণ ক্ষুণœ হয়। এক্ষেত্রে সমকালীন অবস্থার কথা বিবেচনা করলে নজিবর রহমানকে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না। কারণ সমকালীন অনেক হিন্দু লেখকের রচনায় অবাস্তব-অলৌকিক বিষয়ের এন্তার ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়। বিশেষত দেব-দেবীদের মাহাত্ম্য বর্ণনায় হিন্দু লেখকগণ অনেক অবিশ্বাস্য-অলৌকিক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এখনও ভারতের বিভিন্ন সিনেমা ও টিভি নাটকগুলোতে দেব-দেবীর অলৌকিক ঘটনা ও বিষয়ের বর্ণনা পরিলক্ষিত হয়। নজিবর রহমানের সমকালে এসব বিষয়ের ব্যবহার ছিল অত্যধিক। সাধারণ পাঠক সমাজে এ ধরনের ঘটনা ও বিষয়ের বর্ণনা বিশেষ আবেদন সৃষ্টি করে থাকে। নজিবর রহমান এটা উপলব্ধি করেই তাঁর লেখায় ইসলামের মাহাত্ম্য ও পীর-আউলিয়া-দরবেশদের অলৌকিক জীবনকাহিনী বর্ণনার প্রয়াস পেয়েছেন। সাধারণ পাঠকের আগ্রহ ও বোধ-বিশ্বাসের দিকে লক্ষ্য রেখেই তিনি এটা করেছেন বলে আমার ধারণা। তবু একথা স্বীকার্য যে, হিন্দু লেখকদের পাল্লা দিতে গিয়ে হয়তো নজিবর রহমান এক্ষেত্রে অনেকটা বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন। তিনি তাঁর বিভিন্ন উপন্যাসে এ জাতীয় যেসব ঘটনা ও কাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনেক ক্ষেত্রে ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
নজিবর রহমান ছাত্রজীবন থেকে বিশেষভাবে বলতে গেলে, ঢাকায় নর্মাল পড়ার সময় থেকে সাহিত্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর রচিত গ্রন্থের তালিকা নিম্নরূপ ঃ ১. ‘সাহিত্য-প্রসঙ্গ’-এ (১৯০৪)। বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বাজেয়াপ্ত হয়। ২. ‘বিলাতী বর্জ্জন রহস্য’ (১৯০৫) স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা। এ গ্রন্থটিও প্রকাশের পর বাজেয়াপ্ত হয়। ৩. আনোয়ারা (১৯১৪), নজিবর রহমানের প্রথম ও সর্বাধিক জনপ্রিয় উপন্যাস। রচনাকাল ১৯১১-১৪ সাল, ৪. চাঁদতারা বা হাসন-গঙ্গা বাহমণি (১৯১৭), নজিবর রহমানের প্রথম ও একমাত্র ঐতিহাসিক উপন্যাস। রচনাকালের দিক দিয়ে এটি তাঁর চতুর্থ গ্রন্থ এবং দ্বিতীয় উপন্যাস, ৫. প্রেমের সমাধি, সামাজিক উপন্যাস। আনোয়ারা’র পরিশিষ্টরূপে রচিত, তবে স্বতন্ত্র উপন্যাস হিসাবে গণ্য, ৬. পরিণাম, পারিবারিক ও সামাজিক উপন্যাস, ৭. গরীবের মেয়ে, আত্মজীবনীমূলক সামাজিক উপন্যাস, ৮. মেহের-উন্নিসা, সামাজিক উপন্যাস, ৯. নামাজের ফল, সামাজিক-ধর্মীয় উপন্যাস, ১০. দুনিয়া আর চাইনা, গল্প-সংকলন, ১১. বেহেস্তের ফুল, ধর্মীয় উপন্যাস, ১২. দুনিয়া কেন চাই না, উপন্যাস ও ১৩. রমণীর বেহেস্ত, পারিবারিক উপন্যাস।
সীমাহীন অবহেলা আর উপেক্ষার মধ্যেও নজিবর রহমান এখনো অত্যুজ্জ্বল। তাঁর রচিত ‘আনোয়ারা’ উপন্যাস কালজয়ী জনপ্রিয় উপন্যাসসমূহের অন্যতম। এটি বলা যায়, ক্লাসিক মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। মৃত্যুর প্রায় শতাব্দীকাল পরেও তাঁর সাহিত্য পাঠকের হৃদয়ে মহিমময় দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল। কথাসাহিত্য রচনায় তিনি যে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন, সে ধারা অনুসরণ করে পরবর্তীতে মোহাম্মদ কোরবান আলী ‘মনোয়ারা’ (১৯২৫), আব্দুল ফাত্তাহ কোরেশী ‘সালেহা’ (১৯২৬) এবং মোজাম্মেল হক ‘জোহরা’ (১৯২৭) উপন্যাস রচনা করেন। শেখ ইদরীস আলী রচিত ‘প্রেমের পথে’ গ্রন্থটি নজিবর রহমানের ‘প্রেমের সমাধি’রই প্রতিফলন। এছাড়া ডা. লুৎফর রহমান ও কাজী ইমদাদুল হকসহ পরবর্তী অনেক মুসলিম সাহিত্যিকগণ নজিবর রহমানের উপন্যাস রচনার দ্বারা বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছেন। অবশ্য কাজী ইমদাদুল হক তাঁর উপন্যাসে মুসলিম সমাজচিত্র অঙ্কনের ক্ষেত্রে ভিন্নতর দিকনির্দেশনা রেখে গেছেন।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাঙালি মুসলিম সমাজে যে নবজাগরণের প্রেরণা সৃষ্টি হয়, তার ফলে বেশ কিছুসংখ্যক কবি-সাহিত্যিক, লেখক-সাংবাদিক সাহিত্য-সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আবির্ভূত হন। নজিবর রহমান তাঁদের অন্যতম। এ সময় সকল মুসলিম লেখকের মধ্যেই কতগুলো বিশেষ গুণ ও মূল্যবোধ পরিলক্ষিত হয়। এগুলোকে স্বদেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রেম, স্বজাতির উন্নয়ন, উন্নত মহৎ চরিত্র ও মানবিক সৎ গুণাবলী রূপে উল্লেখ করা চলে। ঐ সময়কার প্রায় সব মুসলিম কবি-সাহিত্যিক-লেখক-সাংবাদিকের মধ্যেই কমবেশি এসব গুণের সমাহার লক্ষণীয়। কারো কারো মধ্যে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা ও যুক্তিবাদিতার প্রতি প্রবল আকর্ষণ পরিলক্ষিত হয়। তবে তাঁদের অনেকেই প্রচলিত সমাজ মানসিকতার সাথে সহজে নিজেদেরকে খাপ খাওয়াতে পারেননি। ফলে অনেকে সে পথ পরিহার করেছেন অথবা সমাজের মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন। কিন্তু নজিবর রহমান মুসলিম সমাজের মূল ধারাকে, তাদের চিন্তাচেতনা, আদর্শ, জীবন-ভাবনা ও স্বপ্ন-কল্পনাকে যথাযথরূপে বাস্তবায়নের ঐকান্তিক প্রয়াস পেয়েছেন। তাই মুসলিম সমাজে তিনি অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করেন এবং শতাব্দীকাল পরেও তিনি পরম শ্রদ্ধার সাথে আজও স্মরণীয়-বরণীয় হয়ে আছেন।
চিরায়ত বাঙালি সমাজ সর্বদাই বিশেষ মূল্যবোধ ও বিশ্বাসের উপর সংস্থাপিত। সে মূল্যবোধ ও বিশ্বাস কালক্রমে পরিবর্তিত-বিবর্তিত হয়েছে কিন্তু কোন না কোন একটি বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে সর্বদা আঁকড়ে ধরেই এ সমাজ টিকে আছে ও অগ্রসর হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর নবজাগ্রত মুসলিম সমাজ তাদের নিজস্ব ধর্মীয়বোধ, বিশ্বাস, জীবনধারা ও ঐতিহ্য-সংস্কৃতির ভিত্তিতেই বিগত পরাধীন জীবনের লাঞ্ছনা-দুর্গতি মুছে ফেলে নতুন সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের আলোকোজ্জ্বল পথের সন্ধান করেছে। নজিবর রহমানও এভাবেই তাঁর সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে তাঁর ধর্মবিশ্বাস, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি ও লালিত স্বপ্নকে স্বসমাজে বিস্তৃত করে দেয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।
রেনেসাঁ বা নবজাগরণের মূল প্রেরণা হলো অতীত ঐতিহ্য ও গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। তার আলোকে বর্তমান জীবনধারাকে পাল্টে নতুন প্রতিশ্রুতিশীল জীবনের উদ্দীপনাকে ধারণ করা রেনেসাঁর প্রধান উদ্দেশ্য। সমাজ-ধর্ম-জাতি ইত্যাদি সবকিছুর ধারক-বাহক হলো মানুষ। মানুষ বা সমাজের পতন ঘটে মূল্যবোধের অভাবে। অন্যদিকে, মানুষ যখন বিশেষ কোন মূল্যবোধ ধারণ করে ও জীবন ও সমাজে তার বিকাশ ঘটাতে সক্ষম হয়, তখন মানুষ বা সমাজের উন্নতি অনিবার্য হয়ে ওঠে। নজিবর রহমানের জন্ম ও তাঁর সাহিত্যচর্চা ঘটেছে বাঙালির এ নবজাগরণের মাহেন্দ্রক্ষণে। তাই নবজাগরণের মূল ভাব ও প্রেরণা তাঁর মধ্যে কাজ করেছে, তাঁর সাহিত্যে এর সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটেছে।
নজিবর রহমান চিরায়ত ইসলাম ধর্মীয় বোধ-বিশ্বাস ও জীবনধারাকে অবলম্বন করে এবং ইসলামের গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য-সংস্কৃতির আলোকে বর্তমান বাঙালি মুসলিম সমাজকে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই তাঁর লেখনী পরিচালনা করেন। এদিক থেকে তাঁকে অনেকে হয়তো পুরাতনপন্থী বা অতীতমুখী মনে করতে পারেন। কিন্তু তাঁর লেখা পাঠ করলে এবং তাঁর নির্মিত বিভিন্ন চরিত্র সম্পর্কে আলোচনা করলে এটা সুস্পষ্টভাবে উপলদ্ধি করা যায় যে, তিনি কোন অবস্থায়ই পুরাতনপন্থী বা অতীতমুখী ছিলেন না। তিনি ইসলামী জ্ঞান ও জীবনাচারের সাথে আধুনিক প্রগতিশীল বৈজ্ঞানিক সভ্যতার সমন্বয় ঘটিয়েছেন। সমাজের অশিক্ষা-কুশিক্ষা ও বিভিন্ন ধরনের পশ্চাদমুখী প্রথা-প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে তিনি শিক্ষার আলোকে, বিষেশত নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রচলন করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ-মানসিকতার পরিবর্তন সাধনে সচেষ্ট হন। তাঁর লেখায় এটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, শিক্ষালাভের মূল লক্ষ্য চাকরি করা নয়, শিক্ষার দ্বারা মানুষ তার নিজেকে জানতে পারে, তারমধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ ও সাবলম্বিতার সৃষ্টি হয়, সে প্রকৃত মনুষ্যত্ব অর্জন করে। সেজন্য দেখা যায়, তাঁর উপন্যাসের অনেক চরিত্র শুধু চাকরি করাকেই জীবনের মূল উদ্দেশ্যরূপে গণ্য করেনি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষিকাজ ইত্যাদি নানা ধরনের অপ্রচলিত অর্থনৈতিক কায়কারবারের মাধ্যমে আর্থিক উন্নতি ও সমাজ উন্নয়নের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এরদ্বারা নজিবর রহমানের প্রগতিশীল উন্নয়নমুখী প্রাগ্রসর চিন্তাচেতনার পরিচয় সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
উপরোক্ত আলোচনায় মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরতœ-এর জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে যথাসম্ভব আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। নিজের সংগৃহীত তথ্য ও বিভিন্ন গবেষকদের তথ্যের উপর ভিত্তি করে বিশেষত তাঁর জীবনীকার খন্দকার মোহাম্মদ বশিরউদ্দিন রচিত- ‘মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরতœ’ গ্রন্থের আলোকে বাংলা সাহিত্যের অমর কথাশিল্পী মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরতেœর জীবন ও সাহিত্য সম্পর্কে তত্ত্ব-তথ্যনির্ভর আলোচনার প্রয়াস পেয়েছি। তাঁর জীবন ও সাহিত্য সাধনা সম্পর্কে এখানে যতটুকু আলোচনা হয়েছে, তা থেকে আশা করি বাংলা সাহিত্যে তাঁর মূল্যবান ও কালজয়ী অবদান সম্পর্কে সকলে যথাযথ ধারণা লাভে সক্ষম হবেন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।