Inqilab Logo

মঙ্গলবার ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ২০ কার্তিক ১৪৩১, ০২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বজনের খোঁজে সুগন্ধা নদীর তীরে ভিড়

ঝালকাঠিতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ড বরগুনায় ৩০ জনকে গণকবরে দাফন : ঝালকাঠি সদর থানায় অপমৃত্যুর মামলা

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ২৬ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪২ হয়েছে। গতকালও নিখোঁজদের স্বজনরা দিনভর সুগন্ধা নদীতে তাদের স্বজনদের খুঁজে ফিরছিলেন। যদি কোথাও স্বজনের লাশ ভেসে ওঠে সেই আশায় অনেকেই ট্রলার নিয়ে খুঁজতে বের হয়েছেন। তবে এ ঘটনায় এখনো কতজন নিখোঁজ রয়েছেন তার সঠিক হিসাব এখনও কেউ দিতে পারছেন না। নিহতদের মধ্যে ৩০ জনের জানাযা শেষে বরগুনা সদর উপজেলার পোটখালী গ্রামের সরকারি গণকবরে দাফন করা হয়। এসময় নিহতদের স্বজনদের আহাজারিতে চারপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। এদিকে অগ্নিকান্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় ঝালকাঠি সদর থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে মামলাটি করেন ৭নং পোনাবালিয়া ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন। গতকাল শনিবার সকালে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বি্ডিব্লিউটিএ গঠিত তদন্ত দল।

বরিশাল ব্যুরো জানায়, অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকান্ডের পরে প্রথমে আগুনে পোড়া রোগীদের ঝালকাঠি জেলা সদর হাসপাতালে নেয়া হলেও তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার মত সক্ষমতা ছিলো না। ফলে সব আগুনে পোড়া রোগীই বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু হাসপাতালটির জরুরি বিভাগে একের পর এক রোগী আসতে শুরু করায় চরম বিপাকে পড়েন সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক। হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ১০ জন চিকিৎসকের স্থলে আছেন মাত্র ৩ জন। ফলে ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি হয় সেখানেও। পরে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে এসব আগুনে পোড়া রোগীদের হাসপাতালটির ৪ম তলায় চক্ষু বিভাগের একটি ইউনিটে রাখা হয়।

কিন্তু রোগী ভর্তি করা হলেও চিকিৎসক না থাকায় গত শুক্রবার দিনভরই এসব রোগীদের তেমন কোন চিকিৎসা দেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি এ হাসপাতালে আগুনে পোড়া একজনের মৃত্যুও হয়েছে শুক্রবারই। এছাড়া শুক্রবার দুপুরে আরো ৩ জনকে ঢাকায় পাঠানোর পরে রাতে গুরুতর আরো দু’জনকে র‌্যাবের হেলিকপ্টারে বিশেষ ব্যবস্থায় শেখ হাসিনা বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। তবে ঢাকা থেকে ৭ জন চিকিৎসক এসে গতকাল শনিবার সকাল থেকে আগুনে পোড়া গুরুতর অসুস্থ এসব রোগীদের চিকিৎসা শুরু করেছেন।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, আগত চিকিৎসকরা বরিশালে পৌঁছেই চিকিৎসা সেবায় যোগ দিয়েছেন। ওষুধসহ সব ধরনের চিকিৎসা সামগ্রী হাসপাতালে মজুত রয়েছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চেষ্টা করছি সম্ভব সব ধরনের চিকিৎসা সেবা দিতে। তবে বেশ কিছু রোগীর অবস্থা গুরুতর ও সঙ্কটাপন্ন বলেও জানান তিনি। এদিকে বিআইডব্লিউটিএ’র অতিরিক্ত পরিচালক (বন্দর) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গতকাল শনিবারই দুর্ঘটনাকবলিত নৌযানটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে সব কিছু খতিয়ে দেখেছেন। ইতোমধ্যে তারা নৌযানটির বেশ কয়েকজন যাত্রীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। তদন্ত টিম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যাত্রীদেরও বক্তব্য গ্রহণ করবেন বলে জানা গেছে।

বরগুনায় ৩০ জনকে গণকবরে দাফন : বরগুনা জেলা সংবাদদাতা জানান, নিহতদের মধ্যে ৩৬ জনের লাশ বরগুনায় পাঠানো হয়েছে। তবে শনাক্ত না হওয়ায় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা এখনই সম্ভব হচ্ছে না। এ ঘটনায় গতকাল শনিবার বরগুনার সার্কিট হাউজের ঈদগাঁ মাঠে ৩০ জনের জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। জানাজার নামাজে উপস্থিত ছিলেন হাজার হাজার মানুষ। এসময় উপস্থিত ছিলেন- বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির, পৌর মেয়র কামরুল আহসান মহারাজসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। জানাজা শেষে লাশগুলো সদর উপজেলার পোটখালী গ্রামের সরকারি গণকবরে দাফন করা হয়। এর আগে গত শুক্রবার রাত সোয়া এগারোটার দিকে ঝালকাঠি পৌরসভার লাশবাহী ট্রাকে করে ৩৬টি লাশ বরগুনায় নিয়ে আসা হয়। এসময় স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বরগুনা সদর হাসপাতাল প্রাঙ্গন। স্কাউটসের স্বেচ্ছাসেবকরা গাড়ি থেকে লাশগুলো নামিয়ে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখেন।

ঝালকাঠি জেলা সংবাদদাতা জানান, নদীতে লাফিয়ে এখনো নিখোঁজ রয়েছেন অনেকেই। তাদের সন্ধানে সুগন্ধার তীরে অপেক্ষায় আছেন স্বজনরা। কেউ আবার ট্রলার নিয়ে নদীর বিভিন্ন প্রান্তে খুঁজে বেড়াচ্ছেন প্রিয়জনকে। কারো হাতে নিখোঁজদের ছবি। তা নিয়ে নদী তীরের বাসিন্দাদের দেখাচ্ছেন আর বিলাপ করছেন। কেউ আবার নদী তীরের মিনিপার্ক, ডিসিপার্ক, লঞ্চঘাট এবং ঘটনাস্থল দিয়াকুল এলাকায় ঘুরছেন। অন্তত নিখোঁজ স্বজনদের মৃতদেহ যেন বাড়ি নিয়ে যেতে পারেন, সেই অপেক্ষায় আছেন স্বজনরা। এদিকে সকাল ৮টা থেকে ঝালকাঠি ও বরিশালের ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল লঞ্চঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেন। নদীতে লাফিয়ে নিখোঁজদের উদ্ধারে ডুবুরি দল সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করবেন জানিয়েছেন ঝালকাঠি ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক মো. কামাল উদ্দিন ভ‚ঁইয়া। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব তোফায়েল হাসানের নেতৃত্বে ৭ সদস্যের তদন্ত দল সকাল সাড়ে ১০টায় ঝালকাঠির লঞ্চঘাট এলাকায় এসে আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটি পরিদর্শন করেন। লঞ্চের ইঞ্জিন রুমসহ বিভিন্ন কক্ষে ঢুকে তদন্ত করছেন তারা। তাদের সঙ্গে ছিলেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী মো. শাজাহান খান।

বামনা (বরগুনা) উপজেলা সংবাদদাতা জানান, অভিযান-১০ লঞ্চে বামনা উপজেলার প্রায় অর্ধশতাধিক যাত্রী ছিলো। তাদের মধ্যে ১ জন নিহত হয়। ১ জন নিখোঁজ রয়েছেন এবং ৪১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। উপজেলার লক্ষীপুরা গ্রামের নিহত স্বপ্নীল হাওলাদারের বাবা সঞ্জীব হাওলাদার জানান, আমি আমার স্ত্রী লক্ষীরানী শিশু পুত্র প্রত্যয় ও নিহত স্বপ্নীল ঢাকা থেকে লঞ্চের দ্বিতীয় তলার ফ্লোরের যাত্রী ছিলাম। অগ্নিকান্ডের কিছুক্ষণ আগে স্বপ্নীল বাথরুমে যায়। এর মধ্যে আগুন লঞ্চে ছড়িয়ে পড়লে আমি শিশু পুত্র ও স্ত্রীকে নিয়ে নদীতে ঝাপ দিয়ে স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় কিনারায় উঠি। পরে স্বপ্নীলকে অনেক খোঁজাখুঁজি শুক্রবার সন্ধ্যায় ভাসমান অবস্থায় ওর পোড়া লাশ পাই। এদিকে গোলাঘাটা গ্রামের হামিদ কারজারীর এখনও কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।

আগুনের উৎপত্তিস্থল স্পষ্ট দেখেছেন বামনা উপজেলার ব্যবসায়ী গোবিন্দ সাহা। তিনি তখন লঞ্চটির নিচ তলায় সামনের দিকে শুয়ে ছিলেন। হঠাৎ তিনি ইঞ্জিন রুমে আগুন দেখতে পান। তিনি তাৎক্ষণিক দৌড়ে ৩ তলায় সুকানির কাছে গিয়ে লঞ্চে আগুনের বিষয়টি বলেন। তিনি তাকে লঞ্চটি তীরে ঘাট দিতে অনুরোধ করেন। পরে তিনি আবার নিচে চলে আসেন। এমন সময় লঞ্চটির প্রায় অর্ধেকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে।

লঞ্চে আগুনের ঘটনায় মামলা : লঞ্চে অগ্নিকান্ড ও প্রাণহানির ঘটনায় ঝালকাঠি সদর থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। গত শুক্রবার রাতে মামলাটি করেন ৭নং পোনাবালিয়া ইউনিয়নের গ্রামপুলিশ সদস্য জাহাঙ্গীর হোসেন। বিষয়টি জানিয়েছেন ঝালকাঠি সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, গ্রামপুলিশ জাহাঙ্গীর হোসেন বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলাটি দায়ের করেন। এছাড়া এই ঘটনায় উচ্চ পর্যায়ের কয়েকটি তদন্ত টিম কাজ করছে। তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

পৃথক ৩ তদন্ত কমিটি গঠন : ঝালকাঠিতে লঞ্চে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তদন্তে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) ও স্থানীয় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক ৩টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) মৃত ব্যক্তিদের পরিবার প্রতি দেড় লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে।

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব তোফায়েল আহমেদকে আহ্বায়ক করে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ কমিটিকে আগামী তিন কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া বিআইডব্লিউটিএ’র বন্দর ও পরিবহন বিভাগের অতিরিক্ত পরিচালক সাইফুল ইসলামকে প্রধান করে ছয় সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।

অপরদিকে ঝালকাঠি জেলা প্রশাসক (ডিসি) জোহর আলী জানান, তাদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আলমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

কফিনে ছবি দেখে মায়ের লাশ শনাক্ত : কফিনে লাগানো মায়ের ছবি দেখে লাশ শনাক্ত করেন মেয়ে ফাতেমা। মৃত মনোয়ারা চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা গ্রামের বাসিন্দা। বরগুনায় তিনি তার মেয়ে ফাতেমার শ্বশুরবাড়ি বরগুনার ঢলুয়ায় বেড়াতে আসছিলেন। এসময় মনোয়ারার সঙ্গে তার স্বামী বেলাল হোসেন ও মেয়ে আমেনা ছিলেন। তারা এখন বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

মনোয়ারার মেয়ে ফাতেমা বলেন, মা অনেক দিন ধরেই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কাজের চাপে সুযোগ হচ্ছিল না। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে চাঁদপুর থেকে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে উঠেন। পরে লঞ্চে আগুন লাগলে বাবা ও বোন লাফিয়ে নদীতে নামলেও মা বের হতে পারেননি। মায়ের অনেক শখ ছিল আমার শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে আসবে। ভাগ্য কী নির্মম, মা এসেছেন ঠিকই তবে লাশ হয়ে।

নিখোঁজদের সন্ধানে সুগন্ধায় ৩৬ পরিবার : এখনো যাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি তেমন ৩৬টি পরিবার ট্রলার নিয়ে লাশের সন্ধানে বেরিয়েছেন। গতকাল শনিবার সকাল ৮টার দিকে ঝালকাঠি মিনিপার্ক থেকে তারা সুগন্ধা নদীতে লাশের সন্ধানে যান বলে জানিয়েছেন বরগুনা সদর উপজেলার পরীরখাল এলাকার বাসিন্দা এমএ জলিল। তিনি বলেন, গতকাল সারাদিন আমরা ঝালকাঠিতে এসে নদী আর লঞ্চে পোড়াদের মধ্যে আমার স্বজনদের খুঁজেছি। কিন্তু পাইনি। এখন ট্রলার নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছি। যদি কোথাও লাশ ভেসে ওঠে সেই আশায়। গতকাল নদীতে কোস্টগার্ডকে টহল দিতে দেখেছি। আজ সকাল থেকে আর দেখছি না।

আরেক স্বজনহারা আব্দুস ছত্তার বলেন, স্বজন গেছে, তাদের লাশের ব্যবস্থা তো করতে হবে। রাতে ৩৫-৩৬টি পরিবার ঝালকাঠি টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে ছিলাম। সেখানে স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা খাবার আর কম্বল দিয়েছে। কিন্তু ভাই, আমার স্বজন তো পাইনি। এখন আমরা সবাই নদীতে নেমেছি সন্ধানে। সারাদিন খোঁজ চালানো হবে বলে জানান তিনি। মোতালেব হোসেন বলেন, আমার ভাই, ভাবি, ভাইপো পুড়ে মারা গেছে, নাকি পানিতে ডুবে মারা গেছে জানি না। অন্তত লাশটা নিতে চাই বাড়িতে। এজন্য যত দিন লাগে এই নদীর পাড়ে অপেক্ষা করব।

মেয়ের বিয়ে দিতে এসে নিখোঁজ মা-বাবা-ভাই : গতকাল শনিবার ছিল বড় মেয়ে হাফসার বিয়ের দিন। বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে আগেভাগেই ঢাকা থেকে স্ত্রী পাখি বেগম ও আড়াই বছরের ছোট ছেলে নাসরুল্লাহকে নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন আব্দুল হাকিম। তার বাড়ি বরগুনা সদর ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডে। কিন্তু হাফসার বিয়ে আর হলো না। তার আগেই অভিযান-১০ ট্র্যাজেডিতে বাবা-মা-ছোট ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে বিয়ের আনন্দের বদলে কান্নার রোল পড়েছে। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় ঝালকাঠি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে জানা গেল হাফসার বিয়ে ভেঙে যাওয়ার করুণ গল্প। খবর শুনে হাফসার দাদি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। আর তার বাবা-মা ও ছোট ভাইয়ের লাশ খুঁজতে এসেছেন নানি ফরিদা বেগম, চাচা আব্দুল মোতালেব শরীফ ও চাচাত চাচা ছত্তার শরীফ।

কিছুক্ষণ পর পর কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন ফরিদা বেগম। বলছিলেন, শনিবার নাতনির বিয়ার দিন তারিখ ধার্য্য ছিল। তাতো হইলো না। এহন মাইয়া-জামাই আর ছোট নাতির লাশটা পাই কি না জানি না। তিনি বলেন, বেন বেলা থেইকা আইয়্যা বইয়্যা রইছি, কিন্তু কিছুই পাইলাম না। জানি না কি নিয়া ফিরমু। লাশগুলা পাইলেও অন্তত মনডারে বুঝাইতে পারমু। ফরিদা বেগম বলেন, আমার আর কিছু লাগবে না। মাইয়া-জামাই আর নাতির কবরটা দেওয়ার ব্যবস্থা একটু করে দেন।

ছোট নুসরাত চেয়েছিল দাদাবাড়ির হাঁসপিঠা খেতে : বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানী ঢাকায় থাকত ৯ বছরের নুসরাত জাহান। শীতে দাদাবাড়িতে হাঁস-রুটি-পিঠা খাওয়ার আবদার করেছিল বেশ কদিন ধরে। আসবে আসবে বলেও আসা হচ্ছিল না। তবে সুযোগ হওয়ায় আগেই বাড়ি চলে আসেন একটি বেসরকারি কোম্পানির গাড়িচালক ইসমাইল। গত বৃহস্পতিবার মেয়ে নুসরাতকে নিয়ে অভিযান-১০ লঞ্চে উঠেন স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা। তবে অভিযান-১০ ট্র্যাজেডির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৯ বছরের নুসরাতের ইচ্ছা। সেই সঙ্গে নুসরাত ও তার মা দগ্ধ হয়ে ছাই হয়ে গেছে কি না তার নিয়ে সংশয়ে পরিবার।

নিখোঁজ নুসরাতের চাচা জলিল বলেন, বরগুনার পরীরখাল এলাকায় বাড়ি আমাদের। আমরা নুসরাত আর ভাবি (রাজিয়া সুলতানা) আসবে বলে অপেক্ষায় ছিলাম। তারা বৃহস্পতিবার যখন লঞ্চে উঠেন তখনো মোবাইলে জানায়, নুসরাত বাড়ি আসতেছে বেড়াতে। কিন্তু ওরা আর ফেরেনি। এখন কোথায় আছে জানি না। পানিতে ডুবে গেছে, নাকি আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে তাও জানি না।

বাবার কোল থেকে হারিয়ে যাওয়া তাবাসসুমকে পাওয়া গেলো কফিনে : বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার হাফেজ তুহিন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকা থেকে অভিযান-১০ লঞ্চে ফিরছিলেন গ্রামে। লঞ্চে যখন আগুন লাগে তখন প্রাণ বাঁচাতে আড়াই বছরের সন্তান তাবাসসুমকে নিয়ে স্ত্রীর হাত ধরে ঝাঁপ দেন নদীতে। কিন্তু তীরে এসে দেখেন শিশু তাবাসসুম আর কোলে নেই। কখন যে হাত ফসকে নদীতে নিরুদ্দেশ হয়েছে সেটা টের পাননি বাবা তুহিন। তুহিন বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কালমেঘা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সন্তানের খোঁজে কখনো হাসপাতালে কখনো নদীতীরে ছুটে বেড়ান তুহিন। স্ত্রী অসুস্থ। কথা বলার শক্তি নেই তার।

গত শুক্রবার সকাল থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত শিশু তাবাসসুমকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে বরগুনা সদর হাসপাতাল মর্গে এসে তাবাসসুমের খোঁজ নেন তার স্বজনরা। সেখানে এসে জানতে পারেন শনাক্ত না হওয়া লাশগুলো বরগুনার সার্কিট হাউজ মাঠে জানাজা দিয়ে সদরের পোটকাখালীতে দাফনের জন্য নেওয়া হয়েছে। সেখানে গিয়ে স্বজনরা কফিন থেকে শনাক্ত করে শিশু তাবাসসুমের লাশ। এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা।

মামার হাতে যমজ ভাগনির লাশ : লঞ্চে অগ্নিকান্ডে নিহত সামিয়া (৪) ও লামিয়া (৪) নামে আরও দুই শিশুর লাশ শনাক্ত করে নিয়ে গেছেন স্বজনরা। গতকাল শনিবার সকালে নিহতদের মামার কাছে এই দুই যমজ শিশুর লাশ হস্তান্তর করা হয়। নিহত সামিয়া ও লামিয়া বরগুনার তালতলী উপজেলার আগাপাড়া গ্রামের রফিক হোসেনের মেয়ে। তারা মায়ের সঙ্গে দাদাবাড়িতে বেড়াতে আসছিলো।

নিহতদের স্বজনরা জানায়, মা শিমু আক্তার ও নানি দুলু বেগমের সঙ্গে বৃহস্পতিবার দাদাবাড়ি বেড়াতে আসছিল সামিয়া ও লামিয়া। বাবা অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় তার আসা হয়নি। গুরুতর দগ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় সামিয়া এবং লামিয়া। তাদের নানি দুলু বেগম গুরুতর আহত হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এ ঘটনায় নিহত শিশুদের মা শিমু আক্তার এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন। তাদের বাবা রফিক স্ত্রীকে খুঁজতে বরিশালে আছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অভিযান-১০


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ