পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
মাঝ নদীতে যাত্রীবাহী লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে এ ধরনের হৃদয়বিদারক ঘটনা এই প্রথম। গতকাল দিনভরই দেশবাসী উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা নিয়ে নজর রাখছিলেন এ বিভৎস্য ঘটনার দিকে। ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চে আগুন লেগে শতাধিক যাত্রী দগ্ধ হয়। এ ঘটনায় এখনো নিখোঁজ রয়েছেন বহু যাত্রী। এর মধ্যে ৪১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী। এদের মধ্যে চারজন শিশু রয়েছে। লঞ্চটি ঢাকা থেকে বরগুনা যাওয়ার পথে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীর দপদপিয়া এলাকায় আসলে গত বৃহস্পতিবার রাত ৩টার দিকে ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুন লাগে। যাত্রীদের অভিযোগ, শুক্র ও শনিবার দু’দিন সরকারি বন্ধ থাকায় ধারণক্ষমতার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী ছিল লঞ্চে। অগ্নিকাণ্ড থেকে জীবিত ফেরা অনেক যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, আগুন লাগার পরও প্রায় ১ ঘন্টা চলছিল লঞ্চটি।
ঢাকা থেকে আট শতাধিক যাত্রী নিয়ে বরগুনা যাচ্ছিল এমভি অভিযান নামে যাত্রীবাহী লঞ্চটি। রাতে ইঞ্জিন কক্ষ থেকে আগুন লাগে। এসময় কেবিনের যাত্রীরা ঘুমিয়ে ছিলেন। লঞ্চটি সদর উপজেলার দিয়াকুল এলাকায় গিয়ে নদীর তীরে নোঙর করে। খবর পেয়ে ঝালকাঠির ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দুই ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে শতাধিক যাত্রী দগ্ধ হয়। এখন পর্যন্ত ৩৮ জনের লাশ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা। দগ্ধ যাত্রীদের উদ্ধার করে ঝালকাঠি সদর হাসপাতাল ও বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনাস্থলে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তারা উপস্থিত হয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করছেন। নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে ধারণা করছেন উদ্ধার কাজে নিয়োজিতরা।
লঞ্চের যাত্রী সাদিকুর রহমান মৃধা জানান, তিনি ঢাকা থেকে বরগুনা ফিরছিলেন। ঝালকাঠি লঞ্চ টার্মিনালের ঠিক আগে গাবখান সেতুর কিছু আগে লঞ্চের পাক ঘর থেকে আগুন লেগে যায়। এরপর সেই আগুন পর্যায়ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে পুরো লঞ্চে। রাত তিনটা থেকে আগুন জ্বলতে থাকে। যাত্রীরা অনেকেই নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাঁতরে তীরে উঠতে পেরেছেন। অনেকে হয়তো পারেননি। সাদিকুর রহমান মৃধা নামের এই যাত্রী বলেন, লঞ্চে শিশু, বুড়ো, নারীসহ কমপক্ষে আট শতাধিক যাত্রী ছিল।
ইতালিফেরত এই যাত্রী বলেন, পোড়া গন্ধ পেয়ে আমি ভিআইপি কেবিন থেকে বেড়িয়ে এসে দেখি লঞ্চে আগুন লেগেছে। তখন আমার স্ত্রী, শ্যালক নিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডায় নদী সাঁতরে তীরে উঠেছি। লঞ্চ ভাসতে ভাসতে কোথাও গিয়ে থেমেছে। তবে এটুকু বলছি, লঞ্চের কোনো অংশ পোড়ার বাকি নেই।
লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি ছিল, চলছিল বেপরোয়া গতিতে : ঢাকার সদরঘাট থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় এমভি অভিযান-১০ যখন বরগুনার উদ্দেশে যাত্রা করে, তখন থেকেই এর গতি ছিল বেপরোয়া। ইঞ্জিনে ত্রুটি থাকায় চারজন টেকনিশিয়ান ত্রুটি মেরামতে কাজ করছিলেন। এ জন্য পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিন চালিয়ে ট্রায়াল দেওয়া হচ্ছিল। আর এতেই মূলত ইঞ্জিনের অতিরিক্ত তাপে আগুন ধরে যায়। আগুন লেগে যাওয়ার পর নেভানোর কোনো চেষ্টা না করে লঞ্চটির শ্রমিক-কর্মচারী ও মালিক লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন। লঞ্চের বেঁচে ফেরা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য মিলেছে।
বরগুনার ব্যবসায়ী মো. সগির হোসেন হাওলাদার অভিযান-১০ নামে ওই লঞ্চের তিনতলার কেবিনের যাত্রী ছিলেন। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। লঞ্চটি অর্ধেকের বেশি পুড়ে যাওয়ার পর প্রচণ্ড উত্তাপ আর ধোঁয়ায় দম আটকে যাওয়ায় ঘুম ভেঙে যায় তার। এরপর বাইরে নেমে দেখেন, চারদিকে আগুন। তিনি লঞ্চের পাশের ত্রিপলের রশি বেয়ে দ্রুত দোতলায় নামেন। সেখানে অনেক নারী, শিশুকে অজ্ঞান ও দগ্ধ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন। একটি ফ্যামিলি কেবিনে দুই শিশু ও এক নারীর দগ্ধ নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন। সগির হোসেন কী করবেন, ভেবে দিশেহারা। তিনি নদীতে ঝাঁপ দেন। পরে স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করেন।
সগির হোসেন বলেন, লঞ্চটি ঢাকার ঘাট ছাড়ার পর তিনি ইঞ্জিনকক্ষের কাছে গিয়েছিলেন। তখন ইঞ্জিনের বেপরোয়া গতি তুলতে চারজন টেকনিশিয়ানকে দেখতে পান। এ সময় তিনি তার মুঠোফোনে ইঞ্জিনের ছবিও তোলেন।
কয়েকজন যাত্রী বলেন, লঞ্চটির ইঞ্জিনের ত্রুটি থাকায় চারজন ইঞ্জিন মেরামতকারী টেকনিশিয়ান লঞ্চটির ইঞ্জিনকক্ষে ছিলেন। তারাই মূলত পুরো গতিতে লঞ্চটি চালাচ্ছিলেন। ইঞ্জিনে গ্যাস হওয়ায় বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ইঞ্জিন প্রচণ্ড গরম হচ্ছিল। ইঞ্জিনের ত্রুটি খুঁজে পেতে পুরো গতিতে দুটি ইঞ্জিনই চালাচ্ছিলেন তারা। বেপরোয়া গতির কারণে লঞ্চটি কাঁপছিল। সগির হোসেন বলেন, লঞ্চটিতে অগ্নিনির্বাপকের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। আর আগুন লাগার পরপরই মালিক ও স্টাফরা যাত্রীদের রেখে লঞ্চ থেকে সটকে পড়েন।
প্রত্যক্ষদর্শী বরগুনার আরেক যাত্রী জাহিদুল ইসলাম বলেন, রাত পৌনে একটায় বরিশাল নৌবন্দর ত্যাগ করার পর লঞ্চটির পুরো ডেক উত্তপ্ত হয়ে যায়। শীত থাকায় চারপাশ ত্রিপল দিয়ে আটকানো ছিল। রাত আড়াইটার দিকে লঞ্চটি ঝালকাঠি স্টেশন থেকে দেউরী এলাকায় আসতেই আগুন লাগে। কিছু দূরে এলে ইঞ্জিনকক্ষে আগুন ধরে যায়। এরপর আগুন পুরো লঞ্চের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। লঞ্চের ২০ ব্যারেল ডিজেল, নিচতলায় দুটি মোটরসাইকেল এবং রান্নার জন্য রাখা কয়েকটি গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়। একই সঙ্গে ভিআইপি কেবিনের এসির কম্প্রেসারগুলোও একে একে বিস্ফোরিত হয়।
যাত্রীদের অভিযোগ, লঞ্চটির ইঞ্জিনে ত্রুটি মেরামত করতে লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের ছাড়া ইঞ্জিনের ট্রায়াল দিতে পারত। কিন্তু যাত্রী নিয়ে এই ট্রায়াল দেওয়ার কারণেই এতগুলো মানুষের প্রাণহানি ও দগ্ধ হলো। এর দায় কে নেবে, প্রশ্ন করেন তারা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের বরিশাল বিভাগীয় উপপরিচালক মো. কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ‘আমরা রাত সাড়ে তিনটার দিকে লঞ্চে গিয়ে আগুন নেভাই। এ সময় কর্তৃপক্ষের কাউকেই পাইনি। পরে স্পিডবোট দিয়ে খোঁজাখুঁজিও করি। লঞ্চের কেবিনে কেবিনে লাশ পড়ে ছিল। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে, ইঞ্জিনরুমে আগুন ধরে গিয়েছিল। লঞ্চে আমরা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কিছুই পাইনি।’
ধারণক্ষমতার ‘তিনগুণ’ যাত্রী ছিল : আগুনে পুড়ে যাওয়া লঞ্চটিতে ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি যাত্রী ছিল বলে জানিয়েছেন বেঁচে যাওয়া যাত্রীরা। তবে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) এক কর্মকর্তার ভাষ্য, ঘাট ছাড়ার সময় লঞ্চটিতে যাত্রী ছিল মাত্র ৩১০ জন, যা ধারণ ক্ষমতার চেয়ে কম।
বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর যুগ্ম পরিচালক এস এম আজগর আলী জানান, এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে যাত্রী ধারণক্ষমতা ৩৫০ জন। ঘাট ছাড়ার সময় নৌযানে ছিলেন মাত্র ৩১০ জন যাত্রী। তবে যাত্রী মো. সোহান বলেন, ‘লঞ্চটিতে ৯০০ থেকে ১ হাজার যাত্রী ছিল।’
আগুন লাগার পরও এক ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে লঞ্চটি : লঞ্চে আগুনের সূত্রপাত হওয়ার পরও এক ঘণ্টা ধরে সেটি চলতে থাকে। মাঝে দুটি স্টপেজ থাকলেও লঞ্চটি থামানো হয়নি। গতকাল শুক্রবার বিকেলে এ কথা জানান নৌপুলিশের বরিশাল জোনের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. সৈয়দ মাহবুবুর রহমান।
নৌপুলিশের কর্মকর্তা সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, অগ্নিদগ্ধ লঞ্চটির হাসপাতালে আহত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইঞ্জিন রুম থেকেই আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ইঞ্জিন রুমের অপারেটর ইঞ্জিন রুমে ছিলেন না অথবা আগুন লাগার পরে তিনি পালিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, গত রাত প্রায় সাড়ে ৩টার দিকে লঞ্চটি যখন নলছিটি ক্রস করে তখন এর ইঞ্জিনে আগুন লাগে। কিন্তু লঞ্চটি নলছিটিতে স্টপেজ দেয়নি, এমনকি ঝালকাঠিতেও স্টপেজ দেয়নি।
আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে ঝালকাঠি মিনি পার্ক : লাশ শনাক্তের জন্য রাখা হয় ঝালকাঠি মিনি পার্কে। লাশ শনাক্তে সেখানে স্বজনরা ভিড় করেন। স্বজনদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। গতকাল শুক্রবার সকাল থেকেই লাশ উদ্ধারের পর ঝালকাঠি মিনি পার্কে এনে রাখা হয় বলে জানান বরিশাল নৌ ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি লিডার হুমায়ুন কবির।
সুগন্ধা নদীতে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার শুরু থেকেই ফায়ার সার্ভিস, কোস্টগার্ড, পুলিশ ও রেড ক্রিসেন্টের উদ্ধারকারী দল কাজ শুরু করে। তারা লাশ উদ্ধার করে ঝালকাঠি সিটি পার্কে নিয়ে আসার পরে ভিড় করেন স্বজনরা। তাদের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে পার্কের পরিবেশ। আস্তে আস্তে শনাক্ত হওয়ার পরেই লাশ নিচ্ছেন স্বজনরা। কিছু লাশ নেওয়া হয় হাসপাতালের মর্গে।
সুগন্ধায় নিখোঁজের সন্ধানে ডুবুরিরা : অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচতে নদীতে লাফিয়ে পড়াদের উদ্ধারে অভিযান শুরু করে কোস্টগার্ড, ফায়ার সার্ভিস ও নৌ পুলিশের ডুবুরি দল। গতকাল শুক্রবার বেলা ১১টা থেকে তিন বাহিনীর তিন দল উদ্ধার অভিযান শুরু করে। দুপুর সাড়ে ১১টায় ঝালকাঠির সহকারী পুলিশ সুপার মাহবুব হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, ডুবুরি দল ৯ জনের লাশ উদ্ধার করেছে। তারা সবাই লঞ্চের আগুন থেকে বাঁচতে নদীতে ঝাঁপ দেন। উদ্ধার অভিযান চলছে।
‘ভাইস্যা আছিলাম দুই ঘণ্টা’ : ‘লঞ্চে আগুন লাগার সময় নিচতলার ইঞ্জিন রুমের পাশে স্বামী ও মাইয়া লইয়া ঘুমাইয়া আছিলাম। ধোঁয়ায় শ্বাসকষ্ট ট্যার পাইয়া লাফাইয়া উইড্ডা দেহি হারা লঞ্চে আগুন। পরে তিনতলায় উইড্ডা মাইয়া আর স্বামীরে লাইয়া নদীতে লাফ দিছি। দুই ঘণ্টা নদীতে ভাইস্যা আছিলাম। পরে এলাকার মাইনসে আইয়া উদ্ধার করছে। হুঁশ হইয়া মাইয়ারে পাইলেও স্বামীরে পাই নাই।’
কথাগুলো বলছিলেন ঝালকাঠি সদর হাসপাতালের দ্বিতীয় তলার সাধারণ ওয়ার্ডে পোড়ার ক্ষত নিয়ে চিকিৎসাধীন ময়ফুল বিবি (৬৫)। পাশেই আহত তার মেয়ে হালিমা বেগম (৪৫)। হালিমার বাবা আবদুল হামিদ হাওলাদার (৭৫) এখনো নিখোঁজ। তারা হামিদের জন্য বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তাদের বাড়ি বরগুনার বামনা উপজেলার গোলাকাটা গ্রামে।
হালিমা বেগম বলেন, ‘নদীতে ঝাঁপ দিয়া দ্যেহি চাইরো দিকে কুয়াশা। দুই আত (হাত) পাশের কিছু দ্যেহায়না। মায়রে লাইয়া দুই ঘণ্টা নদীতে ভাইস্যা আছিলাম। তয় কূলে উইড্ডা আমার বুড়া বাপজানরে পাইলাম না।’ ময়ফুল বিবি বলেন, ‘আমার স্বামীরে লাইয়া ঢাকায় মাইয়ার বাসায় ব্যাড়াইতে গ্যাছিলাম। অনেক দিন পর লঞ্চে দ্যাশে ফেরতে আছিলাম। কিন্তু আমার স্বামী তো ফিরল না।’
কয়েকজন যাত্রী অভিযোগ করে বলেন, ঝালকাঠির নলছিটির কাছে আসতেই লঞ্চের ইঞ্জিনে আগুন ধরে যায়। কিন্তু লঞ্চ কর্তৃপক্ষ পাড়ে ভেড়ানোর চেষ্টা করেনি। পরে আগুন বেশি ছড়িয়ে পড়লে সদরের চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে ভেড়ানোর চেষ্টা করেন লঞ্চটির চালক। কিন্তু সেখানের চরে লঞ্চটি না আটকে ওপারের দিয়াকুল গ্রামে গিয়ে ভেড়ে। এই সময়ের মধ্যে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
লঞ্চযাত্রী বরগুনার লাকুরতলার সীমা আক্তার (৪০) বলেন, লঞ্চে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে পাড়ে ভেড়ালে হতাহত কম হতো। এ ক্ষেত্রে লঞ্চ কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছিল। তাছাড়া লঞ্চে আগুন নেভানোর তেমন ব্যবস্থা ছিল না। ফায়ার সার্ভিসের দল অনেক পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
চরভাটারকান্দা গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী কৃষক বেলায়েত হোসেন বলেন, লঞ্চটি চর ভাটারকান্দা গ্রামের চরে আটকাতে পারলে হতাহতের সংখ্যা কম হতো। অনেকে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে মারা গেছেন। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।
সন্তানদের খুঁজে না পেয়ে পাগলপ্রায় দুই মা : নিখোঁজ দুই সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে পাগলপ্রায় দুই মা। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তরা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী স্বপ্নিল চন্দ্র হাওলাদার (১৬)। সে তার মায়ের সঙ্গে গ্রামের বাড়ি বরগুনার বামনায় বেড়াতে যাচ্ছিল। নিখোঁজ অপর শিশুসন্তান হচ্ছে আড়াই বছরের তাবাচ্ছুম। তার বাবা বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার ছোট পাথরঘাটা গ্রামের একটি মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ নাছরুলুল্লাহ (২৭)।
ওই দুই সন্তানের মা-বাবা তাদের সন্তানদের খোঁজে কখনো সুগন্ধার পাড়ে, আবার কখনো সদর হাসপাতালে ছুটছেন। তাদের কান্নায় হাসপাতাল ও সুগন্ধার পাড়ের পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। প্রশাসন বলছে, নিখোঁজ ব্যক্তিদের উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
মসজিদের ইমাম মুহাম্মদ নাছরুলুল্লাহ বলেন, ‘লঞ্চের মধ্যে ধোঁয়ায় টিকতে না পেরে আমি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তিনতলার ছাদে উঠে যাই। সেখানে কুয়াশার মধ্যে নদীর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। এ অবস্থায়ই আমরা মেয়েসহ নদীতে ঝাঁপ দিই। পরে তীরে ওঠার আগেই মেয়েকে হারিয়ে ফেলি।’ একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে স্ত্রী সোনিয়াও বারবার কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরও বলেন, ‘আমার মেয়েকে যেন প্রশাসন খুঁজে বের করে দেয়। আমার সোনার মানিককে আপনারা আইনা দেন।’
শিক্ষার্থী স্বপ্নিল চন্দ্র হাওলাদারের মা স্বপ্না হাওলাদার বলেন, ‘লঞ্চে আগুন লাগার আগমুহূর্তে আমার ছেলে স্বপ্নিল শৌচাগারে যায়। পরে আগুন ছড়িয়ে পড়লে আমি আমার ছোট ছেলেকে নিয়ে কেবিন থেকে লঞ্চের সামনে যাই। পরে স্থানীয়রা আমাদের উদ্ধার করলেও আমার ছেলেকে খুঁজে পাইনি।’
শেবাচিমে স্বজনদের আহাজারি : এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসাদের স্বজনরা ভিড় করেন সার্জারি বিভাগের সামনে। প্রিয়জনের দগ্ধ অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। এতে সার্জারি ইউনিটের সামনে এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়।
গতকাল শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টা থেকে সকাল ১০টার মধ্যে ৭০ জনকে হাসপাতালের সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। ভাইয়ের ছেলে দগ্ধ হওয়ার ঘটনা শুনে ভোররাতেই শের-ই-বাংলা মেডিকেলের সার্জারি ইউনিটে ছুটে আসেন চাচা জালাল আহমেদ। সার্জারি ইউনিটের সামনে বসে থাকতে দেখা যায় তাকে।
ভাইয়ের ছেলে অগ্নিদগ্ধ হাওয়ায় অনেকটাই বাকরুদ্ধ জালাল আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে একটি মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন আমার ভাইয়ের ছেলে লোকমান হোসেন। আমি রাতে ফোন দিলে ও বলে একটু কাজ আছে, আধাঘণ্টার মধ্যেই রওনা দেব। ভাতিজা আমার আর সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরল না। আগুনে পুড়ে সে এখন মেডিকেলে ভর্তি।
ভাগনে ঢাকার রেস্তোরাঁর বাবুর্চি রাশেদ সর্দারের অগ্নিদগ্ধ হওয়ার ঘটনা শুনে সকালে সার্জারি ইউনিটে ছুটে এসেছেন মামি তাহেরা আক্তার। সার্জারি ইউনিটের সামনে তার হৃদয়বিদারক আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে আশপাশের পরিবেশ। তার চিৎকারে ঘটনাস্থলে থাকা অনেকের চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আসে।
পুড়ে অঙ্গার তাইফা, হাসপাতালে দগ্ধ বাবা : লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয়েছে তাইফা আফরিন (১০) নামের এক শিশু। এ দুর্ঘটনায় তাইফার বাবা গুরুতর দগ্ধ হয়ে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসাধীন। নিহত তাইফা বরগুনার কেওড়াবুনিয়া ইউনিয়নের রোডপাড়া গ্রামের বশির উদ্দিনের মেয়ে।
স্বজনরা জানান, ক্যান্সারে ভুগছিলেন তাইফার নানা আলী শিকদার। তাকে ডাক্তার দেখাতে বাবার সঙ্গে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সদরঘাট থেকে বরগুনাগামী এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে চড়েন। এরপর লঞ্চটি ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে আসলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
এসময় তাইফার নানা জীবন বাঁচাতে নদীতে ঝাপ দেন। তাইফা ও তার বাবা ডেকে আটকে পড়েন। তাইফা অগ্নিদগ্ধ হয়ে লঞ্চেই মারা গেলেও দগ্ধ হন বশির উদ্দিন। তার নানা আলী শিকদার এখনও নিখোঁজ রয়েছেন।
শেবাচিমের বার্ন ইউনিট বন্ধ, বিপাকে লঞ্চে দগ্ধরা : বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগ প্রায় দুই বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। এর ফলে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ নামে লঞ্চে অগ্নিদগ্ধ ৭০ জন রোগী। চিকিৎসক না থাকায় এখন রোগীদের ভরসা ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সরা। লঞ্চ দুর্ঘটনায় আহত রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করে জানান, শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েছেন তারা। সার্জারি ওয়ার্ডের মেঝেতে তাদের স্বজনদের চিকিৎসা চলছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালে কর্মরত একাধিক নার্স জানিয়েছেন, ইউনিটটি চালু না থাকায় অগ্নিদগ্ধ রোগীরা মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়ছেন। ঢাকায় যেতে না পারা রোগীরা শেবাচিমের সার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাসেবা নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে সার্জারি বিভাগে ভর্তি হওয়া অগ্নিদগ্ধ রোগীরা জানান, সার্জারি বিভাগে অগ্নিদগ্ধদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই। ইন্টার্ন চিকিৎসক ও নার্সরাই রোগীদের একমাত্র ভরসা।
বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাইফুল ইসলাম জানান, চিকিৎসকের অভাবে হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগটি বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ৭২ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। রোগীর অবস্থা গুরুতর হলে তাদের ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তিনি আরও জানান, হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের তিন ওয়ার্ডে ৫০ জন চিকিৎসক ও ইন্টার্ন চিকিৎসক দগ্ধ রোগীদের সেবা দিচ্ছেন। তবে সেখানে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নেই। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।
দগ্ধদের চিকিৎসায় বরিশালে চার চিকিৎসক : এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ অনেক রোগী বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ হাসপাতালটিতে দুই বছর আগে বার্ন ইউনিট উদ্বোধন হলেও বর্তমানে সেটি বন্ধ। ফলে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে সার্জারি ইউনিটে!
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা দিতে ঢাকা থেকে চারজন প্রশিক্ষিত বার্ন চিকিৎসক বরিশাল যাচ্ছেন। গতকাল বিকেলে ফ্লাইটযোগে তারা রওনা হন।
দেশের ১৪টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার ব্যাপারে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ করা হচ্ছে। সকালে ঘটনা শোনার পর ঢাকা থেকে সড়কপথে বার্ন ইউনিটের চারজন চিকিৎসককে বরিশাল পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে, সড়কপথে ফেরি পারাপারসহ বিভিন্ন সমস্যার কারণে তাদের ফ্লাইটযোগে বরিশাল পাঠানো হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মালদ্বীপে সফররত স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকও তার সঙ্গে লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে পোড়া রোগীদের চিকিৎসায় যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে আলোচনা ও নির্দেশনা প্রদান করেন বলে তিনি জানান।
লাশ শনাক্ত হলেই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর : নিহতদের লাশ ডিএনএ পরীক্ষা ও স্বজনরা শনাক্তের পর হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে বলে জানিয়েছেন ঝালকাঠির জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী। বর্তমানে লাশগুলো ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ৩৫ জনের লাশ আমরা হাতে পেয়েছি। যেগুলো ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্তের পর কিছু ঝালকাঠি ও বেশিরভাগই বরগুনায় পাঠানো হবে। লাশ শনাক্তের কার্যক্রম প্রায় শেষ পর্যায়ে। জেলা প্রশাসক মো. জোহর আলী বলেন, এ ঘটনায় ঝালকাঠি জেলা প্রশাসন থেকে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। নিহতদের দাফন-কাফনের জন্য ২৫ হাজার টাকা প্রদান করা হবে।
ঝালকাঠির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মঈনুল হক বলেন, ভোর ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। যাত্রীদের উদ্ধারে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কাজ করেন। দগ্ধ যাত্রীদের হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানান পুলিশের এ কর্মকর্তা।
বরগুনার জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের অধিকাংশের বাড়ি বরগুনায়। খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিকভাবে নিহত প্রত্যেক পরিবারকে ২৫ হাজার টাকা ও আহতদের ১৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।