Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কন্যা শিশুদের আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান করতে হবে

খোন্দকার মাহ্ফুজুল হক | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

হঠাৎ আলোচনায় উঠে আসে এক কিশোরী। নিজ স্কুলের সামনে সে একা, প্ল্যাকার্ড হাতে। তাতে লেখা রয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব থেকে পৃথিবী ও পরবর্তী প্রজন্মকে রক্ষায় বড়দের আরও অনেক বেশি সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অনেক বড় এবং বৃহত্তর পরিসরের দাবিতে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সে একাই মাঠে নামে। একে একে তার পাশে জড় হয় অনেকেই। এক পর্যায়ে সারাবিশ্ব তার দাবিতে একাত্ম হয়। অল্প সময়ে এই কিশোরী জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্দোলনে সারা বিশ্বের দূত হয়ে উঠে। তার ডাকে জড় হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। সুইডিশ এ কিশোরীর নাম গ্রেটা থুনবার্গ। আত্মবিশ্বাসের জোরেই সে পৃথিবীকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
আত্মবিশ্বাস মানবীয় বিকাশেরই একটি অধ্যায়। ছোটবেলা থেকেই এটি তৈরি করতে হয়। গ্রেটা থুনবার্গের আত্মপলব্ধিই তার আত্মবিশ্বাসের উৎস হয়ে কাজ করেছে। ইবি হারলকের মতে, আত্মোপলদ্ধির মাধ্যমে ব্যক্তির ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, আগ্রহ প্রকাশ পায়, যা বিকাশমূলক আচরণকে পরিপূর্ণতা দান করে। এর আলোকেই দেখা যায়, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ইস্যুতে কন্যাশিশুরা ব্যপক ভূমিকা রাখছে। বিগত অনেক ইস্যুর মতো আমাদের দেশে নিরাপদ সড়ক ইস্যুতেও অসংখ্য কিশোরীকে রাস্তায় ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছে।
আত্মবিশ্বাস অর্জনের বিষয়টি যেহেতু একটি বিকাশ প্রক্রিয়া, তাই শৈশবকাল থেকেই চর্চার মাধ্যমে এ যোগ্যতাটি গড়ে তুলতে হয়। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম বাবা-মায়ের ওপর দায়িত্ব বর্তায়। তাদেরকেই কন্যাশিশুর ব্যাপারে বৈষম্যহীন ভূমিকা পালন করতে হবে। শুরু থেকেই কন্যাশিশুর সামাজিকীকরণে বাড়তি নজর দিতে না পারলে শিশু আত্মবিশ্বাসী ও স্বাবলম্বী হতে বাধাগ্রস্ত হবে। বর্তমান সময়েও অনেক পরিবারে খাবার, চলাফেরা, খেলাধুলা ইত্যাদিতে ছেলেমেয়ের বিভেদ দেখা যায়। এ বিভেদ শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশু আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। এ বিষয়ে অভিভাবকদের সতর্ক থাকতে হবে।
কন্যাশিশুর আত্মবিশ্বাস বাড়াতে তাকে সাইকেল চালানো, ছবি আঁকা, সুপ্ত প্রতিভা প্রকাশে উৎসাহ প্রদান করতে হবে। ঘরের কাজের গণ্ডি ছাড়িয়ে বড় স্বপ্ন দেখাতে হবে। গায়ে হাততোলার প্রবণতা বাদ দিয়ে যৌক্তিক হতে হবে। কন্যাশিশু নিয়ে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার ও ট্যাবু’র প্রভাব যেন শিশুর ওপর না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভালো-মন্দ, বিপজ্জনক কাজ, নিরাপদ থাকার কৌশল শিক্ষা দিয়ে শিশুকে নিরাপদ রাখতে হবে। অন্যদের শারীরিক গড়ন, ত্বকের রং ইত্যাদি নিয়ে শিশুর সামনে উপহাস, মন্তব্য পরিহার করতে হবে। অন্যের সামনে নাচতে, গাইতে বলে শিশুদের বিব্রত করা ঠিক না। মনে রাখতে হবে, সবাইকে বিনোদিত করা আমাদের শিশুদের বিশেষ করে কন্যাশিশুর কাজ না।
ভারতের ক্লিনিক্যাল এবং শিশু মনোরোগ বিশারদ ডা. ধীরেন্দ্র কুমারের মতে, একটি ছেলে শিশুর প্রশংসা করতে যে দিকগুলো তুলে ধরা হয়, মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রেও ওই দিকগুলো উল্লেখ করুন। এতে ছেলে এবং মেয়ে সন্তান আলাদা এ ধরনের মনোভাব থেকে আমাদের শিশু দূরে থাকবে। সফল ব্যক্তিবর্গের জীবনকাহিনী বা দৃষ্টান্ত সম্পর্কে শিশুকে জ্ঞান দানের বিষয়ে অভিভাবকের সচেতনতা প্রয়োজন। পাঠ্য বইয়ের বাইরে সহজ ভাষায় লেখা বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে অভিভাবককে সচেষ্ট হতে হবে। মা-বাবাকেই সন্তানের রোল মডেল হতে হবে। তার মর্যাদার স্বীকৃতি দিতে হবে। জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় আদর্শিক ও বৈজ্ঞানিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। সাইবার জগতের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিক নিয়ে কন্যাশিশুর সাথে সক্রিয় আলোচনা করতে হবে। আইকিউয়ের চেয়ে ইকিউয়ের (ইমোশনাল কোশেন্ট) ওপর গুরুত্ব দিতে হবে অভিভাবককে। ‘পজিটিভ প্যারেন্টিং’-এর মনোভাব নিয়ে ঘরকে শিশুদের জন্য শিক্ষালয় করে গড়ে তুলতে হবে।
শিশুর আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মানকে বিনষ্টকারী বিষয়গুলো যেমন: ভুলের জন্য অন্যের সামনে বকাঝকা করা, অন্য শিশুর সাথে তুলনা করা, অতিরিক্ত যত্ন বা অবহেলা করা, অপমানসূচক আচরণ করা, ভালো কাজে উৎসাহ না দেয়া, অতিরিক্ত নিয়মানুবর্তিতা ইত্যাদি পরিহার করা প্রয়োজন। নিজের অসম্পূর্ণ বা অপূর্ণ স্বপ্নের বোঝা শিশুর কাঁধে তুলে দেয়া সঠিক কাজ নয়। পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা সবাই মেনে চলার মতো করে তৈরি করতে হবে। শিশুকে নিয়ন্ত্রণের কথা না ভেবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবতে হবে। কন্যাশিশুর সুরক্ষা তার আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ় ও নিরাপদ করে। তাই তাকে তার নিজের পরিচয় ঠোটস্থ করানো, ‘না’ বলতে শেখানো, যাচাই করার বয়সের পূর্বে অবিশ্বাস করতে শেখানো, পরিস্থিতির মোকাবিলা, গুডটাচ অ্যান্ড ব্যাডটাচ শেখানো, সতর্ক থাকতে শেখানো, নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ রাখা, শারীরিক ও মনের পরিবর্তন বিষয়ক ধাপসমূহ জানানো ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা করতে হবে।
জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে বাংলাদেশও বিগত বারো বছর ধরে আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস পালন করে আসছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘আমরা কন্যাশিশু : প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হব-ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ব’। বাংলাদেশ সরকারের সকল উন্নয়ন পরিকল্পনায় কন্যাশিশুদের গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষা, ক্রীড়া, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য সুরক্ষাসহ সব ক্ষেত্রেই কন্যাশিশুদের আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি এবং এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সরকারের রয়েছে নানা ধরনের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সহায়তামূলক কর্মসূচি। প্রতিরক্ষাসহ সকল চ্যালেঞ্জিং খাতেও কন্যাশিশুদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করছে সরকার। পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনও নিরলস কাজ করে যাচ্ছে কন্যা শিশুদের নিয়ে।
কল্যাণমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র সৃষ্টির জন্য কন্যাশিশুর এগিয়ে নেয়ার বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে অন্তরায় হলো বৈষম্য ও সহিংসতা। শিক্ষা, ধর্ম, সামাজিক মূল্যবোধ ও বিশ্বায়ন তা হ্রাস করার কথা থাকলেও যেন হ্রাস হয়েও হচ্ছে না। বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিষয়টি গুরুত্বের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা হলেও ফলাফলের গতি অনেকটাই শ্লথ। প্রচার প্রচারণার ফলেও এক্ষেত্রে গতি আসছেনা বলেই মনে করছেন গবেষকরা। অনেকে আবার কন্যাশিশুর আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি ও হীনমন্যতার পেছনে এক শ্রেণির বিজ্ঞাপন ও মিডিয়াকে দুষছেন। সংস্কৃতি এবং সামাজিক অবস্থানতো এর সাথে থাকছেই।
আশার কথা, সব বাধাকে অতিক্রম করে কন্যাশিশুরা তাদের আত্মবিশ্বাসের জোরে অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। পাশে থাকছে পিতা-মাতা, পরিবার, সমাজের সচেতন শ্রেণি ও রাষ্ট্র। নতুন নতুন বিজয়ের বার্তা নিয়ে আসছে তারা আমাদের জন্য। দায়িত্ব পালন করছে ঘর ও দেশ থেকে শুরু করে বিশ্বের শান্তি রক্ষায়।
আজ প্রয়োজন, আমাদের চিন্তা ও মানসিকতার পরিবর্তন। কন্যাশিশুদের কন্যা নয়, সন্তান হিসেবে দেখতে হবে। তাদেরকে গড়ে তুলতে হবে আত্মবিশ্বাসী ও আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন করে। কোনো কন্যাশিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ থাকলে এবং সে আত্মরক্ষায় সক্ষম হলে তার এগিয়ে যাওয়া কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।

লেখক: ইনফরমেশন অ্যসিস্ট্যান্ট, পিআইডি, ঢাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কন্যা শিশু


আরও
আরও পড়ুন