চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ এক ॥
মানবশিশু স্বাধীন সত্তা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। কাজেই জন্মগতভাবেই মানুষ স্বাধীন। পুত্র ও কন্যা একই উৎস থেকে সৃষ্ট। সৃষ্টিগতভাবে কন্যা ও পুত্রের প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যগত কারণে একে অপরের উপর কোন প্রাধান্য রাখে না। মৌলিকতার দিক থেকেও উভয়ের মধ্যে কোন একজনের শ্রেষ্ঠত্ব নেই। বরং একে অপরের পরিপূরক। লৈঙ্গিক ভিন্নতার কারণে নারী ও পুরুষ যখন একে অন্যের উপর অনধিকার চর্চা, বৈষম্য ও প্রাধান্য বিস্তার করতে চায় তখনই অধিকার ক্ষুণœœ হয়। কন্যা বা নারীর মর্যাদা ও অধিকার ইত্যাদি বিষয় নিয়ে প্রাচীন সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের সভ্যতাগর্বী সমাজেও নানা আলোচনা ও মতামত দেখা যায়। এখন পর্যন্ত নিয়ে সন্দিগ্ধ। নারী স্বাধীনতা ও নারীবাদিতা আজকের একটি বহুল আলোচিত বিষয়। ব্যাপারটিকে নিয়ে এমন কিছু ভাবা ও করা হচ্ছে- যার ফলে নারী স্বাধীনতা বা অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেয়ে নারীকে মারাত্মক ব্লাকহোলের মধ্যে ফেলে দেয়া হচ্ছে, যেখান থেকে উত্তরণের বা পরিত্রাণের ক্ষীণ সম্ভাবনাও তিরোহিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আজকের বিশ্ববিবেক যা ভাবছে নারী বা কন্যা শিশু নিয়ে ইসলাম তা সপ্ত শতকেই সমাধান দিয়ে গেছে। কিন্তু মানুষ তা ভুলে গেছে বা বিভ্রান্তির কারণে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে গোলক ধাঁধায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আলোচ্য প্রবন্ধে অন্যান্য ধর্ম ও সমাজে কন্যাশিশুর অবস্থান এবং ইসলাম কন্যা শিশুর আর্থ-সামাজিক অধিকার প্রদানে কতটুকু আইনী ও বাস্তবানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে তা প্রামাণিক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজে কন্যাশিশু : মানব ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলাম ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোন ধর্ম বা সমাজে কন্যার উপযুক্ত মর্যাদা স্বীকৃত হয়নি। সর্বত্রই সে ছিল পুরুষের দাসী ও বিলাসিতার সামগ্রী। সকল প্রাচীন ধর্ম ও আইনে নারী-পুরোহিত, স্বামী ও অভিভাবকের অধীন স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যহীন বলে চিত্রিত হয়েছে। বিশ্বের প্রচলিত ধর্মসমূহের বর্ণনার দিকে তাকালে তা সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ইয়াহুদী ধর্মে : ইয়াহুদীধর্ম আমাদের সামনে কন্যা না নারী সম্বন্ধে যে ধারণা পেশ করে তার সারমর্ম হচ্ছে এই, “পুরুষ সৎকর্মশীল ও সৎস্বভাববিশিষ্ট, আর নারী ভ- ও বদস্বভাববিশিষ্ট। পৃথিবীর প্রথম মানব আদি পিতা আদম আলাইহিস্ সালাম চির সুখের স্থান জান্নাতে স্বচ্ছন্দে বসবাস করছিলেন। তাঁর স্ত্রী হাওয়া তাঁকে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেতে প্ররোচিত করেন।” “আফিফী, মুহাম্মদ সাদিক আল-মারতুওয়া, আল-মারআহ ওয়া হুকূকুহা ফিল ইসলাম, বৈরূত: দারু ইহইয়াইতু তুরাসিল আরাবী, তা. বি, পৃ. ১৩; হুসায়ন, সাদিক, তালীমুল মারআতি ফিল ইসলাম, আল-বাছুল ইসলামী, লক্ষ্মৌ: মুয়াসসাসাতুস সাহাফা ওয়ান নাশর, ১৪২০ হি:, সংখ্যা, ৬. পৃ. ৩৬।’’ ইয়াহুদীধর্ম মতে, নারীর উপর সৃষ্টিকর্তার চিরন্তন অভিশাপ রয়েছে। নারীর কারণে সকলের ধ্বংস অনিবার্য। “ইবঃঃধহু, ঞযব ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহরপধ, ইড়ধৎফ ড়ভ ঊফরঃড়ৎং, ঈযরপধমড়: গধপৎড়ঢ়ধবফরধ, ১৯৯৫, ১৫ঃয াড়ষ. ঠ, ঢ়. ৭৩২.” এ ধর্মে সামাজিক প্রার্থনায় দশজন পুরুষের উপস্থিতি জরুরি ছিল। কিন্তু নয়জন পুরুষ এবং বহু নারী উপস্থিত থাকলেও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হত না। কারণ নারী মানুষরূপে গণ্য হতো না। নারী ছিল উপেক্ষার পাত্র। “ঝযধহবৎ, উড়হধষফ ড: অ ঈযৎরংঃরধহ ারবি ড়ভ উরাড়ৎপব, খবরফবহ: ১৯৬৯, ঢ়. ৩১.”
খ্রিস্টধর্মে : পৃথিবীর অন্যতম ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টধর্ম। তাদের ধর্মগ্রন্থ হল বাইবেল। এ ধর্মে নারীরা ছিল চরম অবহেলিত ও নিগৃহীত। খ্রিস্টানরা কন্যাকে পাপের প্রতীক বলে বিশ্বাস করতো। তারা মনে করতো আদম আলাইহিস্ সালামের স্ত্রী হাওয়া-এর ভুলের কারণে সকল নারীর রক্তে পাপের সঞ্চালন ঘটেছে। খ্রিস্টান পাদ্রীরা নারীকে নরকের দ্বার (ডড়সধহ রং ফড়ড়ৎ ঃড় যবষষ) এবং মানবের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার কারণ মনে করতো। তারা নারীকে সর্বাপেক্ষা জঘন্যরূপে চিত্রিত ও নিকৃষ্ট বিশেষণে ভূষিত করতো। “কাদের, ড. এম. আব্দুল, নানা ধর্মে নারী, চট্টগ্রাম: ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯০, পৃ. ৩৫।’’ খ্রিস্টসমাজ নারীকে আত্মাহীন প্রাণী ও সন্তান উৎপাদনের একটি প্রাকৃতিক যন্ত্ররূপে আখ্যায়িত করেছে। “জাফর, আবূ, নারী স্বাধীনতা : ইসলাম ও পাশ্চাত্য বিশ্ব, ঢাকা: পালাবদল পাবলিকেশন্স লি:, ২০০১, পৃ. ৭৩।” তাদের ধারণা, ঈসা আলাইহিস্ সালামকে শূলবরণ করতে হয়েছে নারীর পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্যই। খ্রিস্টান পাদ্রীদের মতে, “নারী যাবতীয় পাপের উৎস। নারী হচ্ছে শয়তানের প্রবেশস্থল এবং তারা আল্লাহ তাআলার মান সম্মানে বাধা দানকারী।” “আবূল আ‘লা, সাইয়েদ, পর্দা ও ইসলাম, ঢাকা : আধুনিক প্রকাশনী, ১৯৮৭, পৃ. ১০।” এ প্রসঙ্গে মোস্তাম নামক এক খ্রিস্ট ধর্মযাজক বলেন, “নারী এক অনিবার্য আপদ। পরিবার ও সংসারের জন্য হুমকি। মোহনীয় মোড়কে আবৃত বিভীষিকা।” “খরনৎধ, ডড়সধহ যড়ড়ফ ধহফ ঃযব ইরনষব, ঘবি ণড়ৎশ, ১৯৬১, ঢ়. ১৮; ড. মুস্তফা আস-সাবায়ী, ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, আকরাম ফারুক অনূদিত, ঢাকা : বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার, ১৯৯৮, পৃ. ১৪।” সপ্তম শতাব্দীতে ঈড়ঁহপরষ ড়ভ ঃযব রিংব-এর এক অধিবেশন রোম নগরীতে অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়: “নারীর কোন আত্মা নেই” (ডড়সধহ যধং হড় ংড়ঁষ.) খ্রিস্টান সাম্রাজ্যে নারীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা ও অবিচার বর্ণনাতীত। নারী জাতিকে অতীব হীন ও তুচ্ছ প্রতিপন্ন করার ব্যাপারে ইয়াহুদী ও খ্রিস্টধর্মের প্রবল ভূমিকা রয়েছে। উভয় ধর্মই নারীকে পাপের আদি কারণরূপে আখ্যায়িত করেছে। বাইবেলে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত আছে যে,
“পরে তিনি নারীকে কহিলেন, আমি তোমার গর্ভবেদনা অতিশয় বৃদ্ধি করিব, তুমি বেদনান্তে সন্তান প্রসব করিবে; এবং স্বামীর প্রতি তোমার বাসনা থাকিবে; সে তোমার উপরে কর্তৃত্ব করিবে। “ঐড়ষু ইরনষব, এবহবংরং, ৩ : ১৬, ঢ়, ৪”
সেন্ট টমাস ঘোষণা করছেন : “নারী ঘটনাক্রমে সৃষ্ট একটি জীব। এটা জেনেসিস প্রতীকী হয়েছে, সেখানে হাওয়াকে আদমের একটি হাড় থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে।” “সাইমন, ডি. বিভোর, দ্য সেকে- সেক্স, ঢাকা : এশিয়াটিক পাবলিকেশন্স, ২০০১, পৃ. ১৫।”
খ্রিস্টান এক পাদ্রী বলেছেন: “নারী সব অন্যায়ের মূল, তার থেকে দূরে থাকাই বাঞ্ছনীয়। নারী হচ্ছে পুরুষের মনে লালসা উদ্রেককারী। ঘরে ও সমাজে যা অশান্তির সৃষ্টি হয় তা সব তারই কারণে। আর এ কারণেই তারা নারীর শিক্ষা অধিকার নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল।” “ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪।”
মেরী-ওলস্টোনক্রাফট (গধৎু ডড়ষষংঃড়হবপৎধভঃ) উল্লেখ করেন, “রুশো থেকে শুরু করে ড. গ্রেগরী পর্যন্ত যারাই নারীর শিক্ষা ও আচরণ সম্পর্কে কথা বলেছেন, তারা নারীকে দুর্বল এবং নিকৃষ্ট হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তাদের মতে, নারীর স্বাধীনতা ভোগ করার ক্ষমতা নেই। পুরুষের মধু সাথী হিসেবেই তাকে ভাল মানায়। আনুগত্য তার প্রধান গুণ। পুরুষের তুলনায় নারীর এই দুর্বলতা প্রাকৃতিক ব্যাপার”। রুশোর এসব ধারণাকে মেরী ননসেন্স বলেছেন। “মোহাম্মদ, আনু, নারী, পুরুষ ও সমাজ, ঢাকা : বইপড়া, ১৯৯৭, পৃ. ১৮১৯।’’
গ্রিক সভ্যতা : গ্রিকরা নারীদের সম্পর্কে বলত: “নারীজাতি সকল অকল্যাণের মূল।” “হেমা, আসমা জাহান, ইসলামের ছায়াতলে নারী, ঢাকা: আল-এছহাক প্রকাশনী, পৃ. ৩০।” গ্রিক সভ্যতার যুগে নারীকে দুর্বিষহ মানবেতর দুর্গম পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। গ্রিক সভ্যতায় নারী কি মর্যাদার অধিকারী ছিল তা সক্রেটিস এবং এন্ডারস্কির ভাষায় অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সক্রেটিস বলেন- “নারী বিশ্বজগতের বিশৃঙ্খল ও ভাঙনের সর্বশ্রেষ্ঠ উৎস। সে দাফালি বৃক্ষের ন্যায়, যা বাহ্যত খুব সুন্দর দেখায়। কিন্তু চুড়ইপাখি তা ভক্ষণ করলে তাদের মৃত্যু অনিবার্য।” “সক্রেটিস বলেন : ডড়সধহ রং ঃযব মৎবধঃবংঃ ংড়ঁৎপব ড়ভ পযধংব ধহফ ফরংৎঁঢ়ঃরড়হ রহ ঃযব ড়িৎষফ. ঝযব রং ষরশব ঃযব উধভধষর ঞৎবব যিরপয ড়ঁঃধিৎফষু ষড়ড়শং াবৎু নবধঁঃরভঁষ, নঁঃ রভ ংঢ়ধৎৎড়ংি বধঃ ঃযবু ফরব রিঃযড়ঁঃ ভধরষ’’
ঘধুযধঃ অভুধ ধহফ কযঁৎংযরফ অযসধফ, ঞযব ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ডড়সধহ রং ওংষধস, কঁধিরঃ: ওংষধসরপ নড়ড়শ ঢ়ঁনষরংযবৎং, ১৯৮২, ঢ়. ৯-১০.”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।