চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
॥ দুই ॥
গ্রিক সভ্যতায় নারী সম্পর্কে ধারণা ব্যক্ত করতে যেয়ে এন্ডরসকি বলেন: “অগ্নিতে দগ্ধ রোগী ও সর্পদংশিত ব্যক্তির আরোগ্য লাভ সম্ভব। কিন্তু নারীর যাদু প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।” “এ-ারসকি বলেন : ঈঁৎব রং ঢ়ড়ংংরনষব ভড়ৎ ভরৎবনঁৎহং ধহফ ঝহধশব-নরঃব; নঁঃ রঃ রং রসঢ়ড়ংংরনষব ঃড় ধৎৎবংঃ ড়িসধহ’ং পযধৎসং.”- ঘধুযধঃ অভুধ ধহফ কযঁৎংযরফ অযসবফ, ঞযব ঢ়ড়ংরঃরড়হ ড়ভ ডড়সধহ রহ ওংষধস, ওনরফ.” গ্রিক সমাজে বিবাহের ক্ষেত্রে নারীর মতামত বিবেচনাযোগ্য ছিল না। নারীকে তার অভিভাবকের ইচ্ছার নিকট নতি স্বীকার করতে হতো। “অষষবহ, ঊ. অ., ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ঈরারষরুধঃরড়হ, ৩ ঢ়ধৎঃ, ঢ়. ৪৪৩.”
রোমান সভ্যতা : বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতা হচ্ছে রোমান সভ্যতা। রোমান সভ্যতায় নারীর আইনগত কোন অধিকার স্বীকৃত ছিল না। নারীর সামাজিক, নৈতিক তথা শিক্ষা-দীক্ষায় ছিল অবহেলিত ও বঞ্চিত। রোমান সমাজে মেয়ে সন্তানকে আজীবন পিতার অনুগত হয়ে থাকতে হতো। পুরুষের গৃহ সজ্জিত করার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিল নারী। স্বামীর মৃত্যুর পর তার পুত্র বা দেবর-ভাসুরদের তার উপর আইনানুগ অধিকার জন্মাত। “অষ-ঐধঃরসু, ঝধরফ অনফঁষষধয ঝবরভ, ডড়সধহ রহ ওংষধস, খধযড়ৎব: ওংষধসরপ ঢ়ঁনষরপধঃরড়হং খঃফ., ১৯৭৯, ঢ়. ৩. ৪.” পুরুষদের যৌনক্ষুদা নিবারণের হাতিয়ার হিসেবে নারী ব্যবহৃত হতো। এমনকি স্বামী কোন অপরাধের দায়ে স্ত্রীর মৃত্যুদ- পর্যন্ত দিতে পারতো। “ডড়সধহ রং ওংষধস, নরফ. ঢ়.৩-৪.”
চীন সভ্যতা : পৃথিবীর প্রাচীনতম চীন সভ্যতায় কন্যার মর্যাদা ছিল সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট। একটি চীনা প্রবাদে আছে: “তোমরা স্ত্রীর কথা শোন, কিন্তু বিশ্বাস করো না।” “ইসলাম ও পাশ্চাত্য সমাজে নারী, প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩।” এ কথাতেই প্রতীয়মান হয় চীন সভ্যতায় কন্যার অবস্থা ছিল অত্যন্ত শোচনীয়। চীনের ধর্মগ্রন্থে নারীকে “ডধঃবৎ ড়ভ ড়িব” (দুঃখের প্রস্রবণ) হিসেবে বর্ণিত হয়েছে, যা সকল সৌভাগ্য ভাসিয়ে নিয়ে যায়। “খালেক, আব্দুল, নারী ও সমাজ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা: ১৯৯৫, পৃ. ৫।” বেটানী বলেছেন : “অতলান্ত মৎস্যের গতিবিধির ন্যায় অপ্রমেয় ও অবোধ্য, নারী চরিত্রে বহুবিধ ছলনায় আচ্ছাদিত। তার মধ্যে সত্য পাওয়া দুষ্কর। তার নিকট মিথ্যা-সত্য সদৃশ এবং সত্য মিথ্যাসম।” “দ্যা ইনসাইক্লোপীডিয়া ব্রিটানিকা, প্রাগুক্ত, খ. ৫, পৃ. ৭৩২।”
হিন্দু সভ্যতা : পৃথিবীর প্রচলিত ধর্মসমূহের মধ্যে হিন্দুধর্ম সম্ভবত সবচেয়ে প্রাচীন। এ ধর্ম বৈদিক ধর্ম, আর্যধর্ম, ব্রাহ্মধর্ম ইত্যাদি নামেও পরিচিত। “ডধষশবৎ, ইবহলধসরহ, ঐরহফঁ ডড়ৎষফ, খড়হফড়হ: এবড়ৎমব অষষবহ ্ টহরিহ খঃফ. ড. উ., চ. ২৪৫; ঝ. ঈ. ঈযধঃঃবৎলবব ঋঁহফধসবহঃধষং ড়ভ ঐরহফঁরংস, ঈধষপঁঃঃধ, ১৯৭০. চ.২.”
হিন্দু ধর্মে নারীর কোন মর্যাদা দেয়া হয়নি। এ ধর্মের অন্যতম গ্রন্থ ‘মহাভরত” এ বলা হয়েছে, “নারী অশুভ, সকল অমঙ্গলের কারণ, কন্যা দুঃখের হেতু।” “মহাভারত, ১ : ১৫৯ : ১১।” বেদে উল্লেখ রয়েছে, “যজ্ঞকালে কুকুর, শুদ্র ও নারীর দিকে তাকাবে না।” “ বেদ, ৩ : ২ : ৪ : ৬।” হিন্দু ধর্মে নারীকে কোন উত্তরাধিকার স্বত্ব প্রদান করা হয়নি। “আব্বারাহ, আফীফ আব্দুল ফাত্তাহ, রূহূদ দ্বীনিল ইসলামী, বৈরূত: দারুল ইলম লিল মালায়িয়ীন, ১৯৮৫, পৃ. ৪১৯।” ভারতীয় সভ্যতায় নারীর অবস্থা ছিল অতীব শোচনীয়। উচ্চশ্রেণি ও রাজবংশের নারীদেরকে অধিকতর সাবধানতার সাথে ভিন্ন পুরুষদের নিকট হতে দূরে রাখা হতো। কারণ, সকল ধ্বংসের মৌল উৎস ছিল নারী। বৈদিক যুগে নারী ছিল যুদ্ধলব্ধ লুটের মালামালের ন্যায়। ঐ সকল যুদ্ধে বিজয়ের পর বিজয়ী পক্ষ জোরপূর্বক নারীদের অপহরণ করতো এবং লুণ্ঠিত সামগ্রীর ন্যায় তাদেরকে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করতো। তৎকালীন সময়ে স্বামী স্ত্রীকে সেবাদাসীরূপে ব্যবহার করতো। কন্যা সন্তান প্রসবকারিনী স্ত্রী সর্বক্ষেত্রে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হতো। স্বামীর ব্যভিচার, পতিতাবৃত্তি, এমনকি মৃত্যুতেও বিবাহ ভঙ্গ করা যেত না। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে অমিল, রেষারেষি, শত্রুতা ও ঘৃণা বিরাজ করলেও বিবাহ-বিচ্ছেদ নারীর পক্ষে সম্ভব ছিল না। কোরআন নাযিলের পূর্বে দুনিয়ার কোন দেশেই নারী স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত ছিল না। কোথাও নারী সম্পত্তির মালিক ও উত্তরাধিকারী হতে পারতো না। “গধষরশ, ঋরফধ ঐঁংংধরহ, ডরাবং ড়ভ ঃযব চৎড়ঢ়যবঃ, খধযড়ৎ : অংযৎধভ ঢ়ঁনষরপধঃরড়হং, ১৯৮৩, ঢ়. ১২-১৫.”
ভারতীয় সমাজে কন্যা সন্তান জন্ম নেয়া যেমন অপরাধ ছিল, তেমনি গোটা সামজে নারী ছিল ব্যবহার সামগ্রী সদৃশ। মানুষ হিসেবে নারীর ছিল না কোন মানবাধিকার।
বৌদ্ধধর্মে : বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মসমূহের মধ্যে বৌদ্ধধর্ম অন্যতম। বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ নারী জাতির জন্য কিছুই করে যাননি এবং কোন কিছু করার প্রয়োজনও বোধ করেননি। জানা যায়, রাজমহিষী মল্লিকাদেবী কন্যাসন্তান প্রসব করলে রাজা বিমর্ষ হন। বুদ্ধ তাকে সান্ত¦না দিয়ে বললেন, “কন্যাসন্তানের জন্ম হেতু কারো দুঃখ করা উচিত নয়। সুশীলা ও ধর্মপ্রাণ কন্যা হলে সে পুত্র অপেক্ষা শ্রেয় হয়।” “বড়–য়া, ড. সনন্দা, বৌদ্ধ ধর্মের আলোকে নারীর অবস্থান, ঢাকা: বাংলাদেশ বুদ্ধিষ্ট ফেডারেশন, স্মরণিকা, ১৯৯৬, পৃ. ২২।” হিন্দু ধর্মের ন্যায় বৌদ্ধ ধর্মে নারী ততটা অবহেলিত নয়। মহামঙ্গল সূত্রে গৌতম মাতার সেবা ও স্ত্রীর ভরণ-পোষণকে উত্তম মঙ্গল বলে আখ্যায়িত করেন। “দৌলাতানা, মমতাজ, ধর্ম, যুক্তি ও বিজ্ঞান, ঢাকা: জ্ঞানকোষ, ১৯৯৭, পৃ. ১০৮।”
উপযুক্ত বিবরণ থেকে এটা সুস্পষ্ট যে, ইয়াহুদী, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মের কোন একটিতেও কন্যা বা নারীর কোন মর্যাদা ছিল না। নারী যে একটি প্রাণী, পুরুষের মত তারও প্রাণ আছে তা উপরে বর্ণিত কোন ধর্মই স্বীকার করতো না। নারীকে গৃহের অন্যান্য আসবাবপত্রের মত মনে করা হতো। নারী ছিল শিক্ষা-দীক্ষাসহ সর্বপ্রকার স্বাধিকার হতে চির বঞ্চিত।
আরব সামাজে : মহানবী (সা.)-এর নবুওয়াত পূর্বযুগে আরবে কন্যাসন্তানের পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান খারাপ ছিল। জাহেলী যুগে কন্যারা ছিল ঘৃণিত, মর্যাদা বর্হিভূত এবং অধিকার ও মূল্যহীন। তারা মানবরূপে গণ্য ছিল না। কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করলে সে চরম অভিশপ্ত বলে গণ্য হতো। কন্যা সন্তানকে জীবন্ত কবর দেয় হতো। ভোগ্য পণ্যের চেয়ে অবমূল্যায়িত ছিল নারী। এককথায় কন্যারা সে সামজে ছিল শোষিতা, অধিকার বঞ্চিতা এবং শিক্ষা-দীক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের কোন সুযোগই তারা পেত না। এ প্রসঙ্গে ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ড়ভ ইৎরঃধহরপধ এ বলা হয়েছে-“সে সমাজে নারীদের স্থান এত অধঃপতিত ছিল যে, তাদের সন্তানরা তাদেরকে দাসে পরিণত করত। নারীরা নিজ গৃহেই ছিল নির্বাসিত। স্ত্রীদের শিক্ষার অধিকার ছিল না। তাদের স্বামী কর্তৃক তারা একটা বাচাল বৈ কিছুই মনে করা হত না।” “ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ড়ভ ইৎরঃধহরপধ-এ বলা হয়েছে, ‘ডড়সবহ’ ংঃধঃঁং যধফ ফবমবহবৎধঃবফ ঃড় ঃযধঃ ড়ভ পযরষফ নবধৎরহম ংষধাবং. ডরাবং বিৎব ংবপষঁফবফ রহ ঃযবরৎ যড়সব, যধফ হড় বফঁপধঃরড়হ ধহফ ভবি ৎরমযঃং ধহফ বিৎব পড়হংরফবৎবফ নু ঃযবরৎ যঁংনধহফং হড় নবঃঃবৎ ঃযধহ যধঃঃবৎ.”- ঞযব ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ ইৎরঃধহরপধ, রনরফ, ঠড়ষষ. ১৯, ঢ়. ৯০৯.”
অথচ কন্যা সন্তান প্রসবে নারীর কোন হাত নেই। সে যুগে আবু হামযা নামে এক সম্ভ্রান্ত সর্দার কন্যা সন্তান জন্মের পর অপমানে আত্মগোপন করে বেড়ালে তার স্ত্রী মনের দুঃখে এ কাব্য আবৃত্তি করেছিল- “আবু হামযার কি হল! সে আমাদের নিকট না এসে প্রতিবেশীর বাড়িতে রাত্রি কাটায়। আমি পুত্র সন্তান প্রসব না করার দরুনই সে আমার উপর অসন্তুষ্ট হয়েছে। আল্লাহর কসম! পুত্র সন্তান জন্মাদান আমার ক্ষমতাধীন নয়। আমরা শষ্যক্ষেত্র তুল্য। স্বামীগণ আমাদের মাঝে যে বীজ বপন করে, তাতে সে শস্যের চারাই জন্মে।” “নদভী, সাইয়্যেদ সুলায়মান, সীরাতুন্নবী, আযমগড়: মাতবা আআরিফ, ১৯৫১, খ. ৪, পৃ. ২৯৭।”
ইসলামে : ইসলাম নারীকে সর্র্বোচ্চ মর্যাদা দান করেছে। তা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম দেশ ও সামাজে নারীরা নির্যাতিত হচ্ছে। পাচ্ছে না তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। যদি নারী-পুরুষ অপেক্ষা অধিক মুত্তাকী হয় তবে সে আল্লাহর নিকট অধিক সম্মানিত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।