পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অযত্ন, অবৈধ দখল, অবহেলা আর উদাসীনতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত বধ্যভূমিগুলো নিশ্চিহ্ন হতে চলছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও একাত্তরের বধ্যভূমি ও গণকবরের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা যায়নি। সংরক্ষণ করা হয়নি গণশহীদদের নামের তালিকাও। মহান মুক্তিযুদ্ধের যেকোনো স্মৃতি সংরক্ষণ করা আমাদের জাতিসত্তার জন্যই অপরিহার্য। যেকোনো কারণেই হোক যদি এ বিষয়গুলো উপেক্ষিত হয়, তবে তা দুঃখজনক। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত দেশে মোট ২০৯টি বধ্যভূমি ও গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ ১৯৩টি শনাক্ত করেছে। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্যা আরো বেশি। বেসরকারি একটি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে দেশে প্রায় ৫ হাজার ছোট-বড় বধ্যভূমি ছিল। এর মধ্যে সারাদেশে ৯২০টি শনাক্ত করা হয়েছে। এছাড়া ৮৮টি নদী ও ৬৫টি ব্রিজ-কালভার্ট শনাক্ত করা হয়েছে, যেগুলোতে শত শত বাঙালিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে। রাজধানীতে ৭০টি বধ্যভূমির মধ্যে মিরপুরেই রয়েছে ২৩টি। কিন্তু ২৩টি বধ্যভূমির মধ্যে সংরক্ষিত হয়েছে মাত্র ৩টি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের বধ্যভূমির তালিকায় ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় রয়েছে ৩৯টি বধ্যভূমির নাম। এসব বধ্যভূমি অরক্ষিত। একই চিত্র দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বধ্যভূমিগুলোর। বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো সংরক্ষণের পক্ষে উচ্চ আদালত রায় দিয়েছিলেন ২০০৯ সালে। অবশ্য এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর ৩৫টি বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান সংরক্ষণ করতে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু এ কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি।
জানা গেছে, সরকার নতুন করে দেশজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের পাশাপাশি সেখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার জন্যই একটি প্রকল্প হাতে নিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এই প্রকল্পের মেয়াদ আগামী বছরের জুন মাসে শেষ হতে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত মাত্র একটি বধ্যভূমি সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ করতে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। বাকি ২৮০টির মধ্যে ৩টির কাজ শেষের পথে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার জন্য ব্যবহৃত বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন দেয়া হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, ২০২১ সালের জুন মাসের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে কেন মন্ত্রণালয়ের এত অনীহা, তা জানা নেই। অবহেলিত এসব বধ্যভূমি যদি যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা যেত, তবে একদিকে যেমন নতুন প্রজন্ম ইতিহাস সচেতন হতো, তেমনি এসব স্মৃতিচিহ্ন হতে পারত আগামী দিনের পথচলার প্রেরণা। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোকেও জীবন্ত করে রাখতে হবে। বধ্যভূমি সংরক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়। মুক্তিযুদ্ধে নিহত ব্যক্তির পরিবার ও নাগরিকদের উদ্যোগে দেশের বধ্যভূমিগুলোর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। তবে সরকারকে প্রধান ভূমিকা পালন করতে হবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের গণকবর বা বধ্যভূমিতে চাপা দেওয়া হয়েছে বলে আমরা জানি। কিন্তু বাংলাদেশে কতগুলো বধ্যভূমি ও গণকবর আছে এটি কি আমাদের জানা আছে? এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বধ্যভূমি ও গণকবরের তালিকা এবং সংখ্যা হয়তো পূর্ণাঙ্গ নয়। এই কঠিন কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা কারো ব্যক্তিগত উদ্যোগে সম্ভবও নয়। ত্রিশ লাখ মানুষের জন্য কতগুলো গণকবর খোঁড়া হয়েছিল, কতগুলো বধ্যভূমিতে তাদের অন্তিম ঠাঁই হয়েছে, তার সঠিক হিসাব পাওয়া এখন অনেকটাই দুরূহ।
ইতোমধ্যেই বহু গণকবরের নাম-নিশানা মুছে ফেলে সেখানে দালানকোঠা তোলা হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লতাগুল্ম-বনজঙ্গলে ঢাকা পড়ে অযতœ-অবহেলায় অনেক গণকবর আজ লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গেছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল বদর, আলশামস ১৯৭১ সালে সমগ্র বাংলাদেশের প্রতিটি জেলাতেই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। তারা নির্যাতন ও হত্যার জন্য বিশেষ বিশেষ স্থানও বেছে নিয়েছিল। পাকিস্তানিরা বাঙালি হত্যায় সবসময় বুলেটও ব্যয় করেনি। তারা কখনো বেয়োনেট দিয়ে, আবার কখনো বা ধারালো ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে মানুষ খুন করেছে। ময়লার ডিপোতে স্থান পেয়েছে মানবসন্তানের লাশ। হত্যার পর হতভাগ্য মানুষের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছে খালে, বিলে ও নদীতে। যেখানে নদ-নদী ছিল না সেখানে মৃতদেহগুলো মাটিচাপা দিয়েছে। হতভাগ্যদের যেসব স্থানে মৃতদেহ মাটিচাপা দিয়েছিল, ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই সেসব বধ্যভূমি ও গণকবর শনাক্ত করা জরুরি। জেলাভিত্তিক এসব বধ্যভূমি ও গণকবর শনাক্ত করার মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের নির্মমতা, নৃশংসতা, নির্যাতন ও হত্যার বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা লাভ সম্ভব হবে বলে আমি মনে করি।
১৯৭১ সালে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে জাতিকে মেধাশূন্য করার চক্রান্ত করা হয়। রাজাকার, আলবদর ও শান্তিবাহিনীর সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের। এ ছাড়া অগণিত বাঙালিকে হত্যা করা হয়। রচিত হয় বধ্যভূমি, গণকবর। স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো জাতি জানে না শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রকৃত তালিকা। ঠিক কতজন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা হয়েছিল, এ নিয়ে সঠিক তথ্য নেই। বধ্যভূমি-গণকবরের প্রকৃত সংখ্যাও জানা নেই। এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত সব বধ্যভূমি ও গণকবরে স্মৃতিস্তম্ভও স্থাপন করা হয়নি। শ্রদ্ধা জানানো হয়নি সেখানে প্রাণ উৎসর্গ করা দেশের কৃতী সন্তানদের প্রতি, যা আমাদের জাতির জন্য বড়ই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এর পাশাপাশি অযত্ন, অবহেলা ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক বধ্যভূমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কোথাও স্মৃতিস্তম্ভ করা হলেও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে সেগুলোর বেহাল অবস্থা। অনেক স্থানে ভেঙে ফেলা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ। প্রায় নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে তার নিদর্শন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের দেশে যে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছিল তার প্রমাণ হচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো। এগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। পরের প্রজন্মের যারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখতে উদ্যোগী হবেন, তখন তাদের জন্য এসব গণকবর ও বধ্যভূমি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠবে, এতে সন্দেহ নেই। সর্বোপরি দেশের জন্য যারা প্রাণ দিয়েছিলেন, তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতি চিরজাগরুক রাখা জাতি হিসেবে আমাদের অনিবার্য কর্তব্য। পরিতাপের বিষয়, এই কর্তব্য আমরা যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারিনি। এখনো দেশের সবগুলো গণকবর ও বধ্যভূমি শনাক্ত করা যায়নি। যেগুলো শনাক্ত করা হয়েছে, তার সবগুলো সংরক্ষণ করা হয়নি। যেগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে, বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় সংস্কার ও পরিচর্যার অভাবে বেহাল অবস্থা। জনবসতির সম্প্রসারণ, অবকাঠামো নির্মাণ ও ভূমিদখলের প্রবণতায় দেশের বহু গণকবর ও বধ্যভূমি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া অনেক জায়গায় গণকবর ও বধ্যভূমিতে কোনো স্মৃতিসৌধ নির্মাণ বা সংরক্ষণের উদ্যোগ না নিয়ে শুধু জায়গাটি শনাক্ত করে এ বিষয়ে নির্দেশিকা দিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে অনেক জায়গা বেদখল হয়েছে বা দখলের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে বধ্যভূমিগুলো সংস্কারের।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষাবিদ ও উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।