Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমার বাড়ি আমার খামার প্রকল্পের সুফল

শাহনাজ পলি | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০২১, ১২:০৩ এএম

ঋণ নিতে তেমন কাগজপত্র লাগে না। বাড়তি খরচ নেই বা ঘুষও দিতে হয় না। তাই সহজ শর্তে ‘আমার বাড়ি আমার খামার’ প্রকল্প থেকে দুই দফায় ঋণ নিয়ে মাছের খামার করে স্বাবলম্বী হয়েছেন রেহানা বেগম। তিনি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলার কলাতলা ইউনিয়নের বাসিন্দা। ওই একই এলাকার সাথি আকতারও এ প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে উপকৃত হয়েছেন। সাথি ও তার স্বামী দুজনে হাঁস-মুরগির খামার গড়ে তুলেছেন। প্রথম দফায় বেশ লাভবান হয়েছে বলে তারা দ্বিতীয় দফায় আরও ঋণ নিয়ে ব্যবসা বাড়ানোরসুযোগ নিয়েছেন।

ফেনী সদর উপজেলার দমদমা গ্রামের সেলিনা বেগম বিয়ের পর স্বামী সংসারে অভাব ও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে। সংসারের আয় বলতে ছোট্ট একটি দোকানের উপর নির্ভরশীলতা। একসময় অভাবের কারণে ছেলেমেয়ের পড়ালেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। অল্প বয়সেই ছেলেকে কাজে পাঠাতে হয়। একটি এনজিও প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু ঋণ নিয়ে দোকানের পুঁজি বাড়াতে চেষ্টা করে। যে পরিমাণ আয় বাড়ে তাতে ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খেতে হয়। এরপর দমদমা গ্রাম উন্নয়ন সমিতির সদস্য হন সেলিনা বেগম। প্রতি মাসে সংসার খরচ থেকে দুশ টাকা বাঁচিয়ে সমিতির ব্যাংকে জমা দেন। কয়েক মাস পর সমিতি থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে মুদি দোকানে বিনিয়োগ করে স্বামীর ব্যবসায় সহযোগিতা করেন। দিনে দিনে দোকানের আয় উন্নতি বাড়তে থাকে। বছরখানের বাদে তারা আরও কিছু ঋণ নেন এবং দোকানের মালামাল বাড়ান। এতে দোকানের বেচা কেনা বাড়ে। ধীরে ধীরে তাদের অবস্থার পরিবর্তন হয়। সংসারের সব খরচ মিটিয়ে স্বচ্ছন্দে চলে সেলিনা বেগমের সংসার। পাশাপাশি কিছু সঞ্চয় করতেও শুরু করেন। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে ভাগ্যবান মনে করেন একই গ্রামের রেহানা বেগম। তার বেকার স্বামীর এখন একটা কর্মসংস্থান হয়েছে বলে তিনি আরোও স্বস্তিতে আছেন। মাঝে মাঝে অন্যের জমিতে চাষাবাদ করত। তাতে অল্প পরিমাণে আয় রোজগার করলেও সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। দুটি সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে ঋণগ্রস্থও হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে এই প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে প্রথমে একটি গাভী ক্রয় করেন। সেই গাভীর দুধ বিক্রি করে সংসার চালান এবং ঋণের টাকাও পরিশোধ করেন।

রেহানা বা সেলিনা ছাড়াও ওই এলাকার অনেক বেকার তরুণ-তরুণী, গৃহিণী ও দরিদ্র চাষিরা এ প্রকল্প থেকে ঋণ নিয়ে দারিদ্র বিমোচন করেছেন। ওদের মতো সারাদেশের লাখো নারীর ভাগ্য বদলে ভূমিকা রাখছে এই প্রকল্প। গরীব, দুঃস্থ ও অসহায় মহিলাদের ঋণ প্রদানের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন ও আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের অবহেলিত ও বঞ্চিত মহিলা জনগোষ্ঠীর আত্মসচেতনতা বৃিদ্ধ, তাদের অধিকার সংরক্ষণ ও উৎপাদনশীলতার দিক উন্মোচন করে তাদের আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা এ কার্যক্রমের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। তাছাড়া জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকল্পে স্যানিটারী ল্যাট্রিন ব্যবহার, ছেলেমেয়েদের স্কুলে প্রেরণ, জন্মনিয়ন্ত্রণ, প্রাথমকি স্বাস্থ্য পরিচর্যা, শিশুদের টিকা ইনজেকশন প্রদান, যৌতুক ও বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ ইত্যাদি বিষয়ে সচতন করা।

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের ৬৪টি জেলার আওতাধীন ৪৭৩টি উপজেলায় মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিভিন্ন আয়বর্ধক কর্মসূচি যেমন- সেলাই মেশিন ক্রয়, গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন, ক্ষুদ্র ব্যবসা, মৎস্যচাষ, নার্সারি ইত্যাদি বিষয়ে ঋণ প্রদান করা হয়ে থাকে।

কৃষিভিত্তিক বাংলার প্রাণ কৃষক। যে কৃষক ফসল ফলান সুযোগ পেলে তিনিই আবার মাছ চাষ করেন। তার উঠানেই বেড়ে ওঠে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল। আর অঙিনায় শাক-সবজির চাষ হয়। এমন ধরনের পারিবারিক খামার গড়ে তোলার স্বপ্ন থাকলেও অনেকেই পুঁজির অভাবে তা পেরে ওঠেন না। সেই সব প্রান্তিক মানুষের পাশে দাঁড়াতেই সরকারের এই প্রকল্প ‘একটি বাড়ি একটি খামার।’ এ থেকে পরিবারের চাহিদা তো মিটছেই পাশাপাশি তারা বাড়তি ফসল বা দুধ ডিম বিক্রি করে নিজেদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি করছেন।

এ প্রকল্পের অধীনে সমিতির সিংহভাগ সদস্য নারী বলে গ্রামীণ জীবনে নারীর ক্ষমতায়নে এর প্রভাব পড়েছে বলে জানান, ঝিনাইদহ জেলার কাঁচেরকোল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মামুন জোয়াদ্দার। এতে গ্রামীণ সমাজে নারীর অবস্থান, মর্যাদা, কাজ করতে গিয়ে প্রতিবন্ধকতা সর্বোপরি সমিতির মাধ্যমে পরিবারের জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে নারীরা।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বা এসডিজি অর্জনে একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি দেশে তো রয়েছেই, সারা বিশ্বেও এমন মডেল নজিরবিহীন। দরিদ্র মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে স্থায়ী তহবিল গঠনের উদ্দেশ্যে যাত্রা হয় একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের, যা দিয়ে হতদরিদ্র মানুষ দারিদ্র্যসীমা অতিক্রম করতে পারেন।

এ প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি গ্রামে ৬০ জন দরিদ্র মানুষকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় গ্রাম উন্নয়ন সমিতি। সদস্যদের মধ্যে থাকেন ৪০ জন নারী ও ২০ জন পুরুষ সদস্য। প্রত্যেক সমিতির নামে একটি ব্যাংক একাউন্ট খোলা হয় এবং প্রতি মাসে দুই শ করে টাকা জমা দিতে হয়। সরকারও সমপরিমান টাকা ওই ব্যাংকে জমা রাখেন। ওই সব সমিতি সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিতে পারে। নিজ তহবিল ও সরকারের থেকে পাওয়া ঋণ কাজে লাগিয়ে ভাগ্য বদল করতে পারেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্র মানুষ।

‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত সমবায় সমিতি ভিত্তিক একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক পরিকল্পনা। এ প্রকল্পের আওতায় গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলোকে অর্থনৈতিক ইউনিট হিসেবে তৈরি করার মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে দেশে দারিদ্র্য হার ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে এই প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। সমন্বিত গ্রাম উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বাড়িকে অর্থনৈতিক কার্যাবলির কেন্দ্রবিন্দু হিসাবে গড়ে তোলার প্রয়াসে ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। এই প্রকল্পটি ৬৪ জেলার ৪৯০ উপজেলার ৪,৫০৩টি ইউনিয়নের ৪০,৯৫০টি গ্রামে বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রকল্পের বর্তমান মূলধন ৮,০০০ কোটি টাকা এবং গঠিত সমিতির সংখ্যা ৮০,০০০।
লেখক: সাংবাদিক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন