Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

থামছে না মৃত্যু

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালিত পৃথক দুর্ঘটনায় গতকাল প্রাণ গেছে ৪ জনের : লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ২৪ লাখেরও বেশি

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৩ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০০ এএম

‘গতিসীমা মেনে চলি, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করি’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে গতকাল পালিত হলো জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। আর এদিনে দেশে পৃথক দুটি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪ জন। এর মধ্যে ফেনীতে প্রাণ হারিয়েছেন তিনজন ও রাজধানীতে একজন। নিরাপদ দিবসেও সড়ক নিরাপদ নেই, মৃত্যু কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ফেনীর মুহুরীগঞ্জে গতকাল ঢাকা থেকে চট্টগ্রামমুখী একটি দ্রুতগামী পিকআপ ভ্যান নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে। এসময় ঘটনাস্থলেই গাড়ির চালকসহ তিনজন মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে রাজধানীর একটি ফ্লাইওভারে এক মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন। দু’টি দুর্ঘটনাই দ্রুত গতির কারণে হয়েছে। অথচ গতিসীমা মেনে চলার অঙ্গিকার নিয়ে পালিত হয় জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস।
সড়কে এমন বিশৃঙ্খলার চিত্র প্রতিদিনকার বিষয়। অর্থাৎ নিয়ম না মানাই হচ্ছে সড়কের নিয়ম। গাড়ির লাইসেন্স, ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স, ফিটনেস, ট্রাফিক নিয়ম সব কিছুতেই অনিয়মের ছড়াছড়ি। সড়ক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিজেই এ বিষয়টি স্বীকার করেছেন। গতকাল জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবসের অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই। সড়কে শৃঙ্খলা আনাই বড় চ্যালেঞ্জ। সড়কের দুর্ঘটনা দুর্ভাবনার কারণ হয়ে গেছে, প্রতিদিনই ঘটছে। পাখির মতো মানুষ মরে, মাছির মতো মানুষ মরে। এ মর্মান্তিক দৃশ্যপট মানুষ হিসেবে সইতে পারি না। অনেক কষ্ট হয়।
সড়কে প্রতি বছর প্রাণ হারাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ। এ ছাড়া আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে হাজার হাজার মানুষ দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন। যে মানুষটির উপার্জনে একদিন পরিবার চলতো দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়ে সেই এখন পরিবারের বোঝা। এসব পরিবারের কান্না কেউ শোনে না কেউ দেখে না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২১ হাজার ৩১৬ জন প্রাণ হারিয়েছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদফতরের হিসাব মতে, সারা দেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। ১৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে।
সংখ্যা যাই হোক, সড়কে মৃত্যু কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করে। এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নে অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০১৫ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এ ছয় বছরে সারা দেশে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত এবং ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন।
বাংলাদেশ ইনিশিয়েটিভ (বিআই) ও ড্রাইভার্স ট্রেনিং সেন্টার (ডিটিসি) যৌথভাবে আয়োজিত এক সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক সংলাপে গবেষণায় রিপোর্ট তুলে ধরে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর মো. হাদিউজ্জামান জানিয়েছেন, চলতি বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় আর্থিক ক্ষতি ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনায় ২০১৯ ও ২০২০ সালে ক্ষতি ৭০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এই টাকায় বেশ কয়েকটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব।
সড়ক নিরাপদ রাখতে অর্থাৎ সড়কে দুর্ঘটনা কমাতে প্রতিবছরই সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষে নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করা হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। সড়কে মৃত্যু বেড়েই চলছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়ক নিরাপদ করতে হলে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শুধু নিরাপদ দিবস পালন করলেই হবে না। বছরব্যাপী সচেতনতা কর্মসূচি চালু রাখতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, নিরাপদ সড়ক ব্যবহার সংক্রান্ত আলোচনা সভা, মসজিদ-মন্দির-গীর্জায় সড়ক দুর্ঘটনার ভয়াবহতা সংক্রান্ত আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করতে হবে। তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমানো সম্ভব হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সড়ক ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। এ জন্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ জরুরি। সড়কে যদি লাইসেন্সবিহীন চালক লাইসেন্সবিহীন গাড়ি চালায় তাহলেতো দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব নয়।
গত জুনে সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) প্রতিবেদনে বলা হয়, সারাদেশে সওজের সড়ক রয়েছে ২২.৫ হাজার কিলোমিটার। এর মধ্যে চার লেনের সড়ক ৫০০ কিলোমিটার এবং আট ও ছয় লেনের সড়ক মাত্র ৩৮ কিলোমিটার। এছাড়া তিন হাজার ৬৪৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা খারাপ এবং ৮৩৯ কিলোমিটার সড়কের ভয়াবহ দশা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৪৮ লাখ ৬৯ হাজার ৪৯০টি। এর মধ্যে মোটরসাইকেলই ৩৩ লাখ ৭৬ হাজার ২১৪টি। ঢাকায় রয়েছে ১৭ লাখ ৩৩ হাজার ১৯৩টি যানবাহন। এ নগরে মোটরসাইকেলের সংখ্যা আট লাখ ৬২ হাজার ৭৫৪টি। অবশ্য এই সংখ্যার বড় একটি অংশের লাইসেন্সের মেয়াদ নেই। আর লাইসেন্সবিহীন চালকের সংখ্যা ২৪ লাখেরও বেশি।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় পরিমাণগতভাবে আমাদের সড়ক বেশিই আছে। তবে গুণগত মানে আমরা অনেক পিছিয়ে। সড়কগুলো অপরিকল্পিত হওয়ায় প্রোডাক্টিভিটি অনেক নিচের দিকে। যে কারণে সংখ্যা যতই থাকুক, গুণগত মান না থাকায় তার প্রোডাক্টিভিটি নেই। সেখানে বড় কোনো উন্নয়ন করতে গেলেও তার প্রোডাক্টিভিটি পাওয়া যায় না। নিচের সড়কই যদি অপরিকল্পিত হয় পরবর্তী উপকরণগুলো বসাতে গেলে একই দুর্বলতার শিকার হতে হয়।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যু


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ