Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভিপিএম’র মাধ্যমে সরানো হচ্ছে লাখ লাখ টাকা

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৪ অক্টোবর, ২০২১, ১২:০৪ এএম

ভ্যালু পেয়েবল মানি অর্ডারের (ভিপিএম) মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে ডাক বিভাগ থেকে। কৃষকদের ভুয়া নাম-ঠিকানা ব্যবহার করে অভিনব কায়দায় হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এ অর্থ। সরকারি অর্থ সরিয়ে নেয়ার এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে ডাক বিভাগেরই একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রয়েছে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানা গেছে। দু’-একটি ঘটনা ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সিন্ডিকেটভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্ক হয়ে যায়। পরে নিজেরাই বাদী হয়ে তড়িঘড়ি মামলা রুজু করেন। চেষ্টা চলে উদোরপিন্ডি বুধোর ঘাড়ে দায় চাপানোর। অভ্যন্তরীণ তদন্তের নামেও করা হয় আইওয়াশ।

ডাক অফিদফতর সূত্র জানায়, ‘এরোলাইট এগ্রো লিমিটেড কোম্পানি’ নামক একটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা জিপিও থেকে সারা দেশে জৈবসার পাঠাতো পেয়েবল মানি অর্ডারের (ভিপিএম)র মাধ্যমে। গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের ৩২ নম্বর কক্ষ প্রতিষ্ঠানটি ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করতো। এটির কার্যক্রম চলত ঢাকা জিপিও থেকে। ‘প্রাপক’ হিসেবে উল্লেখিত অধিকাংশ ঠিকানাই ছিলো ভুয়া। জৈবসার সরবরাহকারী এরোলাইট এগ্রো লিমিটেড গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করত গোডাউন কাম হিসেবে। কক্ষের চেয়ার-টেবিল, আলমারি, ফ্যান-লাইট ব্যবহৃত হতো, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির অফিস হিসেবে।

কেপিআইভুক্ত ডাক অধিদফতরের এই ভবনে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানটির ৯ জন কর্মচারী রাত-দিন অবস্থান ও কাজ করত। ঢাকা জিপিও’র সিনিয়র পোস্ট মাস্টার খন্দকার শাহনূর সাব্বির, ডিপিএম ওবায়দুল হক, পরিদর্শক আনিসুর রহমানের সঙ্গে এরোলাইট এগ্রোর ছিল বিশেষসখ্যতা। পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন, এপিএম শিশির বিশ্বাস, এপিএম মাহবুব হক এবং মেইল শাখার এপিএম ইদ্রিস মজুমদারকে হাত করে এরোলাইট এগ্রো কক্ষগুলো নিজেদের মতো ব্যবহার করত। প্রতিষ্ঠানটির মালিক মো. ফজলুল হক। জানা গেছে, শাহনূর সাব্বিরেরও রয়েছে বেনামী ব্যবসা। ঢাকার শহরতলী সাভারে ‘আবেদা নার্সারি’ নামক প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করেন সাব্বিরের স্ত্রী।

গোপন সমঝোতার অংশ হিসেবে ওই নার্সারিতে ফজলুল হক বিনামূল্যে ট্রাক ট্রাক জৈবসার সরবরাহ করতেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সারা দেশে জৈব সার বহন ও বিতরণে। গোবর, কেঁচো, হাঁস-মুরগির বিষ্ঠা এবং মাটির মিশ্রণে তৈরি হয় জৈবসার। পচনশীল ও দুর্গন্ধযুক্ত কোনো বস্তুর পার্শ্বেল ডাক আইনে নিষিদ্ধ। নিষিদ্ধ এই বস্তু পরিবহন ও বিতরণে প্রবল আপত্তি তোলেন ডাক বিভাগের পোস্টম্যানরা। তারা সরকারি ভবন এরোলাইট এগ্রো নামক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করতে দেয়া নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। এ ঘটনায় পোস্টম্যান ও ডাক-কর্মচারী ইউনিয়ন এবং সিনিয়র পোস্ট মাস্টার খন্দকার শাহনূর মুখোমুখি অবস্থান নেন। এ প্রক্রিয়ায় তিনি ‘বাংলাদেশ পোস্টম্যান ও ডাক কর্মচারী ইউনিয়ন’র কার্যক্রম পরিচালনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

সংগঠনের গঠণতন্ত্র জমা দিতে বলেন। ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ‘এখতিয়ার বহিভর্‚তভাবে’ ঢাকা জিপিওর বিভিন্ন শাখায় দৈনন্দিন কাজ তদারকির অভিযোগ আনেন। এক পর্যায়ে ইউনিয়নের ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি মো. মাসুদ মিয়াকে সাময়িক বরখাস্ত হন। ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দও ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরের পোশাক সামগ্রিসহ ৭ দফার চলমান আন্দোলনের সঙ্গে খন্দকার শাহনূর সাব্বিরে অপসারণের দাবি তোলেন। পাল্টাপাল্টি ব্যবস্থা গ্রহণের ধারাবাহিকতায় গত বছর ২৩ জুলাই ঢাকা জিপিওতে জৈবসারের ভিপিএম’র বিপরীতে এক ব্যক্তি ৫০ হাজার টাকার প্রাপ্যতা দাবির বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে। নিয়ম অনুযায়ী, এ ধরনের ডকুমেন্ট দাখিল করা মাত্র দেশের যেকোনো পোস্ট অফিস দাবিকারীকে অর্থ পরিশোধে বাধ্য।

উক্ত প্রাপ্যতা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেন দায়িত্বরত অপারেটর। তিনি ঊর্ধ্বতনদের বিষয়টি অবহিত করেন। যাচাই করে দেখা যায়, প্রাপ্যতার দাবিটি ভুয়া। বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। এর কয়েকদিন পর ২৬ জুলাই একই ধরনের ডকুমেন্ট দেখিয়ে ভিপিএম’র বিপরীতে ২ লাখ টাকা দাবি করেন জনৈক বাশার। যাচাই করে দেখা যায়, ব্যবহৃত ভ্যালু পেয়েবল মানি অর্ডার ফরমটি ভুয়া। ‘এরোলাইট এগ্রো লিমিটেড’ নামক প্রতিষ্ঠানের জৈবসারের ভিপিএম’র বিপরীতে এই অর্থ তুলে নেয়ার চেষ্টা চলে। ঘটনা জানাজানি হয়ে যাওয়ার পর তড়িঘড়ি মামলা দায়ের করে ঢাকা জিপিও। ৩০ জুলাই পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেন।

এতে আসামি করা হয় এরোলাইটের মালিক মো. ফজলুল হক, তার স্ত্রী আসমা আক্তার শিলু এবং এরোলাইট কর্মচারী বাশারকে। ডাক বিভাগের কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করা হয়নি। মামলায় গ্রেফতার হওয়া ফজলুল হক, তার স্ত্রী এবং কর্মচারী বাশারের ‘স্বীকারোক্তি’র মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে পোস্টাল কর্মচারী ইউনিয়ন সংশ্লিষ্টদের নাম। বেছে বেছে তাদের নামই ‘আসামি’র তালিকায় যুক্ত হয়-যারা খন্দকার শাহনূর সাব্বিরের সমালোচক। ঘটনার নেপথ্য উদ্দেশ্য এতে স্পষ্ট হয়ে যায়। পরে অবশ্য মামলার সব আসামিই জামিনে বেরিয়ে আসেন। মামলাটি তদন্তের জন্য চলে যায় দুর্নীতি দমন কমিশনে।
মামলা দায়ের হলেও প্রশ্ন ওঠে ভুয়া ভিপিএম’ প্রক্রিয়ার দায়-দায়িত্ব নিয়ে। কারা রয়েছেন ভিপি ফরম বিতরণের দায়িত্বে? কাদের সহযোগিতায় এরোলাইট ঢাকা জিপিও থেকে পার্শ্বেল পাঠাত।
ডাক অধিদফতরের সূত্রটি জানায়, এরোলাইটের কথিত ভ্যালু পেয়েবল মানিঅর্ডার কেলেঙ্কারির সঙ্গে ঢাকা জিপিওর বেশ ক’জন কর্মকর্তা জড়িত। তাদের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতার খাতিরেই এরোলাইটকে ডাক ভবনের অফিস ব্যবহার করতে দেয়া হয়। এ ছাড়া এরোলাইটের জৈব সারের ভিপিএম’ এ যেসব ফরম ব্যবহৃত হয়েছে সেই জার্নাল বহিগুলো ইস্যু করেন এপিএম মাহবুব হক। বিধিবহিভর্‚তভাবে তিনি অন্তত ৬৭টি জার্নাল বহি এরোলাইটকে সরবরাহ করেন বলে জানা যায়। তার সরবরাহকৃত ভিপিএম ফরমে এরোলাইট অন্তত: ৭০ লাখ টাকা সরিয়ে নেয়। তবে নিরপেক্ষ কর্তৃপক্ষ দিয়ে রিকনসিলিয়েশন করলে হাতিয়ে নেয়ার অর্থের অঙ্ক কয়েক কোটিও হতে পারে বলে জানা গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে ভিপিএম ফরমে অর্থ তুলে নিলেও প্রকৃত দায়ীদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ কিংবা ফৌজদারি- কোনো ব্যবস্থাই নেয়া হয়নি। এরোলাইটের মতো প্রতিষ্ঠানকে প্রশ্রয় দিয়েছে, কারা প্রতিষ্ঠানটির হাতে জার্নাল বহি তুলে দিয়েছেÑ সেই প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। ব্যাপকভিত্তিক তদন্তের মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়া সরকারি অর্থ উদ্ধারের পরিবর্তে ঘটনাটি ব্যবহার করা হয়েছে কর্মকর্তা বিশেষের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা চরিতার্থের হাতিয়ার হিসেবে। এতে শুধু কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদের বিরোধই উস্কে দেয়া হয়নিÑ ধামাচাপা দেয়া হয়েছে গুরুতর একটি অপরাধকেও।
তবে প্রতিহিংসা চরিতার্থের বিষয়টি অস্বীকার করে ঢাকা জিপিও’র সিনিয়র পোস্ট মাস্টার খন্দকার শাহনূর সাব্বির ইনকিলাবকে বলেন, কারা কি অভিযোগ তুলেছে জানি না। পোস্টাল কর্মচারীরা বড় ধরনের রুলস ভঙ্গ করেছে। অভ্যন্তরীণ তদন্ত কমিটির কার্যক্রমকে ঘিরে তারা অন্য দফতরে চিঠি দিয়েছে। তিনি বলেন, ভিপিএম’র মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় ডাক বিভাগের কোনো কর্মচারীর বিরুদ্ধে আমরা মামলা করিনি। তবে বিভাগীয় মামলায় জড়িতদের আমরা জড়িতদের ছাড় দিইনি। ডাক বিভাগের যাদেরকে আসামি করা হয়েছে, গ্রেফতারকৃত আসামিরাই তাদের স্বীকারোক্তিতে সংশ্লিষ্টতার কথা জানিয়েছে। আমাদের সম্মতি নিয়ে র‌্যাব সদস্যরা ডাক কর্মচারীদের গ্রেফতার করে।

এরোলাইট এগ্রোর জৈবসার পার্শ্বেলের বিশেষ সুবিধা প্রদানের অভিযোগ অস্বীকার তিনি বলেন, ডোমেস্টিক পার্শ্বেলে মাটি বা এ জাতীয় জিনিসের পার্শ্বেল বহন নিষিদ্ধ করা নেই। আবার আইনে নেই কিন্তু ই-কমার্সের যুগে আমরা বহন করছি- এমন অনেক কিছুই রয়েছে। রুলস মানতে পারছি না। এরোলাইট এখানকার ক্লায়েন্ট ছিল। ক্লায়েন্ট হিসেবে তাদের যতটা সাপোর্ট দেয়ার ততোটাই দিয়েছি। জিপিও’র ভেতরে কোথায় এরোলাইটের গোডাউন-অফিস ছিল এসে দেখে যান।

এদিকে ভিপিএম’র মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা সম্পর্কে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রী মোস্তফা জব্বার গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে বলেন, ভিপিএম’র অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে যিনিই জড়িতÑ তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক এবং আইনগত দু’টো ব্যবস্থাই নেয়া হবে। এ বিষয়ে কাউকে কোনো ছাড় নয়। দুর্নীতি এবং সরকারি অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে আমাদের অবস্থান একেবারেই স্পষ্ট।

 



 

Show all comments
  • Muneer ৪ অক্টোবর, ২০২১, ৯:৩৭ এএম says : 0
    Nothing to say . 99% government worker are earning crafted,
    Total Reply(0) Reply
  • আনোয়ার হোসেন ৬ অক্টোবর, ২০২১, ২:০৯ পিএম says : 0
    এরোলাইট একটি বেসরকারী কোম্পানী হওয়া স্বর্তেও জিপিওতে গোডাউন করার অভিযোগ সত্য।শাহনুর সাব্বির একজন বিসিএস কর্মকর্তা হওয়ার পরেও তিনি এই কেলেংকারীতে নিজের দায় এড়িয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে ব্যস্ত।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডাক বিভাগ

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০
৩ নভেম্বর, ২০২০
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০
১৯ অক্টোবর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ