Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অবৈধ অর্থ বৈধকরণে বই প্রকাশ করেন ভদ্র

সরকারি কর্মচারী বিধি লঙ্ঘন সহযোগীদের ডাক বিভাগের তদন্ত কমিটি তথ্য সংগ্রহ করছে দুদক

বিশেষ সংবাদদাতা | প্রকাশের সময় : ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাস্তির মুখোমুখি ডাক অধিদফতরের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্র (এসএস ভদ্র)র সহোগীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ লক্ষ্যে তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে সংস্থাটি। এছাড়া ভদ্রের সহযোগীদের নানা অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয় খতিয়ে কমিটি করেছে ডাক অধিদফতরও। তবে সংশ্লিষ্ট ডাক কর্মকর্তা কেউই অর্থ লোপাটের দায় স্বীকার করছেন না। বরং উল্টো দায় চাপাতে চাইছেন ভদ্রের ওপরই।

গত ২৪ ডিসেম্বর দৈনিক ইনকিলাবে ‘ভদ্রের সহযোগীরা অধরা’ শীর্ষক প্রতিবেদন প্রকাশের পর তোলপাড় সৃষ্টি হয় ডাক অধিদফতর, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে। প্রতিবেদনে উল্লেখিত সহযোগীদের নাম ও ব্যক্তিগত সহায়-সম্পদের তথ্যে বিষ্মিত সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ডাক অধিদফতর। অন্যদিকে ভদ্রের বিরুদ্ধে চলমান অনুসন্ধানের সঙ্গে তার সহযোগীদের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করে দুদক। এছাড়া একাধিক গোয়েন্দা সংস্থাও উল্লেখিত দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে। সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ভীতসন্ত্রস্ত সংশ্লিষ্ট ডাক কর্মকর্তারা এখন দিগি¦দিক ছোটাছুটি করছেন। প্রমাণের চেষ্টা করছেন যে, তারা কেউ ভদ্রের সহযোগী নন- বরং বাধ্য হয়ে ভদ্রের নির্দেশনা প্রতিপালন করেছেন মাত্র। নিজেদের বাঁচাতে বিভিন্ন পর্যায়ে তারা দৌড়-ঝাঁপ শুরু করেছেন। তাদের মাঝে নেমে এসেছে আতঙ্ক। এদের কেউ কেউ সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালা-১৯৭৯ এর বিধিমালা ভঙ্গ করে সরাসরি কথা বলতেও শুরু করেছেন। আত্মপক্ষ সমর্থন এবং সাফাই গেয়ে প্রতিবাদের নামে বিবৃতিও দিচ্ছেন কেউ কেউ। যদিও ডাক অধিদফতর প্রতিবেদনের কোনো প্রতিবাদ পাঠায়নি। ব্যক্তিগতভাবে পাঠানো এসব ‘প্রতিবাদ’ এ ডাক কর্তৃপক্ষের কোনো স্মারক-স্বাক্ষর নেই। অথচ প্রতিবেদনটি প্রকাশের আগে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন। এ সময় তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারী বিধিমালার দোহাই দিয়ে কথা বলতেও রাজী হননি। কেউ বা এসএস ভদ্রের দুর্নীতির সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকারও করেন। প্রতিবেদক তাদের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোন কল করলে, ক্ষুদে বার্তা পাঠালে তাতে ভ্রুপেক্ষ করেননি। কিন্তু তাদের কার্যক্রম বিষয়ে প্রতিবেদেন প্রকাশের পর তারা কর্তৃপক্ষের কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়া প্রতিবাদ পাঠান। ভদ্রের সহযোগী নির্বাহী প্রকৌশলী শামীমুর রাজী, পরিকল্পনা-১ এর শাখা কর্মকর্তা শংকর কুমার চক্রবর্তী, ডিপিএমজি মোস্তাক আহমেদ এবং সহকারী প্রকল্প পরিচালক মো.শাহ আলম ভুঁইয়া পৃথকভাবে প্রতিবাদ পাঠান। প্রতিবাদে শামীমুর রাজী দাবি করেন, তিনি কখনোই ভদ্র বাবুর সহযোগী নন। অন্যান্য কর্মকর্তার ন্যায় তিনিও দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেছেন মাত্র।

শংকর কুমার চক্রবর্তী তার প্রতিবাদে চিকিৎসা ভিসায় সস্ত্রীক একাধিকবার ভারত সফর করেছেন মর্মে স্বীকার করেন। ‘ইসকন’ সদস্য নন- বলেও দাবি করেন তিনি। এসএস ভদ্রের দুর্নীতির সহযোগী ছিলেন-এ তথ্যের তিনি কোনো দ্বি-মত পোষণ করেননি। শংকর ডাক বিভাগের ছোট-বড় অন্ততঃ ২৮টি প্রকল্পের মূল্যায়ণ কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন বলেও জানা গেছে। মোস্তাক আহমেদ দাবি করেন, ঢাকার শাহীনবাগে আমার ৪ তলা পৈত্রিক বাড়ি রয়েছে। এটি ১৯৮২ সালে হাউজ বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশন থেকে ঋণ নিয়ে করা।

মেইল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার নির্মাণ প্রকল্পের সহকাীর প্রকল্প পরিচালক মো.শাহ আলম ভুঁইয়া প্রতিবাদে দাবি করেন, প্রকাশিত সংবাদটি উদ্দেশ্য প্রণোদিত। পোস্টাল ক্যাডার ২৫তম ব্যাচে ১০ কর্মকর্তার মধ্যে তার অবস্থান সপ্তম। ৩০টি নয়-১১টি দেশ ভ্রমণ করেছেন তিনি। ‘আইপিএস. পোস্ট’, ‘সিডিএস পোস্ট, পোস্ট ই.কমার্স প্রবর্তনে শাহ আলম ভুঁইয়া সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। মেইল প্রসেসিং সেন্টার প্রকল্প’র তিনি ডিপিডি নন-এপিডি। ‘ডক ইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লি:’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। এ ক্ষেত্রে ‘ম্যানেজ করা’র কিছু নেই মর্মে তিনি দাবি করেন।

এদিকে সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ব্যক্তিগতভাবে পাঠানো ‘প্রতিবাদ’কে সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালা-১৯৭৮ পরিপন্থি বলে জানিয়েছেন ডাক অধিদফতরের সাবেক এক মহাপরিচালক। নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে ওই মহাপরিচালক বলেন, এই প্রতিবাদতো করার কথা ডাক অধিদফতরের। অধিদফতরের পূর্বানুমোদন ছাড়া তারা গণমাধ্যমে কি করে প্রতিবাদ দিলেন? শুধুমাত্র এ কারণেই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধিমালার বিধি ২৮’র অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। কারণ, এ বিধিতে স্পষ্টই উল্লেখ রয়েছে, ‘একজন সরকারি কর্মচারী সরকারের পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে তৎকর্তৃক জনস্বার্থে কৃত কাজ ও আচরণের মানহানিকর আক্রমণের বিরুদ্ধে আদালত বা সংবাদ মাধ্যমে প্রতিকার চাইতে পারেন না।’

এদিকে ডাক অধিদফতর সূত্র জানায়, ২৪ ডিসেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশের পর ডাক বিভাগে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। বিষয়টি তদন্ত করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে একটি কমিটি গঠন করে ডাক অধিদফতর। পরিচালক (তদন্ত) মো. ইউনূসের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার থেকে কার্যক্রম শুরু করেছে। কমিটির অপর সদস্য নির্বাহী প্রকৌশলী আনজীর আহমেদ। তদন্ত শেষে তাদের অবিলম্বে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।

অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্র জানায়, প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাটকারী এসএস ভদ্রের সহযোগীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে সংস্থাটি। এ প্রক্রিয়ায় ভদ্রের বহুমাত্রিক দুর্নীতি এবং অর্থ আত্মসাতের আরও তথ্য তদন্ত কমিটির হস্তগত হয়েছে।

সূত্রমতে, এসএস ভদ্র অবৈধভাবে অর্জিত অর্থের বৈধতা দিতে বেশ কিছু বই প্রকাশ করেন। বাংলা-ইংরেজিতে প্রকাশিত এসব বইয়ের পেছনে তিনি ‘খরচ’ দেখান লাখ লাখ টাকা। ‘ডাক ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ, পোস্টাল পেডিয়া-১’এর মূল্য ধরা হয় ১৫শ’ টাকা। ‘ওয়ার্ল্ড পোস্টাল হিস্টোরি, পোস্টালপেডিয়া-২’ নামক বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ১৫শ’ টাকা। এ ধরনের বেশকিছু প্রকাশনা রয়েছে সুধাংশু শেখর ভদ্র’র। কিন্তু বইগুলো বেশিরভাগই গুগল থেকে নেয়া এবং ‘কপি পেস্ট’ বলে জানা গেছে। বইগুলো মৌলিক না হওয়ায় তেমন একটা বিক্রি হয় না। বইগুলো তিনি ফ্রি ডিস্ট্রিবিউট করেন বলে জানা গেছে। অথচ আয়কর নথিতে বই থেকে লাখ লাখ টাকা ‘রয়্যালিটি’ পেয়েছেন মর্মে উল্লেখ করেন। এ বিষয়টিও দুদক খতিয়ে দেখছে।

জানা গেছে, ভদ্রের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অনুসন্ধানও এখন শেষ পর্যায়ে। নতুন বছরের শুরুর দিকেই তার বিরুদ্ধে দায়ের হতে পারে মামলা। অনুসন্ধান প্রক্রিয়ায় ইতিমধ্যেই ভদ্রকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বিদেশ গমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তার ঘনিষ্ঠ অধিনস্থ পরিদর্শক রাবেয়া খাতুনেরও সম্পদ অনুসন্ধান চলছে। বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে তার ওপরও। এরই ধারাবাহিকতায় ভদ্রের দুর্নীতির অপর সহযোগীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে বলে জানায় সূত্রটি। এ বিষয়ে সংস্থার পরিচালক (জনসংযোগ) প্রণব ভট্টাচার্য বলেন, দুর্নীতির তথ্য পেলে দুদক সেটি অনুসন্ধান করবে। কাউকেই ছাড় দেবে না।



 

Show all comments
  • Nizam Uddin Chowdhury ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৪ এএম says : 0
    দেশ টা ওহ একদিন খেয়ে পেলবে এরা দূর্নীতি আর দূর্নীতি চুরি আর চুরি
    Total Reply(0) Reply
  • MD Khalid Hasan ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৬ এএম says : 0
    ভদ্র বাবুকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেওয়া হোক। না হলে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার রিস্ক আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • মোঃ আল-আমিন ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৬ এএম says : 0
    এই ভদ্র দেশের মাত্র ৫৪০ কোটি টাকা লুট করেছে!
    Total Reply(0) Reply
  • Abdul Mukith ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৮ এএম says : 0
    এই টাকা নিয়ে কোথায় রেখেছে তা খুঁজে বের করতে হবে।
    Total Reply(0) Reply
  • Dipankar Roy Dev ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৮ এএম says : 0
    ডাক বিভাগের অবনতির মূল কারণ সব জায়গায় দূর্নীতি।
    Total Reply(0) Reply
  • Nazrul Islam ৩০ ডিসেম্বর, ২০২০, ২:৪৮ এএম says : 0
    ওকে নজরদারি তে রাখা দরকার, যেন পালাতে না পারে।পি কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। শীর্ষ পদে নিযুক্ত এর ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন জরুরী।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ডাক বিভাগ

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০
৩ নভেম্বর, ২০২০
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০
১৯ অক্টোবর, ২০১৮

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ