পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা এবং মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় সংস্থানের জন্য সরকারকে আভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ গ্রহণ করতে হয়। এ কারণে প্রতি বছর জাতীয় বাজেটের একটা বড় অংশই দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে ব্যয় করতে হয়। তবে ক্রমবর্ধমান হারে বৈদেশিক ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার বাস্তবতা নাগরিক হিসেবে আমাদের জন্য উদ্বেগজনক। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রত্যেক নাগরিকের উপর মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমান প্রায় ২৫ হাজার টাকা। গত বুধবার জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে জবাব দিতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সংসদকে জানান, প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যা হিসেবে বর্তমানে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উপর বৈদেশিক ঋণের পরিমান ২৯২ ডলারের বেশি। ডলারের মূল্য ৮৫.২১ টাকার হিসাবে যার অঙ্ক দাঁড়ায় ২৪ হাজার ৮৯০.৬৯ টাকা। তবে আভ্যন্তরীণ ঋণের হিসাব যোগ করলে দেশের প্রত্যেক নাগরিকের উপর ঋণের পরিমান দাঁড়াবে লাখ টাকার কাছাকাছি। আভ্যন্তরীন ও বৈদেশিক দুই খাতেই সরকারের ঋণের হার খুব দ্রুত বেড়ে চলেছে। ঋণের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। তবে জনগণের উপর ঋণের বোঝা বাড়িয়ে উন্নয়নের নামে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে সংশ্লিষ্টদের দুর্নীতি, অপচয় ও লুটপাটের দায় অনেক বেশি।
সুদভিত্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও ব্যাংকিং সেক্টরের উপর জনগণ বা সরকারের নিয়ন্ত্রণ নেই বললেই চলে। কর্পোরেট ব্যাংকিং ব্যবস্থায় মার্কিন ডলারসহ প্রধান মুদ্রাগুলোর নিয়ন্ত্রণের নামে এক ধরণের অস্বচ্ছতা ও গোঁজামিলের ব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। বৈদেশিক ঋণের আন্তর্জাতিক চার্ট খেয়াল করলে দেখা যায়, অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোই বেশি ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে ভ‚-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণসহ নানাবিধ সংযোগের কারণে পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর উপর খুব বেশি চাপ না থাকলেও আমাদের মত দুর্বল ও ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশের জন্য বৈদেশিক ঋণ বড় ধরণের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বড় বড় মেগা প্রকল্পের বড় অংকের বৈদেশিক ঋণ গ্রহণ করে যে সব অবকাঠামো নির্মান করা হয়, দেশের উৎপাদন ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন খাতে তার যথাযথ ব্যবহার ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নিশ্চিত করতে না পারলে বৈদেশিক ঋণ দেশের মানুষের জন্য অনেক বড় দায় হিসেবে আবির্ভুত হতে পারে। সমুদ্র বন্দর, রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের মত বৃহদাকৃতির অবকাঠামো উন্নয়ন খাতের জন্য ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে অবকাঠামোসহ দেশের মূল্যবান সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ হাতাছাড়া হয়ে যাওয়ার উদাহরণও বিভিন্ন দেশে রয়েছে।
সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতা প্রসঙ্গে গতকাল প্রকাশিত রিপোের্ট জানা যায়, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার সাথে সম্পাদিত প্রায় ৯৬ হাজার মিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তির মধ্যে ইতিমধ্যে ৫৯ হাজার ৫৫৮ মিলিয়ন ডলার ছাড় হয়েছে। এখনো বৈদেশিক ঋণের আরো ৪৬ হাজার ৪৫০ মিলিয়ন ডলার ছাড়ের অপেক্ষায় রয়েছে। এসব অর্থ ছাড় হলে দেশের মানুষের বৈদেশিক ঋণের পরিমান বর্তমান অংকের প্রায় দ্বিগুণ আকারে দাঁড়াবে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুসারে ২০১৬ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশি নাগরিকদের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণের পরিমান ছিল ১৬০ ডলার, যা জিডিপির হারে শতকরা ১২ শতাংশ। গত ৫ বছরে তা বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে এবং আগামী ৫ বছরে তা জ্যামিতিক হারে দ্বিগুণ বা তারো বেশি হবে। শুধু বৈদেশিত ঋণেই নয়, আভ্যন্তরীণ ব্যাংকিং সেক্টর ও সঞ্চয়পত্র থেকে বিপুল পরিমান ঋণগ্রহণের ফলে একদিকে সুদের বোঝা টানতেই একক খাত হিসেবে জাতীয় বাজেটের সর্বোচ্চ অংকের টাকা চলে যাচ্ছে, অন্যদিকে বেসরকারি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নানামাত্রিক সংকট দেখা দিচ্ছে। শত শত কোটি ডলার ঋণ নিয়ে বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে সময়মত বাস্তবায়ন করতে না পারায় অস্বাভাবিক হারে খরচ বেড়ে যাওয়ার ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে কন্ট্রাক্টর, আমলা-ইঞ্জিনিয়ারসহ সংশ্লিষ্টরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়ে বিদেশে টাকা পাচার করে দিলেও এসব টাকার ঋণভার সাধারণ মানুষের উপর বর্তাচ্ছে। বিশ্বে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে সর্বনিম্ম মানের অবকাঠামো নির্মান করছি আমরা। বলা হয়ে থাকে, যোগাযোগ অবকাঠামোসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এর সুফল জনগণ ভোগ করবে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কিন্তু তিন বছরের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যদি ১০ বছর লেগে যায় এবং একইহারে খরচ বাড়ার কারণে একেকটি প্রকল্প একদিকে বছরের পর বছর ধরে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করছে অন্যদিকে দেশের মানুষের উপর ঋণের চাপ বাড়াচ্ছে। দেশি-বিদেশি ঋণ নিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করার আগে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা ও লুটপাটের সুযোগ চিরতরে বন্ধ করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।