Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কবে, কার কাছ থেকে প্রথম স্বীকৃতি পাবে তালেবান সরকার?

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ৩:৫৯ পিএম

আফগানিস্তানে তালেবানের সরকার গঠনের পাঁচ দিনের মাথায় অর্থাৎ গত রোববার কাবুল সফরে যান কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান আল থানি এবং এরপর তিনি আফগান প্রধানমন্ত্রী মোল্লাহ হাসান আখুন্দের সাথে একটি বৈঠক করেন। কিন্তু দোহায় ফিরে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নে কাতারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়ে দেন যে, তালেবানের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার সময় এখনও আসেনি।

অন্যদিকে, তালেবানকে যে দেশটির সবচেয়ে মদতপুষ্ট বলে মনে করা হয়, নতুন কাবুল সরকার নিয়ে সেই পাকিস্তানের ভূমিকাও অস্পষ্ট। পাকিস্তানের সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর প্রধান লে. জেনারেল ফায়েজ হামিদ গত সপ্তাহে কয়েকদিন কাবুলে ছিলেন। এরই মধ্যে বিমান বোঝাই করে আফগানিস্তানে খাবার এবং ওষুধ পাঠিয়েছে পাকিস্তান। সোমবার পাকিস্তানের জাতীয় বিমান সংস্থা পিআইএ-র একটি বিমান কাবুলে নেমে যাত্রী নিয়ে এসেছে এবং ইঙ্গিত দিয়েছে যে এখন থেকে নিয়মিত এই রুটে বিমান চলবে। কিন্তু তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির প্রশ্নে ইসলামাবাদ এখনও চুপ।

ওদিকে, চীন তালেবানের কাবুল দখলের খোলাখুলি তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। তালেবান সরকার গঠনের পরদিনই অর্থাৎ বুধবার তারা তালেবান সরকারকে স্বাগত জানিয়েছে। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েন বিন একে ‘অরাজকতা’ বন্ধের জন্য একটি ‘প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ’ বলে বর্ণনা করেন। ‘কাবুলে চীনা দূতাবাস সচল। আমরা নতুন আফগান সরকার এবং তাদের নেতাদের সাথে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে প্রস্তুত,’ বলেন তিনি। যেভাবে তালেবান সরকার গঠন করেছে বা সেই সরকার এখন পর্যন্ত যেভাবে আচরণ করছে, তা নিয়ে বিন্দুমাত্র কোনো কথা চীন বলেনি। অনেক পর্যবেক্ষক একে তালেবানের প্রতি পরোক্ষ স্বীকৃতি হিসাবে দেখলেও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির দিনক্ষণের কোন ইঙ্গিত চীন দেয়নি।

লন্ডনে আফগান সাংবাদিক এবং আফগানিস্তানের রাজনীতির বিশ্লেষক সাইয়েদ আব্দুল্লাহ নিজামী বলেন, কয়েকটি দেশ - বিশেষ করে কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই), চীন ও পাকিস্তান - তালেবানের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে, কিন্তু আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কোন প্রতিশ্রুতি এখনও তারা দিচ্ছে না। ‘দেখে মনে হচ্ছে একটি দেশ যেন আরেকটি দেশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তারা কী করে। একজন সিদ্ধান্ত নিলেই আরেকটি এগুবে। পাকিস্তান তাকিয়ে চীনের দিকে, চীন হয়তো দেখছে পাকিস্তান কী করে। উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান চেয়ে আছে সম্ভবত রাশিয়ার দিকে,’ বলেন নিজামী।

আর যে সউদী আরব বাকি বিশ্বের তোয়াক্কা না করে ১৯৯৬ সালে তালেবানকে স্বীকৃতি দিয়েছিল, এবার তারা তালেবানের কাবুল দখলের পর একটি কথাও বলেনি। কাতারের সাথে তালেবানের দহরম মহরম হয়তো সউদীদের পছন্দ নয়। ১৯৯৬ সালে তালেবান কাবুল দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ওই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়। আবার পাকিস্তানই দেন-দরবার করে তালেবানের জন্য সউদী আরব এবং ইউএই-র স্বীকৃতি আদায় করেছিল। কিন্তু এবার তালেবানের কাবুল দখলের এক মাস পরও স্বীকৃতি দেয়ার প্রশ্নে ইসলামাবাদ এখনও চুপ।

‘পাকিস্তান তাড়াহুড়ো করতে চাইছে না। তারা এবার একা কিছু করতে চায় না। অন্য আরও দশ-পাঁচ জনের সাথে মিলে সিদ্ধান্ত নিতে চায়, আফগান এবং তালেবানের প্রশ্নে কমপক্ষে আঞ্চলিক একটি ঐক্য চাইছে তারা।’ বিবিসিকে বলেন ইসলামাবাদে রাজনৈতিক বিশ্লেষক হাসান আসকারি রিজভী। সম্ভবত সে কারণেই পাকিস্তানের উদ্যোগে বুধবার চীন, রাশিয়া, পাকিস্তান, ইরান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একটি বৈঠক করেছেন। দু'দিন পর শনিবার আবারও পাকিস্তানের উদ্যোগেই এসব দেশের গোয়েন্দা প্রধানরা একটি বৈঠক করেন বলে পাকিস্তানের নির্ভরযোগ্য ইংরেজি দৈনিক ডন খবর দিয়েছে। আমেরিকার সাথেও গোপনে পাকিস্তান কথা বলছে বলে ডনের খবরে বলা হয়েছে।

তালেবান সরকার গঠনের পর একমাত্র যে দেশটি খোলাখুলি অভিনন্দন জানিয়েছে, সেটি চীন। গত সপ্তাহে চীন আফগানিস্তানের জন্য তিন কোটি মার্কিন ডলারের জরুরী খাদ্য এবং ওষুধ দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। আফগানিস্তানে বিনিয়োগ নিয়ে দোহায় তালেবান প্রতিনিধিদের সাথে গত সপ্তাহে চীনাদের কথা হয়েছে বলে জানা গেছে। অনেক বিশেষজ্ঞ তাই বলছেন যে তালেবান সরকারের প্রতি পাকিস্তান, চীন বা কাতারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি অনেকটাই এখন অপ্রাসঙ্গিক, কারণ সম্পর্ক শুরু হয়ে গেছে।

তবে বৈধতা এবং আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য তালেবান উন্মুখ হয়ে পড়েছে। তারা মনে করছে, সরকার পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেশের, বিশেষ করে প্রতিবেশী কিছু দেশের স্বীকৃতি জরুরী। ‘রোববারও টেলিফোনে তালেবানের সিনিয়র মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের সাথে আমার কথা হয়েছে। বৈধতা এবং স্বীকৃতির জন্য তালেবান উন্মুখ,’ বলেন সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাইয়েদ নিজামী। তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মৌলভী আমির খান মুত্ত্বাকি দু'দিন আগে আফগান কূটনীতিকদের বিদেশী মিশনগুলোতে কাজে যোগ দিতে বলেছেন, কিন্তু আফগান দূতাবাসগুলো এখন কার্যত অচল।

‘এমনকি লন্ডন এবং ওয়াশিংটনেও আফগান দূতাবাসে কোন কূটনৈতিক তৎপরতা নেই। বলতে গেলে বন্ধ। ইসলামাবাদে দূতাবাস সচল। আবার তাজিকিস্তান এবং ইতালিতে আফগান রাষ্ট্রদূতরা তাদের ইচ্ছামত তালেবান বিরোধীদের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। অরাজকতা চলছে,’ বলেন নিজামী। তিনি আরও বলেন, ‘মানবিক সাহায্যের আশ্বাস থাকলেও কাবুলের সরকারের হাতে নগদ টাকা নেই। বিদেশের সাথে ব্যাংকিং কাজ করছে না। অনেক সরকারি কর্মচারী কাজে ফিরলেও বেতন পাচ্ছেন না। কবে পাবেন, তা নিয়েও চরম অনিশ্চয়তা রয়েছে।’

জাতিসংঘের হিসাবে আফগানিস্তানের অর্ধেক মানুষ মানবিক বিপর্যয়ের হুমকির মুখে রয়েছে। কারণ, গত আফগানিস্তান ২০ বছর ধরে আমেরিকা এবং পশ্চিমা যে সাহায্যের ওপর ভর করে ছিল, তা রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক মানুষের কাছে খাবার কেনার টাকাও নেই। জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা বলছে, দ্রুত ত্রাণ এবং সাহায্য না গেলে ৯৭ শতাংশ আফগান দারিদ্র সীমার নীচে চলে যেতে পারে, যে হার এখন ৭২ শতাংশ। বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে রয়টার্স বার্তা সংস্থা বলেছে, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর পশ্চিমা দেশগুলোতে, বিশেষ করে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভে, আফগানিস্তানের প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলার (১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার) আটকা পড়েছে। পাশাপাশি, এ মাসেই আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে জরুরি ঋণ হিসাবে ৪০ কোটি ডলার পাওয়ার কথা ছিল আফগানিস্তানের, যা স্থগিত করে দেয়া হয়েছে।

আটকে দেয়া এসব টাকা এখন তালেবানের ওপর প্রভাব খাটানোর জন্য আমেরিকা এবং তার পশ্চিমা মিত্রদের প্রধান অস্ত্র। তালেবানের জন্য একমাত্র আশার কথা আমেরিকা এবং তাদের সিংহভাগ পশ্চিমা মিত্র এখনও তালেবানের সাথে সম্পর্ক পুরোপুরি নাকচ করছে না। ফ্রান্স এবং ডেনমার্ক ছাড়া কোন দেশই বলেনি যে তালেবানকে কখনই তারা মেনে নেবে না। তবে মানবাধিকার ও নারী অধিকার নিশ্চিত করা এবং আইএস ও আল-কায়েদার মত গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দেওয়ার শর্ত আরোপ করছে তারা। তবে এসব নিয়ে বেশি চাপাচাপি করলে তালেবান চীন ও রাশিয়ার পুরোপুরি মুখাপেক্ষী হতে পারে, এ ভয়ও পশ্চিমা দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে। এ কারণেই হয়তো আমেরিকা বলছে যে তারা আফগানিস্তানে মানবিক সাহায্য অব্যাহত রাখবে, তবে সেই সাহায্য যাবে শুধুমাত্র জাতিসংঘ এবং এনজিও-র মাধ্যমে।

সোমবার জেনেভাতে জাতিসংঘের উদ্যোগে আফগানিস্তানের জন্য জরুরী তহবিল সংগ্রহের জন্য আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে ১০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে। এটি ধারণা দিচ্ছে যে পশ্চিমা সরকারগুলো হয়তো তালেবানের সামনে দরজা পুরোপুরি বন্ধ করতে চাইছে না। তবে এই তহবিলের সাথে মানবাধিকার, নারী অধিকার শর্ত জুড়ে দেয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। তবে বৈধতা এবং স্বীকৃতি পেতে তালেবানের আসল পরীক্ষা হবে সন্ত্রাস নিয়ে তাদের অবস্থানের ওপর। কারণ শুধু আমেরিকা নয়, এই ইস্যুতে চীন, রাশিয়া এমনকি পাকিস্তানও কমবেশি উদ্বিগ্ন।

পাকিস্তান চায় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি - যা পাকিস্তান তালেবান নামে পরিচিত) নেতাদের ধরে তাদের হাতে তুলে দেয়া হোক। চীন চায় শিনজিয়াংয়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ইটিআইএম-কে আফগানিস্তান থেকে হটাতে হবে। অন্যদিকে, আরেক প্রতিবেশী ইরান চায় আইএস এবং আল-কায়েদা যেন আফগানিস্তানে না থাকে। আর রাশিয়া এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর চাওয়া হলো, আইএস-কে (ইসলামিক স্টেট-খোরাসান) যেন কোনওভাবেই আফগানিস্তানে প্রশ্রয় না পায়। সুতরাং এক মাস আগে কাবুল দখল তালেবানের জন্য যত সহজ ছিল, বৈধতা অর্জন ও দেশ শাসন করা হবে ততটাই জটিল এবং কঠিন। সূত্র: বিবিসি বাংলা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ