Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১, ১২:০২ এএম

দেশে বেশির ভাগ পণ্যের মূল্য অত্যধিক। এর মধ্যে খাদ্যদ্রব্যের মূল্য সর্বাধিক। করোনা মহামারিতে অনেক মানুষের আয় হ্রাস পেয়েছে। ফলে তাদের সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে! বহু মানুষ খাদ্য গ্রহণ কমিয়ে দিয়েছে। এই দুর্দশা থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়ার জন্য মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল টিসিবি’র ট্রাক সেলে। সেখানে নারী-পুরুষ-শিশু, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত নির্বিশেষে সকলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল প্রচন্ড রোদ ও ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও। এমনকি বৃষ্টিতেও। দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ঘাড়ে নিয়ে মায়ের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার চিত্র বড়ই হৃদয়বিদারক ছিল! তবুও মানুষ এই নিদারুণ কষ্ট সহ্য করেছিল কিছু সাশ্রয়ের জন্য। কিন্তু সেটাও শেষ হয়ে গেছে। টিসিবি’র ট্রাক সেল আর দেখা যায় না। মানুষের আকাক্সক্ষা কিন্তু অব্যাহত আছে। পণ্যমূল্য অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ার জন্য দায়ী অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা তথা মধ্যস্বত্বভোগীরা। তারাই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি ঘটিয়ে লাভের সিংহভাগ গ্রাস করছে। তাতে পণ্য উৎপাদনকারীরা যেমন চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অভিমত, কৃষিপণ্যের মুনাফার ৮০% ভোগ করে মধ্যস্বত্বভোগীরা বলে। স¤প্রতি প্রকাশিত খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ‘মনিটরিং রিপোর্ট ২০২১: বাংলাদেশ সেকেন্ড কান্ট্রি ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান নিউট্রিশন সেনসিটিভ ফুড সিস্টেম ২০১৬-২০২০’ শীর্ষক প্রতিবেদন মতে, ‘সবজির উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ায় মোট মুনাফার বণ্টনে কৃষকের প্রাপ্তি সাকুল্যে এক পঞ্চমাংশও নয়। বাকি মুনাফার পুরোটাই ভোগ করছে মধ্যস্বত্বভোগী ট্রেডার বা ফড়িয়া, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।’ এই অবস্থা শুধুমাত্র সবজীর ক্ষেত্রেই নয়, কৃষি পণ্যের সব ক্ষেত্রেই। এমনকি অন্য সব পণ্যের ক্ষেত্রেও। উপরন্তু ব্যবসায়ীরা নকল ও ভেজাল পণ্য বিক্রি করে মানুষের চরম ক্ষতি করছে। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি শুধুমাত্র ইদানিং হচ্ছে তা নয়, দীর্ঘকাল থেকেই হচ্ছে! অথচ অতিরিক্ত মুনাফার বিরুদ্ধে, মজুদদারির বিরুদ্ধে, নকল ও ভেজালের বিরুদ্ধে বহু আইন আছে এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্য সরকারি লোকবল আছে। উপরন্তু ভোক্তা অধিকার প্রতিষ্ঠান ও আইন আছে। কিন্তু কোনটিই সঠিকভাবে কাজ করছে না। তাই পণ্যমূল্য ও নকল-ভেজাল বেড়েই চলেছে। ব্যবসায়ীরা ক্রেতার নিকট থেকে আদায়কৃত ভ্যাটও সরকারি খাতে জমা দেয় না ৮৮%। অধিকাংশ ব্যবসায়ী ভ্যাট নিবন্ধনও করেনি বলে এনবিআর সূত্রে প্রকাশ। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির নিবন্ধনকৃত দোকানের সংখ্যা ৩০ লাখ। এর মধ্যে ভ্যাট নিবন্ধনযোগ্য (বার্ষিক টার্নওভার ৫ কোটি টাকা ও তদূর্ধ্ব) দোকানের মাত্র ১% দোকানে ইএফডি মেশিন দিয়েছে এনবিআর বলে খবরে প্রকাশ। নানা কারণে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হচ্ছে না। প্রয়োজনীয় ইএফডি মেশিন সরবরাহ করতে পারলে সরকারের রাজস্ব বাড়তো। পণ্য উৎপাদনকারী ও ভোক্তার মধ্যে যদি সরাসরি সংযোগ ঘটানো যেত, তাহলে, উৎপাদক ও ভোক্তারা মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা পেত।

অবশ্য উৎপাদক ও ভোক্তার মধ্যে সরাসরি সংযোগ ঘটানোর কার্যক্রম স¤প্রতি শুরু হয়েছে ‘সদাই’ অ্যাপ-এর মাধ্যমে। যুগান্তকারী এই অ্যাপটি পরিচালিত হবে সরকারি প্রতিষ্ঠান-কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মাধ্যমে। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত ৪ আগস্ট ‘সদাই’ অ্যাপের কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। এটি সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রথম কৃষি বিপণন অ্যাপ। এর ভাষা বাংলা। এর মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তার সরাসরি যোগাযোগ হবে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর ‘সদাই’ প্ল্যাটফর্মে লেনদেন হওয়া কৃষিপণ্যের গুণগত মান ও ক্রয়-বিক্রয় মনিটর করবে। পণ্যগুলোর উপযুক্ত দাম নির্ধারণ করবে। প্রয়োজনে উদ্যোক্তার নিবন্ধন বাতিল করবে। অভিযোগ প্রতিকারের ব্যবস্থা ও অধিদপ্তর পরিচালিত কল সেন্টারে থাকবে। কৃষক ও উদ্যোক্তারা ফ্রি রেজিস্ট্রেশন করে কমিশনবিহীন বিক্রির সুযোগ পাবে। মোবাইল ব্যাংকিং পেমেন্ট এবং ক্যাশ অন ডেলিভারি পেমেন্টের সুযোগ থাকবে। মূল্য যাচাইয়ের সুযোগ ও অর্ডারকৃত পণ্যের ট্র্যাকিং সুবিধা রয়েছে। অধিদপ্তর কৃষক ও উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করবে। ক্ষেত্র বিশেষে কৃষিপণ্য পরিবহন সুবিধা পাওয়া যাবে। অধিদপ্তর সদাই সংক্রান্ত ওয়েবসাইটও চালু করেছে। সদাই প্ল্যাটফর্মটি তৈরি করেছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান বাংলা পাজেল লিমিটেড। দু’টি অ্যাপের মাধ্যমে প্ল্যাটফর্মটি পরিচালিত হচ্ছে। ক্রেতাদের জন্য ‘সদাই’ আর উদ্যোক্তাদের জন্য ‘সদাই উদ্যোক্তা’ অ্যাপ। বিভিন্ন জেলায় সদাই অ্যাপের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। উদ্যোক্তারা হোম ডেলিভারি করছে। দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী সদাই অ্যাপটি খুবই কল্যাণকর। কারণ, এটি দেশব্যাপী সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে কৃষকের ফসল বিক্রি নিশ্চিত হবে। ন্যায্যমূল্যও পাবে। ফলে তাদের আর্থিক উন্নতি হবে। এছাড়া, ভোক্তারা স্বল্প মূল্যে নির্ভেজাল খাদ্যপণ্য পেয়ে লাভবান হবে। তাই কৃষক ও ভোক্তাদের সদাই অ্যাপে সংশ্লিষ্ট হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে ব্যাপক প্রচারণা চালোনো দরকার। সেই সাথে সদাই অ্যাপ নিয়ে যেন বিভিন্ন অনলাইন ব্যবসার মতো প্রতারণা শুরু না হয়, সেদিকে কড়া নজর রাখা প্রয়োজন।

অবশ্য সদাই অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যাও রয়েছে, যার অন্যতম হচ্ছে: গ্রামাঞ্চলের বেশির ভাগ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার করার মতো কম্পিউটার ও স্মার্ট ফোন নেই। আবার যাদের এসব সুবিধা আছে, তারাও ইন্টারনেটের স্বল্পতা, ধীর গতি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যে ব্যয় অত্যধিক হওয়ায় ব্যবহার তেমন করে না। সরকার কর্তৃক ‘এক দেশ, এক রেট’ কর্মসূচির আওতায় ৫০০ টাকায় সারা মাসের ইন্টারনেট সেবা নির্ধারণ করার পরও তা কার্যকর হয়নি বেশিরভাগ স্থানে। জিএসএমএর তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে ইন্টারনেটের মূল্য অনেক বেশি। এক জিবি ডেটার গড় মূল্য ভারতে সাড়ে ১৮ রুপি, বাংলাদেশে ৮৩ টাকা। ওকলার স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্স-২০২১ মতে, ‘মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বিশ্বের ১৩৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১৩৪তম। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গতিতে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৯৬তম। জিএসএম এর প্রতিবেদন মতে, ‘বাংলাদেশের মুঠোফোন ব্যবহারকারীদের ৪৭% টু-জি, ২৫% থ্রি-জি ও ২৮% ফোর-জি ব্যবহার করে।’ আর ৫-জি তো চালুই হয়নি দেশে। অথচ, বর্তমানে বিশ্বে ৫-জির গ্রাহক সংখ্যা ৬০ কোটির অধিক। হুয়াওয়ে ঘোষণা করেছে, তারা ২০৩০ সালের মধ্যে ৬-জির নেটওয়ার্ক চালু করবে। জাতিসংঘের আটিইউ প্রকাশিত বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান: সাইবার নিরাপত্তায় ৫৩তম, আইসিটি উন্নয়নে ১৪৭তম ও নেটওয়ার্ক রেডিনেসে ১০৫তম।

অর্থাৎ দেশে ইন্টারনেটের অবস্থা খুব ভালো নয়। তাই ইন্টারনেট সম্পর্কিত বিষয়ে দেশ কাক্সিক্ষভাবে এগুতে পারছে না। অবশ্য, গত ১০ আগস্ট একনেকের সভায় ‘গ্রাম পর্যায়ে টেলিটকের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং ৫-জি সেবা প্রদানে নেটওয়ার্ক আধুনিকায়ন’ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে। প্রকল্পটির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২,১৪৪ কোটি টাকা। এই প্রকল্পটি চলতি বছরের এপ্রিল থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাস্তবায়ন করবে টেলিটক বাংলাদেশ লি.। এই প্রকল্পটি সঠিকভাবে ও যথাসময়ে বাস্তবায়ন হলে বিভিন্ন সুবিধার সাথে সদাই অ্যাপ কার্যকর করতে গ্রামাঞ্চলের মানুষের ব্যাপক সুবিধা হবে। ফলে বিদেশি মোবাইল কোম্পানিগুলোর মনোপলি বাণিজ্য বন্ধ হবে।

পানির পাইপের ভেতর দিয়ে ইন্টারনেট ক্যাবল নেওয়া শুরু হয়েছে স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে। এটা যুক্তরাজ্যেও চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সম্প্রতি দেশটির সরকার পানির লাইনের মাধ্যমে ফাইবার অপটিক ইন্টারনেট সংযোগ দিতে ৪০ লাখ ব্রিটিশ পাউন্ড তহবিলের অনুমোদন দিয়েছে। পরীক্ষামূলক এই প্রকল্পের মাধ্যমে ইন্টারনেট সংযোগ দেওয়ার পাশাপাশি পানির লাইনও পর্যবেক্ষণ করা হবে বিশেষ সেন্সর সংযুক্তির মাধ্যমে। এতে সরবরাহকৃত পানির প্রায় এক-পঞ্চমাংশ অপচয়ের অর্ধেক কমে যাবে। এ ছাড়াও গিগাবাইট সক্ষমতার ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্ক ইন্সটল করার ব্যয়েরও চার-পঞ্চমাংশ কমে যাবে। এই ব্যবস্থা বাংলাদেশেও চালু করা দরকার। উল্লেখ্য যে, দেশের শহরাঞ্চলে পাইপের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হয় বহুদিন থেকেই। এছাড়া, সম্প্রতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্সেনিক এলাকায় পাইপের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব পানির পাইপের ভেতর দিয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের লাইন সরকারিভাবে নেওয়া হলে সংশ্লিষ্ট এলাকার সকলেই অতি স্বল্প ব্যয়ে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের সুবিধা পাবে। মধ্যস্বত্বভোগীদের বাটপারি বন্ধ হয়ে যাবে। পানির পাইপ লাইনে অ্যাপস ব্যবহার করতে পারলে পানির অপচয় বন্ধ হয়ে ব্যয় কমে যাবে অনেক। একই অবস্থা হবে গ্রামাঞ্চলের সর্বত্রই পাইপের মাধ্যমে পানি সরবরাহ করতে পারলে। সর্বোপরি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমও শতভাগ হবে দেশব্যাপী। প্রত্যন্ত অঞ্চলেরও মানুষ ঘরে বসেই কম খরচে আইটি আউট সোর্সিংসহ ইন্টারনেট সংশ্লিষ্ট সব কাজ করতে পারবে। স্মরণীয় যে, এলন মাস্কের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের ১৪টি অঞ্চলে তারবিহীন ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। এতে ব্যবহারকারীর মাসিক ব্যয় হচ্ছে ৯৯ ডলার। বিশ্বব্যাপীই এই সেবা দেওয়া তাদের লক্ষ্য। এ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারলে তার ভিত্তিক ইন্টারনেটের ঝামেলা শেষ হবে। মানুষ মধ্যস্বত্বভাগীদের দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা পাবে। বিভিন্ন দেশে তার বিহীন সেট বক্স বসিয়ে টিভির অসংখ্য চ্যানেল দেখা হয় স্বল্প মূল্যের কার্ড দিয়ে। কার্ড শেষ হলে পুনরায় কার্ড ক্রয় করে টিভি দেখা যায়। এটা এ দেশেও চালু হয়েছে। কিন্তু এই দায়িত্ব শুধুমাত্র একটি কোম্পানি দেওয়ার কারণে মনোপলি ব্যবসা করছে। ফলে ব্যয় অত্যধিক হওয়ায় সাধারণ মানুষ এই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারছে না। এই দায়িত্ব টিএন্ডটিসহ কয়েকটি কোম্পানিকে দেওয়া হলে ব্যয় অনেক কমে গিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে আসতো। ডিসের ব্যবসা নিয়ে মারামারি এবং ডিসের তারের ঝামেলা বন্ধ হয়ে যেত।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বাস্থ্যখাতের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করে দারিদ্র্য হ্রাসের জন্য সকলের জন্য সামাজিক স্বাস্থ্য বীমা চালু করার দাবি জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে সম্প্রতি প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় ও চিকিৎসাসেবা গ্রহণে অত্যধিক ব্যয়ের মূল কারণ হচ্ছে ওষুধের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, রোগ নির্ণয় ও শল্য চিকিৎসায় কল্পনাতীত অতিরিক্ত চার্জ ও ভুল চিকিৎসা ইত্যাদি।’ উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘বয়োবৃদ্ধদের চোখের ছানি কেটে চোখে নতুন লেন্স বসাতে সাকল্যে ২ হাজার টাকার বেশি ব্যয় হওয়ার কথা নয়। ফ্যাকো পদ্ধতিতে ছানি কাটার অপারেশন করলে খরচ দ্বিগুণ হয়। অথচ, বিভিন্ন ক্লিনিকে লেন্স বসাতে ৫০ হাজার টাকা ও ততোধিক এবং ফ্যাকো অপারেশনের জন্য ১ লাখ থেকে দেড় লাখ টাকা চার্জ করা হয়। কিছু চক্ষু চিকিৎসক ৫০ হাজার টাকায় প্রদাহ নিবারক ইনজেকশনও বিক্রি করে থাকেন ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির অনৈতিক সহযোগিতা নিয়ে। এরূপ অতিরিক্ত চার্জ দিনে দুপুরে ডাকাতি-তুল্য।’ এই অবস্থা থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য তিনি দেশ-বিদেশে স্বাস্থ্য বীমার উপকারিতার বর্ণনা দিয়ে দেশে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা’ চালু করার প্রস্তাব করেছেন। উপরন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক স্বাস্থ্য বীমার জন্য করণীয় সম্পর্কেও গাইড লাইন দিয়েছেন। সর্বোপরি তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানে শ্রমজীবী মানুষের জন্য যে স্বাস্থ্য বীমা চালু করেছেন, তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন উক্ত নিবন্ধে ।

সুচিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর অন্যতম। মানব সম্পদ উন্নয়নেরও অন্যতম হচ্ছে, সার্বজনীন সুচিকিৎসা। তাই এসডিজি অর্জনে সার্বজনীন সুচিকিৎসার কথা বলা হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ এবং স্বল্প ব্যয়ে সার্বজনীন সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য সরকারিভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা চালু করা দরকার । তাহলে দেশের স্বাস্থ্যখাতের ব্যাপক উন্নতি ঘটবে। মানুষের রোগমুক্তি সহজসাধ্য হবে। সাধারণ মানুষের ব্যক্তি চিকিৎসা ব্যয় অনেক হ্রাস পাবে। ফলে টেকসই দারিদ্র্য বিমোচনে ব্যাপক সহায়ক হবে। তাই স্বয়ংসম্পূর্ণ জাতীয় স্বাস্থ্য বীমা চালু করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। স্মরণীয় যে, স্বাস্থ্য খাতে নিত্য নতুন পরিবর্তন হচ্ছে। সংযুক্ত হচ্ছে আধুনিক প্রযুক্তি। যেমন: রক্ত পরীক্ষা করেই পাওয়া যাবে ক্যান্সারের পূর্বাভাস। স¤প্রতি এই রোগ নির্ণয় পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেল।এতে অন্তত ৫০ ধরণের ক্যান্সারের পূর্বাভাস পাওয়া যাবে কোনো উপসর্গ দেখা দেওয়ার আগেই। অপরদিকে, মানবদেহের ৩.৫০ লাখ প্রোটিন সেলের গঠন সম্পর্কে জানতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা আলফাফোল্ড নামের একটি প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়েছে। এতে নতুন ওষুধ আবিষ্কারের পাশাপাশি, রোগের চিকিৎসা প্রদান ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা সম্ভব হবে। আলফাফোল্ড সম্পর্ক অধ্যাপক ম্যাকজিহান বলেন, মানবদেহের একটা কাঠামোর জন্য আগে আমাদের ছয় মাস সময় লাগত। সেখানে এখন কয়েক মিনিটেই কাজ শেষ হয়ে যাচ্ছে। চিকিৎসা প্রদান, রোগীকে ওষুধ ও পথ্য সেবনসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে রোবট। এসব নতুন আবিষ্কৃত প্রযুক্তি দেশের চিকিৎসা খাতে ব্যবহার করতে পারলে চিকিৎসার মান যেমন বাড়বে, তেমনি ব্যয় অনেক কমে যাবে। চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখিতা বন্ধ হবে। স্বাস্থ্য সচিব আবদুল মান্নান গত ৪ ফেব্রুয়ারি বলেছেন, বিদেশে চিকিৎসাসেবা নিতে গিয়ে প্রতি বছর দেশের প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার চলে যাচ্ছে। স¤প্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্ট মতে,ভারতে চিকিৎসা নেয়া বিদেশিদের ৫৪% বাংলাদেশি।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন