Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বজ্রপাত থেকে বাঁচার উপায়

আবু সালেহ মোহাম্মদ সায়েম | প্রকাশের সময় : ২৮ আগস্ট, ২০২১, ১২:০১ এএম

বজ্রপাত একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও দিনদিন বজ্রপাতের পরিমাণ এবং এতে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। সেভ দ্য সোসাইটি অ্যান্ড থান্ডারস্টর্ম অ্যাওয়ারনেস ফোরামের (এসএসটিএএফ) দেওয়া তথ্য মতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে বজ্রপাতে ১৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর চলতি বছরের মার্চ থেকে জুন এই চার মাসে বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করেছে ১৭৭ জন। কিছু দিন আগে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ ইউনিয়নে পদ্মা নদীর পাড়ের একটি ঘাটে, একই সঙ্গে ১৭ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ২০১১ সাল হইতে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যু হয়েছে প্রায় দুই সহস্রাধিক।

বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাসম‚হের অন্যতম। মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার গবেষণায় দেখা যায়, বিশ্বের ৫০০টি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকার মধ্যে বাংলাদেশের শেরপুর ১০৫, কিশোরগঞ্জ ২৭২ ও পাবনার অবস্থান ৪১০ নম্বরে। শুধু তাই নয়, বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্বে বাংলাদেশেই অধিক। প্রতি বছর বিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশই ঘটে বাংলাদেশে। বাংলাদেশ ছাড়া ভেনেজুয়েলা, কঙ্গোসহ কয়েকটি দেশে বজ্রপাত অধিক হয়। মহাদেশ হিসাবে আফ্রিকা এখন বিশ্বের বজ্রপাতের হটস্পট। এরপর এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা, উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া।

পানিচক্রের নিয়মে জলাধারের পানি বাষ্পীভূত হয়ে মেঘ আকারে আকাশে আশ্রয় নেয়। এই মেঘ-ই হল বজ্রপাতের ব্যাটারি। বজ্রপাতের জন্য দায়ী মেঘ, বৈদ্যুতিক চার্জের আধারের মত আচরণ করে, যার উপরের অংশ পজিটিভ এবং নিচের অংশ নেগেটিভ চার্জে চার্জিত থাকে। মেঘ কিভাবে চার্জিত হয় তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে বেশ মতভেদ থাকলেও সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত মতবাদ হচ্ছে, পানিচক্রে পানিকণা যখন ক্রমশ ঊর্ধ্বাকাশে উঠতে থাকে তখন তা মেঘের নিচের দিকের বেশি ঘনীভূত বৃষ্টি বা তুষার কণার সাথে সংঘর্ষের মুখোমুখি হয়। এর ফলে উপরের দিকে উঠতে থাকা অনেক বাষ্প কণা বেশ কিছু ইলেকট্রন হারায়। এই মুক্ত ইলেকট্রনগুলো মেঘের তলদেশে জমা হয় এবং ইলেকট্রন হারানো পজিটিভ চার্জিত বাষ্পকণা মেঘের একেবারে উপরপৃষ্ঠে চলে যায়, যার ফলে মেঘগুলো শক্তিশালী ধারক বা ক্যাপাসিটরের বৈশিষ্ট্য লাভ করে। মেঘের দুই স্তরে চার্জের তারতম্যের কারণে সেখানে শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের শক্তি মেঘে সঞ্চিত চার্জের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। এভাবে বাষ্পকণা ও মেঘে সংঘর্ষ চলতে চলতে মেঘের উপরে এবং নিচে যথাক্রমে পজিটিভ ও নেগেটিভ চার্জের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে এতটাই শক্তিশালী বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র তৈরি করে যে, তার বিকর্ষণে পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থানরত ইলেকট্রনগুলো ভূপৃষ্ঠের আরো গভীরে চলে যায়। ফলে ওই নির্দিষ্ট এলাকার ভূপৃষ্ঠ শক্তিশালী পজিটিভ বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এখন বজ্রপাতের জন্য শুধু প্রয়োজন বিদ্যুৎ প্রবাহের জন্য সামান্য একটু বাহক বা কন্ডাক্টর। মেঘের বিপুল শক্তিশালী বিদ্যুতক্ষেত্র তার চারপাশের বাতাসের অপরিবাহী ধর্মকে নষ্ট করে দেয়, যাকে বলে উরবষবপঃৎরপ ইৎবধশফড়হি। মেঘে অবস্থিত বিদ্যুতক্ষেত্র যখন যথেষ্ঠ শক্তিশালী হয় (প্রতি ইঞ্চিতে প্রায় ১০,০০০ ভোল্ট), তখন তার আশেপাশের বাতাস পজিটিভ এবং নেগেটিভ চার্জে বিভক্ত হয়ে যায়। এই আয়নিত বাতাস প্লাজমা নামেও পরিচিত। বাতাস আয়নিত হয়ে মেঘ এবং ভূপৃষ্ঠের মধ্যে বিদ্যুৎ চলাচলের পথ বা শর্ট সার্কিট তৈরী করে দেয় এবং বজ্রপাত ঘটায়। আয়নিত বাতাস বা প্লাজমা পরিবাহী হওয়ার কারণে এতে ধাতব বৈশিষ্ট্য প্রবলভাবে বিদ্যমান। তাই বাতাসের অক্সিজেনের সাথে প্লাজমার বিক্রিয়ায় বজ্রপাতের স্ফুলিঙ্গের সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তাপমাত্রা ও বাতাসে সিসার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া, জনজীবনে ধাতব পদার্থের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, প্রচুর মোবাইল ফোন ব্যবহার ও এর রেডিয়েশন, গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, জলাভ‚মি ভরাট ও নদী দখল ইত্যাদি কারণে বজ্রপাতের পরিমাণ বাড়ছে। বজ্রপাতের শিকার মানুষের বড় অংশ কৃষক ও জেলে।

তবে এতো দুঃসংবাদের মধ্যেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বজ্রপাত সার্বিকভাবে উপকারী। ভ‚মির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধিতে বজ্রপাতের অবদান রয়েছে। উৎপাদনের কথা চিন্তা করে আমাদের জীবন ও মালামালের ক্ষয়ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকতে হবে। ইতিমধ্যে বজ্রপাতের ক্ষয়ক্ষতি প্রতিরোধের লক্ষ্যে দেশবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে দেশের আটটি স্থানে পরীক্ষাম‚লকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেনসর স্থাপন করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এই বজ্রপাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে আমাদের আরো কিছু উপায় বের করতে হবে। যেমন, প্রথমেই বজ্রপাতের পূর্বাভাসের উন্নতি সাধন করতে হবে। বজ্রপাতের ১৫ মিনিট পূর্বে আবহাওয়া অধিদপ্তর জানতে পারবে কোন কোন এলাকায় বজ্রপাত হবে। এই খবর মোবাইল ফোনে মেসেজ আকারে অথবা গণমাধ্যমে/ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষকে জানানোর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপক‚লীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় হতে রক্ষায় কেবল আগাম সতর্কবার্তাই দেওয়া হয় না, তাদের সাইক্লোন শেল্টারে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার। প্রয়োজনে পুলিশও মোতায়ন করা হয়। বজ্রপাতের ক্ষেত্রেও এমন উদ্যোগ নিতে হবে। শক্তিশালী রাডার ও স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পূর্বাভাসের উন্নতির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রাকৃতিক প্রতিরোধ হিসাবে খোলা জায়গায় তালগাছ, নারিকেল গাছ, বটগাছ প্রভৃতি দ্রুত বর্ধনশীল গাছ রোপন করতে হবে। জনসমাগমের স্থানে লাইটনিং অ্যারেস্টার বা বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন করতে হবে।

আকাশে ঘনকালো মেঘ দেখা দিলে বজ্রপাতের আশংকা তৈরি হয়। ৩০-৪৫ মিনিট বজ্রপাত স্থায়ী হয়। এ সময়ে ঘরে অবস্থান করাই শ্রেয়। খুব প্রয়োজন হলে রাবারের জুতা পায়ে বাইরে যাওয়া যেতে পারে। বজ্রপাতের সময় খোলা জায়গা, খোলা মাঠ বা উঁচু স্থানে অবস্থান করা যাবে না। এ সময়ে ধানক্ষেত বা খোলা মাঠে থাকলে তাড়াতাড়ি হাঁটু গেড়ে, কানে আঙুল দিয়ে, মাথা নিচু করে বসে পড়তে হবে। খোলাস্থানে অনেকে একত্রে থাকাকালীন বজ্রপাত শুরু হলে প্রত্যেকে ৫০ থেকে ১০০ ফুট দূরে দূরে সরে যেতে হবে। খোলা জায়গায় কোনো বড় গাছের নিচে আশ্রয় নেয়া যাবে না। গাছ থেকে চার মিটার দূরে থাকতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব দালান বা কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালা যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে হবে। উঁচু গাছপালা, বৈদ্যুতিক তার বা ধাতব খুঁটি, মোবাইল টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে হবে। বজ্রপাতের সময় গাড়ির ভেতরে অবস্থান করলে গাড়ির ধাতব অংশের সঙ্গে শরীরের সংযোগ ঘটানো যাবে না। সম্ভব হলে গাড়ি নিয়ে কোনো কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। বাড়িতে থাকলে জানালার কাছাকাছি বা বারান্দায় থাকা যাবে না। বাড়ির জানালা বন্ধ রাখতে হবে এবং ঘরের ভিতরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম থেকে দূরে থাকতে হবে। মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ল্যান্ডফোন, টিভি, ফ্রিজসহ সব বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে এবং এগুলো বন্ধ রাখতে হবে। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির প্লাগগুলো লাইন থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। বজ্রপাতের সময়ে ধাতব হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করা যাবে না। প্রয়োজনে প্লাস্টিকের অথবা কাঠের হাতলযুক্ত ছাতা ব্যবহার করতে হবে। খোলা মাঠে খেলাধুলা করা যাবে না। বজ্রপাতের সময় ছাউনিবিহীন নৌকায় মাছ ধরা যাবে না। যদিও বৃষ্টির সময় মাছ বেশি ধরা পড়ে। তবে এ সময় নদীতে থাকলে নৌকার ছাউনির নিচে অবস্থান করতে হবে। বজ্রপাত ও ঝড়ের সময় বাড়ির ধাতব কল, সিঁড়ির রেলিং, পাইপ ইত্যাদি স্পর্শ করা যাবে না। প্রতিটি ভবনে বজ্র নিরোধক দন্ড স্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। কোনো বাড়িতে যদি পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকে তাহলে সবাই এক কক্ষে না থেকে আলাদা আলাদা কক্ষে অবস্থান করতে হবে। ছেঁড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকতে হবে। বৈদ্যুতিক তারের নিচ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে হবে।

ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চাইতেও এখন বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেশি। তাই মানুষের জীবন বাঁচাতে এই খাতে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। মাঠে, হাওর-বাওর ও ফাঁকা কৃষিকাজের এলাকায় বজ্র নিরোধক যন্ত্র স্থাপনসহ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা দরকার। প্রয়োজনে থান্ডার প্রটেকশন সিস্টেমের সকল পণ্যে শুল্ক মওকুফ করতে হবে। বজ্র নিরোধক ব্যবস্থা ছাড়া নতুন ভবনের নকশা অনুমোদনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজ, ঢাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বজ্রপাত

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন