পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পরিবেশ দূষণের এক ভয়ঙ্কর দিক হলো বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তরের ক্ষয় বা গহ্বরসৃষ্টি। বায়ুমন্ডলে ওজোন স্তরের ক্ষয়-ক্ষতি নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বিগত তিন দশক আগে। সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি যাতে সরাসরি পৃথিবীপৃষ্ঠে না আসে, সেই কাজটি করে থাকে বায়ুমন্ডলের ওজোন স্তর। দেখা গেছে, ব্রোমাইড ও ক্লোরিনযুক্ত রাসায়নিক পদার্থের প্রসারণের ফলে বায়ুমন্ডলের সমতা নষ্ট হচ্ছে, সৃষ্টি হচ্ছে গহ্বরের। বিশেষত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, স্টাইরোফোম, ¯েপ্র শিল্প ইত্যাদিতে ব্যবহৃত ক্লোরোফ্লুরোকার্বন (সিএফসি) এবং আগুন নেভানোর জন্য হ্যালন নামক রাসায়নিকের ব্যবহার অত্যধিক বেড়ে যাওয়ার ফলে ওজোন স্তরে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে। সূর্য থেকে আসা ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির বেশিরভাগই শুষে নেয় ওজোন স্তর, কিন্তু সেখানে যদি গহ্বর সৃষ্টি হয় তাহলে ওই রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে পৌঁছবে এবং জীবজগতে প্রাণ সংশয় দেখা দেবে।
বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, বাতাসে যদি এক শতাংশ ওজোন কমে যায় তাহলে, ২০৭৫ সালের আগে যারা জন্মাবে, তাদের ৩০ লাখ থেকে ১.৫ কোটি মানুষের চামড়ায় ক্যান্সার দেখা দেবে, ৫ লক্ষ থেকে ২৮ লক্ষ মানুষের চোখে নতুন করে চোখে ছানি পড়বে। এই ওজোন স্তর ঘটিত সমস্যা বর্তমানে বিজ্ঞানীদের ভরিয়ে তুলেছে। ১৯৩১ সালে ক্লোরোফ্লুরোকার্বন অবিষ্কারের পর থেকে ব্যাপক ব্যবহার এবং আধুনিক ইলেকট্রনিক শিল্পে এর চাহিদা বেড়েছে। ১৯৮৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের উৎপাদন সমগ্র বিশ্বের উৎপাদনের ৭০ শতাংশ এবং ব্যবহারের ৫০ শতাংশ। এর ফলে পৃথিবীর দক্ষিণ মেরু প্রদেশের ওজোন স্তরে ছিদ্রের সৃষ্টি হয়েছে। তবে আশার কথা ক্লোরোফ্লেুারোকার্বনের বিকল্প রাসায়নিকের উৎপাদন শুরু হয়েছে।
সভ্যতার সবচেয়ে বড় সংকট হিসাবে দেখা দিয়েছে, শিল্পে ব্যবহৃত বর্জ্য পদার্থ। কোথায় ফেলা হবে এই বর্জ্য? যেখানেই ফেলা হোক না কেন, তার থেকে দূষণ ছড়াবেই। বিপজ্জনক রাসায়নিক বর্জ্য সৃষ্ট হয় জৈব রাসায়নিক শিল্পে। ১৯৩০ সালে যেখানে উৎপাদন ছিল ১০ লাখ টন, ১৯৯০ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫০ কোটি টন। এরপর প্রতিনিয়তই উৎপাদন বেড়ে চলেছে। এই সব বর্জ্য জমা হচ্ছে হ্রদে, পুকুরে, নদীতে, সাগরে। মানুষ এ যাবৎ ৭০ লাখ রাসায়নিক তৈরি করেছে। প্রতি বছর কয়েক হাজার নতুন রাসায়নিক আসছে। এদের মধ্যে ৮০০০ রাসায়নিক বিপজ্জনক। ১৯৯২ সালে ২৩০ কোটি গ্যালন শিল্পজাত বর্জ্যপদার্থ সাগরে ফেলা হয়। নিউইয়র্কের বর্জ্য ফেলার স্থান স্টটেন দ্বীপ, সেখানে প্রতিদিন ২২,০০০ টন বর্জ্য জমা হচ্ছে। আমেরিকার শিল্পজাত বর্জ্য প্রতি বছর ৫৬ কোটি টন মারাত্মক ক্ষতিকারক বর্জ্য সৃষ্টি করে। এই বর্জ্য পদার্থের মধ্যে অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক হল পারমাণবিক বর্জ্য। এ নিয়ে মানুষ কী করবে, জানেন না বিজ্ঞানীরা। পারমাণবিক চুল্লির জ্বালানি হল ইউরেনিয়াম। এই পদার্থটিকে যখন খনি থেকে তোলা হয় তখন রেডন নামে এক তেজস্ত্রিয় গ্যাস বিকিরণ করে যা শ্রমিকদের ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ইউরেনিয়াম খনি থেকে বিকিরিত গামারশ্মি মানুষের যৌন ক্রমোজোমের জিনগত বৈকল্য সৃষ্টি করে। ইউরেনিয়ামকে জ্বালানি দন্ডের মাধ্যমে আণবিক চুল্লিতে প্রবেশ করানোর পর ভাঙন প্রক্রিয়ায় বিপুল তাপশক্তি ও অসংখ্য বর্জ্য পদার্থের সৃষ্টি হয়।
আমাদের দেশে একশ্রেণীর মানুষ নানারকম ইনজেকশন দিয়ে কৃত্রিমভাবে গরুর দুধ বাড়াতে চান। তারা শিশু খাদ্যে ভেজাল মেশান, মানুষের খাদ্যে ভেজাল মেশান। আসলে ভোগবাদী সভ্যতা প্রাণীদেরই পণ্য করে তোলেনি, মানুষকেও পণ্যের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন করে শিল্প বিপ্লবোত্তর ধনী দেশগুলো যে ভোগবাদী সমাজের আদর্শ নিয়েছে তাতে সকলেই পণ্য।
পৃথিবীর সম্পদকে অসম বন্টন করে ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, পশ্চিমা ধনী দেশগুলো বিপুল পরিমাণে গোশত খায়। যার ফলে, তারা পশুপালন করে না, বাণিজ্যিক পণ্যের মতই তাদের চাষ করে। ১ কেজি মুরগীর মাংসের জন্য ২ কেজি শস্য এবং ১ কেজি শূকরের মাংসের জন্য ৪ কেজি শস্য প্রয়োজন। ফলে তারা ২৫ শতাংশ জনসংখ্যার অংশ হয়েও পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ শস্য ভোগ করে। আমাদের দেশে পুরুষের মধ্যে সন্তানবহনকারী শুক্রের ক্ষমতা কমে যাওয়ার একটি কারণ হল খাদ্যে সিন্থেটিক উপাদনের আধিক্য। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, আম পাকানোর জন্য এমন একটি সিন্থেটিক উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে যা পুরুষ শুক্রাণুকে নষ্ট করে দিচ্ছে। চাষের ক্ষেত্রে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তাও পুরুষের শুক্রাণুর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
পাহাড়ে পূর্ত দফতরের কাজের সঙ্গে যেসব প্রযুক্তিবিদ বিশেষজ্ঞরা যুক্ত রয়েছেন এবং যাঁদের অভিজ্ঞতা দু’দশকেরও বেশি তাঁদের কারো কারো মতে মাত্র দু’ঘণ্টা টানা প্রবল বর্ষণে পাহাড়ের বিস্তৃত এলাকা ধসে যেতে পারে। পাহাড় ধসে যাওয়া নতুন ঘটনা নয়, কিন্তু অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়া চিন্তার বিষয়। কারণ ডোলোমাইট সংগ্রহের জন্য যেভাবে বøটিং করা হচ্ছে তাতে কম্পনের তীব্রতা আঘাত করছে পর্বতের তলদেশেও। তাছাড়া পাহাড়ে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি, মাত্রাতিরিক্ত বসতবাড়ি, পাহাড়ি রাস্তায় যানবাহনের চাপ বৃদ্ধি, সবকিছু মিলে বিপন্ন করে তুলছে পাহাড়ি অঞ্চলকে। একই চিত্র দেখা যাচ্ছে ভারতের হিমাচল প্রদেশ ও কাশ্মীরে। হিমাচল প্রদেশে যে ড্যাম গড়া হচ্ছে, তাতে পাহাড়ি পরিবেশ ও ভূত্বকের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে বলে দীর্ঘ আন্দোলনও চালিয়েছিলেন সুন্দরলাল বহুগুণা। এছাড়া কম বেশি সব দেশেই পাহাড়ে পর্যটকদের ভিড় পরিবেশকে বিপন্ন করছে, নানাভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
প্রতিদিনই সংবাদপত্রে শহরের বায়ু দূষণের পরিমাণের হিসাব দেওয়া হচ্ছে। ব্রাজিলের রিও ডি শহরে জেনিরো ১৯৯২ সালে যে সম্মেলন হয়েছিল পরিবেশ নিয়ে তাতে আবহাওয়া নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং সর্বশেষ জাপানের কিয়োটা শহরের সম্মেলনে চুক্তি হয়। চুক্তিতে ২০১২ সালের মধ্যে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ কমিয়ে ফেলার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। এদিকে আমেরিকা ওই চুক্তিতে সই করেনি।
বায়ু দূষণের জন্য বিজ্ঞানীরা কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড, মিথেন প্রভৃতিকে দায়ী করেন। বিভিন্ন খনিজ জ্বালানি যেমন কয়লা, পেট্রোল, ডিজেল, প্রাকৃতিক গ্যাস পোড়ালে বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়। হিসাব অনুযায়ী, বিগত একশ’ বছরে বাতাসে ২৫ শতাংশ কার্বন-ডাই-অক্সাইড বেড়েছে। তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনের সময় প্রচুর সালফার-ডাই-অক্সাইড বাতাসে মেশে। সালফার-ডাই-অক্সাইড বাতাসে থাকা অক্সিজেন ও জলীয় বাষ্পের সঙ্গে মিশে সালফিউরিক অ্যাসিড এবং নাইট্রিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে। এ দুই প্রকার অ্যাসিড বৃষ্টির সঙ্গে মাটিতে নেমে আসে। অ্যাসিড বৃষ্টির ফলে মাটির উর্বরা শক্তি হ্রাস পায়, উদ্ভিদের বৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্থ হয়, পানির উৎসগুলো দূষিত হয়ে পড়ে। বায়ু দূষণের ফলে পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ে।
বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে বলেছেন, বায়ু দূষণের পরিমাণ না কমালে ২০৪০ সাল নাগাদ পৃথিবীর উষ্ণতা ৫০ সেন্টিগ্রেড বেড়ে যাবে। তাতে মেরু অঞ্চলে বরফ গলবে, হিমবাহগুলো গলতে শুরু করবে, পানিস্তর ২-৩ ফুট বেড়ে যাবে। সমুদ্র উপকূলের শহরগুলো ডুবে যাবার সম্ভাবনা দেখা দেবে। এমনকি আমেরিকার মায়ামি, ফ্লোরিডার মতো শহর ডুবে যাবে।
পরিবেশকে দূষণমুক্ত রাখার চেষ্টা শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিকের বা পরিবেশ সচেতন ব্যক্তিদের উদ্বিগ্ন হলে চলবে না। এ ব্যাপারে সবার সচেতন হতে হবে। ধনী দেশগুলোর মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, পরিবেশ দূষণের যাবতীয় দায় তারা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর ওপর চাপিয়ে নিজেদের ক্লিন রাখার চেষ্টা করছে। অথচ আমরা দেখেছি, পৃথিবীর যাবতীয় দূষণের সিংহভাগ দূষণের জন্য প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে দায়ী উন্নত দেশগুলো। আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ দূষণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, তাতে কোনো লাভ হবে না। এক্ষেত্রে, ধনী দেশগুলোকে সবার আগে উদ্যোগী হতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।