Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আফগানিস্তানে কীভাবে তিলে তিলে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হলো

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:১৫ এএম

আফগানিস্তানে তালেবানের অগ্রাভিযানের খবর যারা টিভিতে দেখছেন, পত্রিকায় পড়ছেন - তাদের অনেকের কাছে মনে হতে ব্যাপারটা যেন আকস্মিক - কীভাবে যেন চোখের পলকে সবকিছু ঘটে গেল।

এক বিধ্বংসী সামরিক অভিযানে ২০০১ সালে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর গত ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানের সামরিক নিয়ন্ত্রণ ধরে রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও তার নেটো মিত্ররা। কিন্তু আজ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ উল্টে গেছে।

জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রাতের অন্ধকারে - প্রায় চুপিসারে - যখন মার্কিন সৈন্যদের শেষ দলটি কাবুলের নিকটবর্তী বাগরাম বিমানঘাঁটি ত্যাগ করে - তার মাত্র ৬ সপ্তাহ পার হতে না হতেই আফগানিস্তানের দুই তৃতীয়াংশ দখল করে করে নিয়েছে তালেবান।

দশটি প্রাদেশিক রাজধানী ইতোমধ্যেই তালেবানের দখলে চলে গেছে - তার সাথে যোগ হয়েছে হেরাত ও কান্দাহারের মত গুরুত্বপূর্ণ শহর।

মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর এক মূল্যায়নে বলা হয়েছে, আফগান নিরাপত্তা বাহিনী যেভাবে ভেঙে পড়েছে - তাতে কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রীয় রাজধানী কাবুলের পতন হতে পারে।

কাবুলের পতনের সম্ভাবনা এখন এত দ্রুত সামনে চলে এসেছে যে সেখান থেকে মার্কিন কূটনীতিক ও নাগরিকদের নিরাপদে তুলে নিয়ে যাবার জন্য ৩,০০০ সৈন্য 'সাময়িকভাবে' আফগানিস্তানে পাঠাচ্ছে বাইডেন প্রশাসন।

শুধু তাই নয়, মার্কিন পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে তাদের দূতাবাসটি বিমানবন্দরের মধ্যে বা কাছে কোথাও সরিয়ে নেয়া যায় কিনা - সে বিকল্পটিও আলোচনা করেছে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের প্রশাসন।

নিউইয়র্ক টাইমস এক রিপোর্টে জানিয়েছে, তালেবান যেন কাবুলের মার্কিন দূতাবাসে হামলা না চালায় সে জন্য মার্কিন আলোচকরা এর মধ্যেই তালেবানের সাথে যোগাযোগ করেছে।

মার্কিন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা এখন বলছেন যে, ১৯৭৫ সালে যেভাবে ভিয়েতনামের সায়গন থেকে যেভাবে আমেরিকানদেরকে হেলিকপ্টারে করে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল - ২০২১ সালের কাবুলে এখন সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে কিনা, সেটাই অনেকের মনে উঁকি দিচ্ছে।

কাবুলের পতন মানে পরাজয়ের চূড়ান্ত বিন্দু?
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারকে অনেক বিশ্লেষকই সমর্থন করেছেন। সাম্প্রতিক জনমত জরিপগুলোতে দেখা যায়, মার্কিন জনগণের অধিকাংশের মধ্যেও এর প্রতি সমর্থন আছে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৈন্য প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করার পর তালেবানের কিছু নেতা বলেছেন, তারা এ যুদ্ধে জিতেছেন - আমেরিকা হেরে গেছে।

অন্য অনেক বিশ্লেষকও একে আমেরিকার 'পরাজয়' ও 'পশ্চাদপসরণ' বলে আখ্যায়িত করেছেন।

তারা বলেছেন, আফগানিস্তান থেকে এমন এক সময় মার্কিন বাহিনী বিদায় নিচ্ছে যখন তাদের অর্জন হিসেবে দেখানোর কিছুই প্রায় নেই। এটা ঠিক যে আল-কায়েদাকে উৎখাতের কথা বলে এ অভিযান শুরু হয়েছিল - তারা এখন তত শক্তিধর নয়, ওসামা বিন লাদেনও নিহত - কিন্তু তাদের আশ্রয়দাতা তালেবান এখন প্রবলভাবে ফিরে এসেছে।

এখন তালেবানের হাতে কাবুলের পতনের সম্ভাবনার মুখে মার্কিন রিপাবলিকান সেনেটর মিচ ম্যাককনেল বলেছেন, "বাইডেন প্রশাসনের স্ট্রাটেজি যুক্তরাষ্ট্রকে এক লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে ফেলবে। "

তার কথায় - "প্রেসিডেন্ট বাইডেনের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রকে ১৯৭৫ সালের সায়গনের অপমানজনক পতনের চাইতেও খারাপ অবস্থায় নিযে যাচ্ছে।"

অনেকেই এটাও বলতে শুরু করেছেন যে প্রত্যাহার নয়, বরং কাবুলকে রক্ষা করতে এখন আবার মার্কিন ও নেটো সৈন্যদের আফগানিস্তানে পাঠানো উচিৎ।

মি. ম্যাককনেল তার বিবৃতিতে বলেছেন, "এখন আফগান সৈন্যদের সাহায্য না করলে আল-কায়েদা ও তালেবান মিলে কাবুলে আমাদের দূতাবাস পুড়িয়ে দিয়ে এবার ১১ই সেপ্টেম্বরের বার্ষিকী পালন করবে।"


দু'দশকব্যাপি এই আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারি হিসেবমতে ৭৭ হাজার ৬০০ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, এতে নিহত হয়েছে তাদের ২,৩১২ জন সৈন্য, জখম হয়েছে ২০ হাজারের বেশি, আফগান সৈন্য ও পুলিশ নিহত হয়েছে আনুমানিক ৬৪,০০০ - আর আফগান বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে অন্তত ১১১,০০০।

তাই কাবুলের পতনকে এখন অনেকে দেখতে চাইবেন আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রয়াসের পরাজয়ের চরম মুহূর্ত হিসেবে।

কিন্তু কীভাবে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হলো?

'বহু বছর ধরে, একটু একটু করে আফগানিস্তানে হেরেছে যুক্তরাষ্ট্র'
ঘটনাপ্রবাহ দেখে মার্কিন বিশ্লেষকরাও এখন বলছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ 'পরাজয়' আসলে আকস্মিক কিছু নয়, এটা ঘটেছে বহু বছর ধরে - একটু একটু করে।

মার্কিন সাংবাদিক ও বিশ্লেষক ফরিদ জাকারিয়া শুক্রবারই সিএনএন-এ এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তালেবানের এই পুনরুত্থান আকস্মিক নয়, বরং গত ১০-১৫ বছর ধরেই তালেবানের ধীরে ধীরে শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছিল।

আফগানিস্তানে ২০০১ সালের অক্টোবর মাসে শুরু হওয়া মার্কিন বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে তালেবানের পতনের পর কাবুলে অনেক তরুণের দাড়ি কামিয়ে ফেলার দৃশ্য টিভির পর্দায় দেখানো হয়েছিল।

কিন্তু আসলে তালেবান কখনোই সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি।

আফগানিস্তানে বিপুল পরিমাণ বিদেশি সৈন্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও তালেবান আবারও সংগঠিত হয়ে ক্রমাগত তাদের শক্তি বাড়ায়, আফগানিস্তানের নানা অঞ্চলে আবার তাদের প্রভাব বিস্তার করে।

আফগানিস্তানের বিস্তীর্ণ অঞ্চলকে তারা বিপজ্জনক করে তুলেছিল এবং তাদের চোরাগোপ্তা বা আত্মঘাতী আক্রমণ, ঘরে তৈরি বোমা বিস্ফোরণ ও সহিংসতা বছরের পর বছর ধরে অব্যাহতভাবেই চলছিল।

কাবুলে তারা বহু হামলা চালিয়েছে, এবং ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবান এমনকি নেটো জোটের ক্যাম্প বাস্টিয়ন ঘাঁটিতেও এক বিরাট দুঃসাহসিক অভিযান চালায়।

অন্যদিকে তালেবানের ওপর মার্কিন ও নেটো বাহিনীর অনেক বিমান হামলায় নিহত হয় অসংখ্য বেসামরিক আফগান - যা মার্কিন সামরিক প্রয়াস সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়।

মার্কিন সামরিক তৎপরতা ব্যর্থ হচ্ছিল
ওয়াশিংটন পোস্ট দৈনিকে সাংবাদিক-বিশ্লেষক ইশান থারুর লিখেছেন, তালেবানের আক্রমণের মুখে আফগানিস্তান যেভাবে এত দ্রুতগতিতে ভেঙে পড়ছে - তা "যুক্তরাষ্ট্রের এক দীর্ঘ ও ধীরগতির পরাজয়।"

তার মতে, ২০০১ সালে তালেবান যখন ক্ষমতাচ্যুত হয়েছিল - তার পরবর্তী ২০ বছরের মধ্যে এখনই তারা সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে আছে।

তিনি বলছেন, পরিস্থিতি যে এমন হতে পারে তার আভাস অনেক আগেই পাওয়া গিয়েছিল। আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক তৎপরতা এবং দেশ-গঠনের প্রক্রিয়া যে ব্যর্থ হচ্ছে - তা অনেক দিন ধরেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের শিক্ষক এবং আফগান রাজনীতি ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. আসিম ইউসুফজাই বিবিসিকে বলেছেন, আমেরিকানদের কৌশল ছিল আফগানিস্তানের প্রধান শহরগুলোকে কব্জায় রাখা। কিন্তু শহরের বাইরে গ্রাম-গঞ্জ তালেবানের নিয়ন্ত্রণে থেকে গিয়েছিল।

কিন্তু মার্কিন রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব তা স্বীকার করতে চাননি। বিবিসি বাংলা



 

Show all comments
  • Anwar+Hossain ১৪ আগস্ট, ২০২১, ১১:৫১ এএম says : 0
    অন্যদিকে তালেবানের ওপর মার্কিন ও নেটো বাহিনীর অনেক বিমান হামলায় নিহত হয় অসংখ্য বেসামরিক আফগান - যা মার্কিন সামরিক প্রয়াস সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্নের জন্ম দেয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আফগানিস্তান


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ