Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে দেশ

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৩ আগস্ট, ২০২১, ১২:০২ এএম

দেড় বছরের অধিক সময় ধরে চলমান করোনা মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত। কি ধনী, কি দরিদ্র, কোনো দেশই অর্থনীতির এই বিপর্যয়কর অবস্থা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। ধনী দেশগুলো অর্থনীতির শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে এবং বিভিন্ন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার মাধ্যমে মন্দাবস্থা কাটিয়ে ওঠার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিক এ মন্দাবস্থা থেকে উত্তরণের প্রথম কাজ হচ্ছে, জনসাধারণকে গণটিকার মাধ্যমে সুরক্ষা দিয়ে করোনা মোকাবেলা করা। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ ইউরোপের ধনী দেশগুলো ইতোমধ্যে এ কাজটি করে অর্থনীতির চাকা সচল করতে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। এটাই স্বাভাবিক। তাদের অর্থ ও সম্পদের ঘাটতি নেই। উদ্ভাবিত টিকাও সবার আগে তারা সংগ্রহ ও মজুত করেছে। ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র তার ৮০ ভাগের বেশি মানুষকে টিকা দেয়া সম্পন্ন করেছে। টিকা গ্রহণে আগ্রহী করে তোলার জন্য বাইডেন প্রশাসন টিকা গ্রহীতাকে ১০০ ডলার দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাজ্যও ইতোমধ্যে ৮০ ভাগ মানুষের টিকাদান সম্পন্ন করেছে। ইউরোপের অনেক দেশ সিনিয়র সিটিজেন থেকে তরুণদের টিকা দিয়ে এখন শিশুদের টিকা দেয়া কার্যক্রম শুরু করেছে। ধনী দেশগুলো টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করে এখন অর্থনৈতিক কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দেশসহ দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলো অনেক পিছিয়ে রয়েছে। ফলে দেশগুলোর অর্থনীতি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছে। টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের ধনী দেশগুলোর ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এ তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। টিকা কার্যক্রম গতিশীল করতে বাংলাদেশ গণটিকা কার্যক্রম শুরু করে চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ বিভিন্ন উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের জোর তৎপরতা চালাচ্ছে। ইতোমধ্যে টিকা আসা শুরু হয়েছে এবং প্রয়োগও চলছে। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ফলে বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড় করানোর বিষয়টি যেমন প্রলম্বিত হয়ে পড়ছে, তেমনি চ্যালেঞ্জেরও বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

দুই.
বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এখন নি¤œগামী তা বুঝতে পরিসংখ্যানের প্রয়োজন পড়ে না। সাদাদৃষ্টিতেই তা দেখা যায়। নতুন পুরনো মিলিয়ে দরিদ্র জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক দিন দিন নি¤œগামী হচ্ছে। বিনিয়োগ বলতে কিছু নেই। বিগত কয়েক বছর ধরে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ কেবল নি¤œগামীই হয়েছে। করোনায় তা আরও নিচের দিকে নিয়ে গেছে। বেসরকারি বিনিয়োগ বিগত ১৪ বছরের মধ্যে একেবারে তলানীতে গিয়ে ঠেকেছে। ব্যাংকে অলস টাকার পাহাড় গড়ে উঠা থেকে এর আভাস পাওয়া যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোতে এখন ৬০ হাজার কোটি টাকা অলস পড়ে আছে। বিনিয়োগ না থাকায় এই অর্থ নিয়ে ব্যাংকগুলো বিপাকে রয়েছে। এক নম্বর রফতানি খাত গার্মেন্টের অবস্থাও নি¤œগামী। খাতটি বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থান হারিয়ে তৃতীয় স্থানে চলে এসেছে। এছাড়া অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদনও কমে গেছে। করোনার মধ্যে বৈদেশিক রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং রেকর্ড করলেও এখন তা কমতে শুরু করেছে। জনশক্তি রফতানি ব্যাপক হারে কমেছে। যতই দিন যাবে এ খাতের প্রবৃদ্ধি যে কমবে, তাতে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, বিগত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় অর্ধেকে নেমে ৩.৫ শতাংশ হয়েছে। দেশের উন্নয়নের অন্যতম উদ্যোগ হচ্ছে, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা বা এডিপি। বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রতি বছর সরকার লাখ কোটি টাকার উপর বরাদ্দ করে। দেখা যায়, বছরান্তে দেখা যায় এসব পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয় না। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে করোনার কারণে বিগত ২৭ বছরের মধ্যে এডিপির বাস্তবায়ন সবচেয়ে কম হয়। বাস্তবায়নের হার ছিল ৮০.১৮ শতাংশ। ২০২০-২১ সালে তা কিছুটা বেড়ে হয় ৮২.২১ শতাংশ। এই অর্থবছরে সরকারের বরাদ্দ ছিল ২ লাখ ৯ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যয় করতে সক্ষম হয় ১ লাখ ৭২ হাজার ৫১ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় সরকার যে অর্থ বরাদ্দ করে তা ব্যয় করা সম্ভব হচ্ছে না। এক্ষেত্রে যেসব উন্নয়ন প্রকল্পে বরাদ্দ করা হয়, তার অনেকগুলো অর্থ ব্যয় ও প্রকল্প বাস্তবায়নে অসক্ষমতা ও অদক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। এর ফলে উন্নয়ন পিছিয়ে পড়ছে। আর এখন করোনার কারণে যে এসব উন্নয়ন প্রকল্প আরো ধীর হয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। এতে কর্মসংস্থান যেমন বন্ধ হয়ে পড়ছে, তেমনি অর্থনৈতিকভাবেও দেশ পিছিয়ে পড়ছে। এর জন্য প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতি ও দুর্নীতির বিষয়টি কারো অজানা নয়। প্রকল্প যথাসময়ে কেন বাস্তবায়ন হচ্ছে না, এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো দায়বদ্ধতাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আর এখন করোনার উছিলা তো রয়েছেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, সরকার বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অর্থের কমতি রাখছে না। যে প্রকল্পে যত অর্থের প্রয়োজন তা দিচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোও হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ দিচ্ছে, সেখানে প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি বা পুরো অর্থ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা ব্যয় করতে পারছে না কেন? সরকারি কাজ বলে কি যেভাবে খুশি সেভাবে ব্যয় করতে হবে? কিংবা সরকারের প্রকল্প বলে তা বাস্তবায়নে আন্তরিকতা থাকবে না? আমাদের আমলাতন্ত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে, তারা সরকারের অংশ হয়েও তার অভিষ্ট উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে চরম গাফিলতির পরিচয় দেয়া। তারা মনে করে, সরকারের কাজ যখন খুশি তখন করলেই হয়। অথচ যারা সরকার পরিচালনা করে তারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ হয়ে উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করতে অত্যন্ত আন্তরিক থাকে। তারা জানে, উন্নয়ন করতে না পারলে জনগণের কাছে তাদের জবাবদিহি করতে হবে। অন্যদিকে, আমলাতন্ত্রের ধারক-বাহকরা মনে করে তারা সরকারের কর্মচারী। জনগণের কাছে জবাব দিতে হবে না, সরকারে যে আছে তাকে দিতে হবে। আমলাদের প্রথাগত এই মানসিকতার জন্যই বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা কখনোই পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয় না। আমলাদের এই মানসিকতার মধ্যে করোনা পরিস্থিতি যুক্ত হয়ে তা যে আরও ধীরগতির হয়ে পড়বে, তা না বললেও চলে। অথচ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে। ২০২৬ সালে এ স্বীকৃতি পূর্ণতা পাবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। অথচ করোনায় সামগ্রিক অর্থনীতি এখন বিপর্যস্ত। এ প্রেক্ষিতে, দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে শামিল হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এখনও রফতানির ক্ষেত্রে ইউরোপ-আমেরিকা থেকে শুল্কমুক্ত যেসব সুবিধা ও স্বল্পসুদে ঋণ পাচ্ছে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পর তা আর পাবে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পর রফতানি খাতে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে চার থেকে ছয় বিলিয়ন মার্কিন ডলার হারাবে। তারা এ কথাও বলছেন, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যদি অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজটি যথাযথভাবে করা না হয়, তাহলে বাংলাদেশকে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে। এ পরিস্থিতি এড়ানোই এখন অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তিন.
অর্থনীতির জটিল প্যাঁচগোচের হিসাবে যে দেশের সার্বিক অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়েছে তা বোঝা গেছে। তবে এসব প্যাঁচগোচ বাদ দিয়ে সরল হিসাবে বলা যায়, দেশের সাধারণ মানুষের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছে। তারা চরম টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে জীবনযাপন করছে। দিন দিন মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। ক্ষুদ্র-মাঝারি ব্যবসায়ীরা পুঁজি এবং অসংখ্য কর্মজীবী চাকরি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির হিসাবে দেশে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ধরনের দোকান রয়েছে ৫০ লাখের অধিক। এসব দোকানে প্রায় দুই কোটি কর্মচারী কর্মরত। লকডাউনে দোকান বন্ধ থাকায় অসংখ্য দোকান মালিক পুঁজি হারিয়েছে। বেকার হয়েছে লাখ লাখ কর্মচারি। অন্যদিকে, ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স ইন্ডাস্ট্রির হিসাব মতে, করোনায় ২২ লাখ লোক চাকরি হারিয়েছে। এছাড়া অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত প্রায় এক কোটির মতো লোক বেকার হয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে দেশের ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছে। সেন্টর ফর পলিসি রিসার্চ (সিপিডি)-এর জরিপে বলা হয়েছে, করোনা শুরু হওয়ার পর ৬২ শতাংশ মানুষ চাকরি ও কাজ হারিয়েছে। আয় রোজগার না থাকায় লাখ লাখ পরিবার খাবার কমিয়ে দিয়েছে। লাখ লাখ পরিবার সঞ্চিত পুঁজি ভেঙ্গে খেয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেটিং রিসার্চ সেন্টার এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভার্নেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর এক যৌথ জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে ২ কোটি ৪৫ লাখ মানুষ নতুন দরিদ্র হয়েছে। পুরনো দরিদ্রদের সাথে এরা যুক্ত হয়ে সংখ্যাটি ৬ কোটি ৪৫ লাখ হয়েছে। এই দরিদ্রদের প্রতিদিনের আয় দুই ডলার বা ১৭০ টাকার কম। উল্লেখ্য, যার দৈনিক আয় ১৭০ টাকার কম তাকে অতি দরিদ্র হিসেবে ধরা হয়। দেখা যাচ্ছে, তাদের জরিপ অনুযায়ী দেশের এক তৃতীয়াংশ লোক দরিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। তবে অতি দরিদ্র ও দরিদ্র মিলিয়ে এ সংখ্যাটি যে জনসংখ্যার অর্ধেক তা বিভিন্ন সময়ে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন। দরিদ্র ও কর্মহারা হওয়ার এ চিত্র থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, মানুষ কতটা অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে। সহসা এ অবস্থার উত্তরণ ঘটবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এদিকে সরকার করোনার মধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে, দেশের মানুষের গড় আয় ২২২৭ ডলার। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিকের মাসিক আয় ১৬ হাজার টাকার উপরে। এটা যে প্রহসনের একটি হিসাব তা বলা বাহুল্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক দরিদ্র নিয়ে উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা অসম্ভব। সরকারের পক্ষে কি এই বিপুল সংখ্যক দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কিংবা দরিদ্রমুক্ত করা সম্ভব? সম্ভব নয়। ফলে সরকারের পরিকল্পনায় অতি দরিদ্র ও নতুন দরিদ্রদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ ও কার্যকর পরিকল্পনা নেই বললেই চলে। সরকার তো নতুন দরিদ্রদের স্বীকৃতিই দিতে চাচ্ছে না। দারিদ্র্যের এ চিত্র জেনেও বালিতে মুখ গুঁজে রয়েছে। নতুন দরিদ্ররা অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সরকার যেন বুঝিয়ে দিচ্ছে, তোমরা যেভাবে পারো করেকেটে খাও। আমার কিছু করার নেই। গত বছর করোনাকালে সরকার ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারকে মাসে আড়াই হাজার টাকা করে তিন মাস দেয়ার প্রকল্প নিলেও তা এসব পরিবারকে স্থায়ীভাবে দরিদ্রমুক্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিল না। উপরন্তু অর্থ বিলি-বন্টনের ক্ষেত্রে নানা দুর্নীতির কারণে অনেক পরিবার এ অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সরকারের এ প্রকল্পটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। করোনা যেমন দেশের অর্ধেক মানুষকে দরিদ্র করে দিয়েছে, তেমনি ধনীর সংখ্যাও বৃদ্ধি করেছে। এ এক বিপরীত চিত্র। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর এক কোটি টাকা বা তার উপরে ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সংখ্যা ছিল ৮৩ হাজার ৮৩৯ টি। এ বছর তা ১০ হাজার ৫১টি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৯৩ হাজার ৮৯০টি। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, করোনা কোটি কোটি মানুষকে দরিদ্র করলেও কোটিপতির সংখ্যা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিয়েছে। এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, বাংলাদেশের দিকে অর্থনৈতিক চরম দুদর্শার সুনামি ধেয়ে আসছে। অর্থনীতির সব সূচকগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে। এই দুর্দশার মধ্যে একমাত্র কৃষি খাত আশার আলো হয়ে রয়েছে। তবে এ আলো কতদিন দেদিপ্যমান থাকবে, তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। করোনার কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়া এবং সিন্ডিকেটের কারসাজির কবলে পড়ে কৃষকরা উৎপাদিত ফসলের দাম না পেয়ে দিন দিন হতাশ হয়ে পড়ছে। এখন গ্রামে-গঞ্জে করোনা ছড়িয়ে পড়ায় তার প্রভাব কৃষকদের কর্মস্পৃহার উপর পড়ছে। দেখা যাচ্ছে, দারিদ্র্য বৃদ্ধি, রফতানি ও রেমিট্যান্স কমে যাওয়া, বিনিয়োগ তলানিতে চলে যাওয়া এবং বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্প ধীর হয়ে পড়াসহ সার্বিক অর্থনীতির সূচক ক্রমেই নি¤œগামী হচ্ছে। অর্থনীতির এই চিত্র আমাদেরকে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে হওয়ার ক্ষেত্রে এখন বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঠাঁই পেলেও তা অপরিণত শিশুর জন্মের মতোই হয়ে থাকবে।

চার.
করোনার আগ পর্যন্ত আমরা অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে যে দুর্দান্ত গতিতে চলছিলাম, এক করোনা এসে তা ধীর করে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির একমাত্র শত্রæ করোনা। সারাবিশ্বই এই শত্রæর মোকাবেলায় নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো তা মোকাবেলা করে অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাদের সবকিছুই স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। আমরা এখনো প্রান্তিক পর্যায়ে রয়ে গেছি। করোনা মোকাবেলা করে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের যে চ্যালেঞ্জ, তা থেকে অনেক পিছে পড়ে গেছি। করোনা মোকাবেলার একমাত্র অস্ত্র যে টিকা, তা প্রয়োগে প্রাথমিক স্তরে রয়েছি। সরকার ইতোমধ্যে গণটিকা কার্যক্রম শুরু করলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অত্যন্ত কম। অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবীত করতে যেখানে ছয় মাসের মধ্যে দেশের ৮০ ভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা জরুরী, সেখানে আমরা এখনো এক তৃতীয়াংশ মানুষকে টিকা দিতে পারিনি। আর যেভাবে বিভিন্ন দেশ থেকে দেনদরবার করে টিকা সংগ্রহ করা হচ্ছে, তাতে দুই ডোজ করে টিকা কার্যক্রমের কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছতে কারো কারো মতে এক দশকের বেশি সময় লেগে যাবে। টিকা কার্যক্রম সম্পন্ন করতে যদি এত দীর্ঘ সময় লেগে যায়, তাতে আমাদের অর্থনীতির দুরবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাও করা যায় না। বিষয়টি সরকার যে জানে না তা মনে করার কারণ নেই। সরকার ভালভাবেই অবগত। অথচ সরকারের হাতে টিকা কার্যক্রমে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে এগিয়ে থাকার সুযোগ ছিল। সে সুযোগটি হেলায় হারিয়েছে। টিকার ক্ষেত্রে এক দেশ নির্ভরতাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন হুশ ফিরেছে, ততদিনে দেরি হয়ে গেছে। যখন চীন, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপানসহ অন্যান্য উৎস থেকে টিকা সংগ্রহের জোর তৎপরতা শুরু করে তখন প্রচ্ছন্নভাবে টিকা রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। তবে এর মধ্যেও চীন ও রাশিয়ার সাথে যৌথভাবে টিকা উৎপাদনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। চীন ইতোমধ্যে সব প্রস্তুতি নিয়ে যৌথ উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। প্রস্তাবটি গ্রহণ করতে সরকার কেন এত বিলম্ব করছে, তা বোধগম্য নয়। অথচ অর্থনৈতিক কার্যক্রম গতিশীল করার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বিপুল টিকা সংগ্রহ এবং তার প্রয়োগের বিকল্প নেই। যৌথ উৎপাদনে গেলে টিকার জন্য যেমন বিভিন্ন দেশের কাছে ধর্না দিতে হবে না, তেমনি জনগণকে দ্রæত টিকা দিয়ে রফতানিরও সুযোগ হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনা সহসা বিদায় নেবে এ ধারণা এখন উন্নত বিশ্বও পোষণ করে না। তারা করোনাকে সঙ্গে নিয়েই অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালানোর পথে হাঁটছে। আমাদেরও এ পথে হাটা ছাড়া উপায় নেই। এজন্য করোনা মোকাবেলা গণটিকা গতিশীল করে যেখানে যে ব্যবস্থা নেয়া দরকার তার সব প্রস্তুতি নিয়েই অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনৈতিক


আরও
আরও পড়ুন