Inqilab Logo

সোমবার, ২৪ জুন ২০২৪, ১০ আষাঢ় ১৪৩১, ১৭ যিলহজ ১৪৪৫ হিজরী

বজ্রপাতে প্রাণহানি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৬ আগস্ট, ২০২১, ১২:০৭ এএম

প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যহীনতাসহ জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে বজ্রপাতে প্রাণহানির সংখ্যা ক্রমে বেড়ে চলেছে। বছরে শত শত মানুষ বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে। বজ্রপাতে অভাবনীয় বিয়োগান্তক ঘটনাও ঘটছে। বুধবার চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু এবং আরো ৯ জন আহত হয়েছে বলে গতকাল প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়। এর আগের রাতে কিশোরগঞ্জের নিকলিতে হাওরে মাছ ধরতে গিয়ে বজ্রপাতে ২ নিহত ও আরো কয়েকজনের আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণার পাশাপাশি বজ্রপাত কমিয়ে আনতে তালগাছ রোপণের মত প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। ব্যাপকহারে বৃক্ষ কর্তনের ফলে পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে তা নিরসনে পরিকল্পিত বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে পরিকল্পিতভাবে তালগাছ রোপণের একটি জাতীয় পরিকল্পনার কথা জানা গেলেও গত ৫ বছরেও তা আদতে তেমন দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। প্রাকৃতিক সনাতন পদ্ধতি হিসেবে তালগাছ দীর্ঘমেয়াদে বজ্রপাত নিরোধসহ প্রাকৃতিক পরিবেশ ও অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হলেও ক্রম বর্ধমান মৃত্যুর করাল গ্রাস এই বজ্রপাত থেকে মানুষকে বাঁচাতে আরো কার্যকর প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। বিশেষত বজ্রপাতের কয়েকদিন বা কয়েক ঘন্টা আগে মানুষকে সতর্ক করার ব্যবস্থাকে যুযোপযোগীকরণ এবং বজ্রপাত নিরোধক পোল বসিয়ে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বহুলাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

ডিজিটাল বাংলাদেশে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ ঘোষণা করে এর প্রতিবিধানে তালগাছ রোপণ কর্মসূচি নিয়েই বসে আছে সরকার। চলতি বছরের এ পর্যন্ত বজ্রপাতে ২৭২ জনের মৃত্যু ঘটেছে বলে গতকাল রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও বজ্রপাতে মৃত্যুর সব খবর গণমাধ্যমে আসেনা, এ কারণে বজ্রপাতে মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা আমাদের জানা নেই। সরকারি হিসাবে গত এক দশকে বজ্রপাতে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গত জুনমাসে একটি বেসরকারি সংস্থার দেয়া তথ্যে বলা হয়েছে, গত দেড়মাসে বজ্রপাতে দেশে ১৮০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বর্ষাকালে গড়ে প্রতিদিন এর অর্ধেক সংখ্যক মানুষও যদি বজ্রপাতে মারা যায় তাহলেও বছরে সহস্রাধিক মানুষ মারা যাচ্ছে। বন্যা-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাধারণ মানুষের প্রাণহানির সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হলেও বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। বজ্রপাত ও বজ্রপাতজনিত মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ার পেছনের কারণগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। আধুনিক প্রযুক্তিগত সহায়তা নিয়ে আমাদের গতানুগতিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে হবে। বজ্রপাতসহ বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাসের পুরাতন পদ্ধতি বদলে বজ্রপাতের সুনির্দ্দিষ্ট সতর্কীকরণ বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া দরকার। সম্ভাব্য বজ্রপাতের সময়টাতে মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে পারলে বজ্রপাতে প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব। হাওর ও নদীতে মাছধরা এবং কৃষিখামারে কর্মরত লোকেরাই বেশি সংখ্যক বজ্রপাতের শিকার হওয়ায় বজ্রপাতের কারণে দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। বিনামেঘে বজ্রপাতের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় একই স্থানে একসঙ্গে ১৭ জনের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল, বজ্রপাত দেশের সব মানুষের জীবনকে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে।

বিশ্বের অন্যতম বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর আন্তর্জাতিক তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিক্রিয়ায় সারাবিশ্বেই বজ্রপাতের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে গেলেও সেটেলাইট ও উন্নত প্রযুক্তির থান্ডারর্স্টম ডিটেকটিভ সেন্সরের মাধ্যমে বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিয়ে প্রাণহানি কমিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে। কয়েক বছর আগে ২০ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের ৮টি অঞ্চলে আটটি ডিটেক্টিভ লাইটেনিং সেন্সর বসিয়েছে আবহাওয়া অধিদফতর। প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, প্রতিটি সেন্সরের আড়াইশ কিলোমিটার এলাকা কভার করার ক্ষমতা থাকায় ৮টি সেন্সর যন্ত্রে দেশের অধিকাংশ এলাকার বজ্রপাতের পূর্বাভাস দিতে সক্ষম হওয়ার কথা। কিন্তু এসব সেন্সর যন্ত্রের যথাযথ মনিটরিং এবং সতর্কবার্তা সাধারণ মানুষের কাছে সময়মত পৌঁছে দেয়ার কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বজ্রপাত সতর্কতা ও পূর্বাভাস ব্যবস্থায় পরিবর্তনের পাশাপাশি বজ্রপাত নিরোধ ব্যবস্থা ও আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা থাকলেও তার বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না। দেশের মোবাইলফোন অপারেটরদের টাওয়ারগুলোতে আর্থিং পদ্ধতি সংযোজনের পাশাপাশি বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোতে লাইটেনিং অ্যারেস্টার বসানোর কথা বেশ কয়েক ছর ধরে বলা হলেও আদতে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। শুধুমাত্র পূর্বাভাস ও সতর্কিকরণ ব্যবস্থা জোরদার করে বজ্রপাতে মৃত্যু অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। আধুনিক প্রযুক্তিগত সময়োপযোগী পরিকল্পনাগুলোকে আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মুক্ত করে এখনই কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। হাওরে এবং মাঠে কাজ করা কৃষিশ্রমিক, জেলে এবং পথচারীদের বজ্রপাত সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। বজ্রপাতপ্রবণ এলাকায় কংক্রিটের তৈরি বজ্রপাত আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোতে বজ্রপাত সতর্কিকরণ অ্যাপ চালু হয়েছে। বজ্রপাতের আশঙ্কা দেখা দেয়ার আধাঘন্টা-একঘন্টা আগেই অ্যাপের মাধ্যমে সতর্ক সংকেত পাচ্ছে মানুষ। আবহাওয়া অধিদফতরের সতর্কিকরণ ব্যবস্থায় বজ্রপাতের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। রেডিও-টেলিভিশনের পাশপাশি বিভিন্ন দেশের মত মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে বজ্রপাত সতর্কিকরণ ও নিরাপত্তামূলক সচেতনতা জোরদার করার কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বজ্রপাত

১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন