পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১ জুলাই থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের যাত্রা শুরু হয়েছে। ৩০ জুন সংসদে কন্ঠ ভোটে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেট পাস হয়। ‘জীবন-জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে অর্থমন্ত্রী আ.হ ম মুস্তাফা কামাল বাংলাদেশের ৫০ তম বাজেট গত ৩ জুন জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেন। কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে গতবারের মতো এবারও সংসদে বাজেট নিয়ে আলোচনা হয় সীমিত আকারে। এর মধ্যে বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেট পাশ হয় ৭ জুন। নতুন অর্থবছরের বাজেট ব্যয় বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১২ শতাংশ বেশী, যা জিডিপির ১৭.৫ শতাংশের সমান। এ বারের বাজেট উন্নয়ন ব্যয় ২ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। আর পরিচালন ব্যায় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারী কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধে প্রায় ৭০ হাজার কোটি এবং সুদ পরিশোধে ৬৮ হাজার কেটি টাকা ব্যয় ধরা হয়। বাজেটে রাজস্ব খাত থেকে আয় প্রাক্ষলন করা হয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে (এনবিআর) মাধ্যমে ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে। তাই আয়কর ও ভ্যাট মিলিয়ে ২ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এনবিআরকে। এদিকে বাস্তবায়নের প্রথম দিনেই ভ্রমনখাত থেকে ১ হাজার ৬৬ কোটি টাকা ব্যয় স্থগিত করা হয়। সরকার সারাদেশে ১ জুলাই থেকে কঠোর লকডাউন দিয়েছে। এসময় সরকারী আধাসরকারী, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারী অফিস, শপিংমল, মার্কেটসহ সবধরনের দোকানপাট বন্ধ আছে। সড়ক, রেল ও নৌপথের পরিবহনসহ জরুরি পরিবহন বাদে সবধরনের যন্ত্রচালিত যানবাহন বন্ধ আছে। এ কঠোর লকডাউন নিয়েই অর্থবছরটি শুরু হয়েছে। গত অর্থ বছরটি সাধারন মানুষ পার করেছে জীবন জীবিকার সাথে যুদ্ধ করে। ২০২১-২২ অর্থবছরটিও শুরু হয়েছে করোনার সংক্রমণ ঠৈকাতে কঠোর বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে।
করোনা নিয়ন্ত্রনে সরকারের কঠোর লকডাউনে নতুন অর্থবছরের যাত্রাতেই অর্থনীতির অঙ্গনে স্থবিরতা নেমে এসেছে। সবধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে চলতি অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আহরন খুবই কঠিন হবে। আয় না করতে পারলে ব্যয় করতে পারবে না।
সরকারী তথ্য মতে, আমাদের প্রবৃদ্ধি আগে ছিল ৭ শতাংশ। এখন সেটির ৫ শতাংশ। প্রবৃদ্ধি খুব একটি কমেনি। করোনার প্রভাবে অনেক দেশের তুলনায় আমরা ভাল থাকলেও অর্থনীতিতে বৈষম্য অনেক বেড়েছে। বড় লোকেরা অনেক টাকা উপার্জন করছে, আর গরীবেরা আরও গরীব হচ্ছে। দরিদ্রের হার ছিল ২০ শতাংশ। এখন সেটি হয়েছে ৪০ শতাংশ। বেসরকারী খাতে নতুন কোন বিনিয়োগ হচ্ছে না। কর্মসংস্থানও বাড়ছেনা, ফলে বেকারত্ব বেড়েই চলেছে আমাদের গার্মেন্ট সেক্টর একটু ভাল আছে। সেটি আন্তর্জাতিক অর্থনীতি রিকোভারির কারণে। আমাদের অর্থনীতিতে যেটুকু প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে তা মূলত কয়েকটি খাত থেকে এসেছে। তার মধ্যে কৃষি, রেমিট্যান্স ও গার্মেন্ট খাতই প্রধান। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ খাত সার্ভিসখাত। এ সেস্টর প্রায় অচল অবস্থায় আছে। যেমন হোটেল, রেস্তোঁরা বন্ধ, পরিবহন বন্ধ, পর্যটন বন্ধ। এসব খাতে প্রচুর শ্রমিক কাজ করে। তারা এখন বেকার। সরকার ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা দিয়েছে তাও সঠিকভাবে বন্টন হয়নি। এখানে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হয়েছে। এসব বিবেচনায় চলতি বাজেটে ক্ষুদ্র, মাঝারি উদ্যোক্তা শ্রেণীসহ সেবা খাতের প্রতি বিশেষ নজর রাখা উচিত।
কয়েক মাস ধরে করোনা সংক্রমণের মধ্যেও আমাদের দেশে অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রায় স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। কিন্তু গত এপ্রিলে ভারতে করোনায় দ্বিতীয় ঢেউ দেখা দেয়। একই সময়ে বাংলাদেশে সংক্রমণের হার বেড়ে যায়। ফলে সরকার কঠোর লকডাউন জারি করে। তবে চলমান লকডাউনে শিল্প প্রতিষ্ঠান ও রপ্তানি কার্যক্রম চালু রয়েছে। ফলে ব্যাংকও খোলা রাখতে হচ্ছে। তবে জেলা শহরগুলোতে অর্থনৈতিক কার্যক্রমে প্রভাব পড়ছে। লকডাউনের কারণে আম চাষীরা দুর্দশায় আছে। রাজশাহী, সাতক্ষীরা, রংপুর, যশোর এলাকাসহ সীমান্তবর্তী এলকায় করোনা সংক্রমণের হার অত্যধিক বেড়ে যাওয়া এবং লকডাউনের কারণে মানুষ ঘর থেকে বেড় হতে পারছেনা। ফলে আমসহ মৌসুমী ফলের বাজার ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এদিকে কয়েকদিন পর ঈদুল আজহা। ঈদ সামনে রেখে লাখ লাখ খামারি গরু মোটাতাজা করে থাকে। এসব গরু তারা প্রত্যাশিত দামে বিক্রি করতে পারবে না। এমনকি দাম কমিয়ে ও পর্যাপ্ত সংখ্যক গরু বিক্রি করা যাবে না। করোনার প্রভাব ও কঠোর লকডাউনে কোরবানীর পশু চলাচল ও বেচাকেনা নিয়ে অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতেরর তথ্য মতে, কোরবানীর জন্য এবার ১ কোটি ১৯ লাখ পশু প্রস্তুত রয়েছে। খামারি ও বিভিন্ন গরু, ছাগল, ভেড়া ও উটের বিশাল উৎপাদন এবার হয়েছে। কিন্তু তারা যে লাভের আশায় বছর ধরে পশুগুলো পালন করে আসছে, সেই কাক্সিক্ষত লাভ নাও পেতে পারেন। লকডাউনে সবচেয়ে বেশী লোকসানে পড়তে পারে ইলেকট্রনিক্স পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। কোরবানীর ঈদের আগে প্রতিবছর লাখ লাখ ফ্রিজ, টিভিসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের চাহিদা থাকে। কোরবানীকে ঘিরে অর্থনীতির বিরাট একটি অংশ আবর্তিত হয়। প্রচুর পণ্যের হাত বদল হয়। অর্থনীতিতে আমেজ তৈরী হয়। লকডাউনে ও করোনার সংক্রমণের কারণে এবার সেই মাত্রায় পণ্য বিক্রি নাও হতে পারে। দেশীয় বাজারে পোশাক ও জুতার মতো পণ্য বিক্রিও কম হতে পারে। পর্যটন খাততো বন্ধই আছে। তাছাড়া বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে যেসব আর্থিক কর্মকান্ড চলত সেগুলোও মুখ থুবড়ে পড়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা এতে বিশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। করোনা যেভাবে সংক্রমিত হচ্ছে তাতে মানুষ বিনিয়োগে আগ্রহ হারাবে। কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে না। করোনার নতুন মাত্রার সংক্রমণ বাড়তে থাকলে তার প্রতিকারে শুধু লকডাউন দিয়ে লাভ হবেনা। বরং তাতে মানুষের মনে হতাশা সৃষ্টি হতে পারে। এ অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে আমাদের টিকাদান কর্মসূচীকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হবে, ব্যপক হারে মাস্ক বিতরনসহ তা ব্যাবহারে জনগণকে সচেতন করতে হবে। দ্রæত ভ্যাকসিন আমদানী করে টিকাকর্মসূচি জোরদার করতে হবে। প্রতিদিন গড়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষকে টিকা দিতে হবে। চলমান বাজেট বাস্তবায়ন নির্ভর করছে ব্যাপকহারে টিকার ব্যবহারের উপর। করোনার সংক্রমণ কমিয়ে এনে মানুষের জীবন স্বাভাবিক করার উপরও বাজেট বাস্তবায়ন নির্ভর করছে। দেশ থেকে যেসব শ্রমিক বিদেশে যাওয়ার জন্য চেস্টা করছে তাদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিক ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত। এ মুহূর্তে দেশে প্রায় ৫০ হাজার জনবল বিদেশগামীর অপেক্ষায় আছে। তাদেরকে দ্রততম সময়ে টিকার ব্যবস্থা করে রেমিট্যান্স প্রবাহের গতি ঠিক রাখা উচিত। এদিকে অর্থবছরের শুরুতে দেশের প্রায় ১০টি জেলায় বন্যা শুরু হয়েছে। বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে, মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রানালয়কে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
বাজেট পেশের পর বিভিন্ন মহল থেকে সংশোধনী প্রস্তাব আসে। প্রতিবছরের মতো অর্থমন্ত্রী কিছু প্রস্তাব মেনে নেন। বাজেট প্রস্তাবে নগদ টাকা শিল্প বিনিয়োগ, পূঁজি বাজার, ফ্ল্যাট, ব্যাংক আমানতসহ কয়েকটি খাতে কলো টাকা সাদা করার প্রস্তাব করা হয় এতে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজরা উৎসাহিত হবে। কেননা যেসব করদাতা সঠিক আয়ের হিসাব দেয়, তাদের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কর দিতে হয়। আর যারা সঠিক হিসাব না দিয়ে কর ফাঁকি দিচ্ছেন তারা ১০ শতাংশ কর জরিমানা দিয়ে কলো টাকা সাদা করেন, এটি যেমন অনৈতিক তেমনি সৎসরদাতাদের প্রতি অবিচারও বটে। অর্থমন্ত্রী কালোটাকা সাদা করার ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ জরিমানা ধার্য্য করেছেন। বাজেটে অর্থমন্ত্রী আরও কয়েকটি বিষয়ে ছাড় দিয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের (এমএফএস) ওপর আরোপিত বাড়তি কর প্রত্যাহার। ৫০ হাজারের বেশি টাকার কাঁচামাল কিনলে চেকে লেনদেনের যে বিধানের প্রস্তাব করা হয় তা বাদ দিয়ে এই সীমা ৫ লাখ টাকা করা হয়। বেতন ১৫ হাজার টাকার বেশি হলে ব্যাংকের মাধ্যমে দেওয়ার যে প্রস্তাব করা হয়েছিল তা সংশোধন করে ২০ হাজার টাকা করা হয়েছে। এসব সিদ্ধান্ত ইতিবাচক বলে মনে করি। ‘জীবন ও জীবিকার প্রাধান্য দিয়ে আগামীর পথে বাংলাদেশ’ গড়ার যে অঙ্গীকার নিয়ে অর্থবছর শুরু হয়েছে, তা পূরণ হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে বাজেট বাস্তবায়নের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ওপর। বাজেট যত গণবান্ধব হোক না কেন তা বাস্তবায়ন করতে না পারলে কোন লাভ নেই। জনগণের নূন্যতম সুফল নিশ্চিত করতে হলে এর বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট বিভাগ সমূহকে জবাব দিহিতার আওতায় আনতে হবে। বাজেট ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হলে সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিতে হবে।
লেখক: অর্থনীতিবিদ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।