পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের পর্যায়ে যাওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। একদা যে দেশ তলাহীন ঝুঁড়ির অখ্যাতি লাভ করেছিল, সে দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ, এটা মোটেই কম বড় অর্জন নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, এখনো অনেক ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। আমাদের মন-মানসিকতারও তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। ফলে বিশ্বে এখনো যেসব দেশ হতদরিদ্র কিংবা যুদ্ধে বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপর্যস্ত সেসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের নামও এক সারিতে স্থান পাচ্ছে। একথা স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা এখনো আমাদের বিপুল সংখ্যক কর্মপ্রত্যাশীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারিনি। প্রতিবছর অন্তত ২০ লাখ নতুন কর্মপ্রত্যাশীর আগমন ঘটছে। অথচ মাত্র কয়েক লাখের বেশি কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বিদেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যাও প্রত্যাশার তুলনায় কম। ফলে প্রতিবছরই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে এবং ইতোমধ্যে তা কয়েক কোটিতে পৌঁছেছে, যার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শিক্ষিত। এই শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকাররা কর্মের অভাবে বেদিশা হয়ে পড়েছে। সরকারের শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিভাগে হাজার হাজার পদ শূন্য আছে। এসব পদে নিয়োগ হলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমতো। অথচ সরকারি নিয়োগ বলতে গেলে বন্ধ। যা হচ্ছে তার জন্যও চাকরিপ্রার্থীকে ঘুষ-দুর্নীতির অসহায় শিকার হতে হচ্ছে। যাদের দলীয়বল, অর্থবল, আত্মীয়বল নেই, তাদের চাকরি পাওয়া সোনার হরিণ পাওয়ার শামিল। বেসরকারি পর্যায়েও চাকরির বাজারে চলছে বড় রকমের আকাল। বিনিয়োগ তেমন নেই। শিল্পকারখানা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও সেরকম বাড়ছে না। ফলে চাকরির বাজারে বিরাজ করছে চরম মন্দাবস্থা। এহেন নাজুক অবস্থায় চাকরিপ্রত্যাশী হাজার হাজার তরুণ নিরূপায় হয়ে বিদেশে চাকরি পেতে এমন কোনো অবৈধ ও বিপদসংকুল পথ নেই, যা অবলম্বন করছে না। তারা পৈত্রিক জমিজিরাত বিক্রি ও ঋণ-দেনা করে বিদেশে অনিশ্চয়তার পথে পা বাড়াচ্ছে। একটি চাকরি ও উন্নত জীবনের প্রত্যাশায় তারা দেশি-বিদেশি মানব পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে অর্থকড়ি থেকে শুরু করে জীবন পর্যন্ত হারাচ্ছে। আফ্রিকা থেকে ইউরোপে যাওয়ার একটি রুট ভূমধ্যসাগর। এই সাগরে প্রায়ই অভিবাসন প্রত্যাশীদের সলিল সমাধি ও বিভিন্ন দেশের কোস্ট গার্ডের হাতে ধরা পড়ার বা উদ্ধার হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছে। সর্বশেষ গত শনিবার তিউনিশিয়ার উপকূলে একটি নৌকা ডুবিতে ৪৩ জন নিখোঁজ হয়, যাদের মধ্যে বাংলাদেশিও ছিল। তাদের সবারই মৃত্যু হয়েছে বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে। এর আগে ২৪ জুন সাগর থেকে ভাসমান অবস্থায় তিউনিশিয়ান কোস্টগার্ড ২৬৭ জনকে উদ্ধার করে, যাদের ২৬৪ জনই বাংলাদেশি। যারা মারা যায় কিংবা উদ্ধারপ্রাপ্ত হয়, তাদের মধ্যে সাধারণত মিশর, সিরিয়া, সুদান ইরিত্রিয়া, আইভেরিকোস্টসহ প্রভৃতি দেশের নাগরিক দেখা যায়। এদের সঙ্গে বাংলাদেশের নাগরিকদেরও দেখা যায়।
মিসর অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির দেশ, সিরিয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত, সুদান সংঘাতময়, ইরিত্রিয়া ও আইভোরিকোস্ট অতিদরিদ্র। এসব দেশের পাশাপাশি বা একই সঙ্গে উচ্চারিত হচ্ছে বাংলাদেশের নাম। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যখন এসব খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়, তখন বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা বলতে আর কিছু থাকে না। উন্নয়নশীল দেশ উন্নীত হওয়ার কথা তখন পরিহাসতুল্য বলেই মনে হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে ব্রান্ডিং করার চেষ্টা যখন চলছে জোর কদমে, যখন বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রেই বিশ্বে রোল মডেল, তখন এসব খবর অত্যন্ত ব্যতিক্রম ও অসম্মানজনক। চাকরি ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন যেন বাংলাদেশের তরুণদের একাংশকে উন্মাতাল তুলেছে। গত কয়েক বছরে ভূমধ্যসাগরে তাদের করুণ পরিণতিই তার সাক্ষ্য বহন করে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্যমতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সাড়ে ৫ হাজার বাংলাদেশিকে ভূমধ্যসাগর থেকে উদ্ধার করেছে সংস্থাটি। অন্য এক তথ্যে জানা গেছে, এমুহূর্তে তিউনিশিয়ান কোস্টগার্ড যাদের সাগর থেকে উদ্ধার করেছে তাদের মধ্যে কমপক্ষে ৭৫০ জন বাংলাদেশি রয়েছে। যারা সাগরে ডুবে মারা গেছে তাদের কতজন বাংলাদেশি তার সঠিক সংখ্যা জানা যায় না। শুধু আফ্রিকা থেকে ইউরোপ নয়, অন্যান্য রুট হয়েও ইউরোপ বা আমেরিকায় যাওয়া থেমে নেই। এই চাকরি বা অভিবাসন প্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশিরাও আছে। তাদের বন-জঙ্গল, দুর্গম পথ, মরুভূমি পাড়ি দেয়ার এবং পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকের মমার্ন্তিক পরিণতির কথা মিডিয়া প্রকাশিত হয়েছে। অনেকেরই জানা, কয়েক বছর আগে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে কয়েকশ’ বাংলাদেশির সলিল সমাধি ঘটে। তখন বিশ্বমিডিয়ায় এনিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। অনুরূপভাবে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে শত শত বাংলাদেশির গণকবর আবিষ্কৃত হওয়ায় অনুরূপ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। থাইল্যান্ডে বাংলাদেশিদের আটকে রেখে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় ইত্যাদির কথাও তখন শোনা যায়। অন্যান্য দেশে এভাবে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায়ের কথাও জানা যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জেলখানায় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে বহু বাংলাদেশি আটকা আছে। এসব তথ্য ও খবর বাংলাদেশ ও জাতি হিসেবে বাংলাদেশিদের জন্য মোটেই সম্মান ও গৌরব বহন করে না। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, দেশি-বিদেশি মানব পাচারকারী চক্র এখানে খুবই সক্রিয়। তারা অসহায়, কর্মপ্রত্যাশী ও স্বপ্নবিলাসী তরুণদের খুঁজে বের করে মোটা অংকের টাকার বিনিয়োগ নানা পথে বিদেশে পাচার করে দিচ্ছি। এই চক্রকে দমন করতে না পারলে মানবপাচার বন্ধ হবে না। তাদের আরো অভিমত, দেশে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশে কর্মসংস্থান সহজ এবং স্বচ্ছ করতে হবে। এই সঙ্গে, ব্যাপকভাবে প্রচার প্রচারণা চলাতে হবে যাতে কেউ মানব পাচারকারীদের পাল্লায় পড়ে সর্বস্বান্ত ও জীবন বিপন্ন না করে।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষাসহ সরকারের বিভিন্ন বিভাগে বহু পদ খালি আছে। সেগুলো দ্রুত পূরণ করলে বহু শিক্ষিত তরুণের কর্মসংস্থান হতে পারে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাপক বিনিয়োগই ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। এজন্য বিনিয়োগকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। যে কোনো মূল্যে দেশি সরকারি ও বেসরকারি বিনিয়োগ, বিদেশি বিনিয়োগ ও সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশে বিনিয়োগের অনূকূল পরিবেশ আছে। চলমান অতিমারি করোনার সময় ও গার্মেন্টসহ রফতানিমুখী পণ্যের উৎপাদন সচল আছে। এখানে শ্রম সস্তা, গ্যাস, বিদ্যুৎ জ্বালানির দাম অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য বিনিয়োগ লাভজনক। বঙ্গবন্ধু শিশুপার্কসহ সরকারের ঘোষিত শিল্প ও অর্থনৈতিক এলাকা দ্রুত প্রতিষ্ঠিত ও উৎপাদনে গেলে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থান হবে। জাপান, চীন, সউদী আরবসহ বিভিন্ন দেশ এবং ইউরোপ ও আমেরিকার বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী। তাদের আগ্রহ বাস্তবে রূপ পেলে কর্মসংস্থানে রীতিমত বিপ্লব ঘটবে। তখন বিদেশে যাওয়ার আগ্রহ অনেকেরই থাকবে না। অন্যদিকে এই অতিমারি কমে গেলে আগামীতে বিদেশে জনশক্তি রফতানির সুযোগ বাড়বে। সে সুযোগ নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে হবে। বিদেশের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ জনশক্তি যোগান দিতে হবে। জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সকল অনিয়ম, দুর্নীতি, প্রতারণা দূর করতে হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে বিদেশ চাকরিপ্রত্যাশীরা ভূয়া আদম ব্যাপারী ও মানব পাচারকারীদের কবলে পড়বে না। একটি দেশের ভাবমর্যাদা তার নাগরিকদের আচার-আচরণ, স্বভাব ও আত্মসম্মানবোধের ওপর নির্ভর করে। দেশের বস্তুগত ও স্তরগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের এসব ক্ষেত্রে উপযুক্ত ও মানানসই উন্নতি হওয়া অপরিহার্য।
সংশোধনী
------------
আজ প্রকাশিত দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদকীয়-এর শেষের প্যারায় মুদ্রনজনিত ভুলের কারণে ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্প নগর’-এর স্থলে বঙ্গবন্ধু শিশুপার্ক ছাপা হয়েছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।