চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
বেলাল নিজের স্ত্রীকে নিয়ে গেছেন সিলেটের কোন এক পর্যটন এলাকায়। বিকেলে। বেড়াতে। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে খোশগল্পে ব্যস্ত। সেখানে অন্যান্য পর্যটকদের ভীড়ে আতিকের পূর্ব পরিচিত কেউ একজন (বিয়ের ব্যাপারে অবগত নয়) সে তার সাথে থাকা বন্ধুকে চোখের ইশারায় আতিককে দেখিয়ে বলছে-ও-ই দেখছিস সে তাঁর মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে ডেটিংয়ে এসেছে। কত বড়....!
পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেলাল গত জুলাই মাসে একাকিত্ব জীবনের অবসান ঘটিয়ে দাম্পত্যজীবনে পা রাখে। এ রকম ঘটনা হরদম ঘটছে। রীতিমতো মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। গল্প, গুজব, আড্ডা যত যাই হোক। সর্বত্রই অন্যের দোষচর্চা। অন্যের দুর্নাম, মিথ্যা অপবাদ দেওয়া। জানাশোনা-পরিচয় নেই কিছুই। তবুও একজনকে যাচ্ছেতাই বলা হচ্ছে। যিনি বলছেন তার পাপবোধ নেই। বিবেকে বাধে না। যারা শুনছেন তারাও কিছু বলেন না। বক্তার সঙ্গে তাল মেলান। অথচ অন্যের নামে মিথ্যা দোষারোপ করা জঘন্য গোনা। কারও সম্মানহানি করার অধিকার অন্যের নেই।
এক জীবনে যা চাই, তার সবই সাজানো রয়েছে কোরআনের পরতে পরতে। সুস্থ সুন্দর সুখী পরিতৃপ্ত জীবনের জন্য যা প্রয়োজন, পাতায় পাতায় রয়েছে তারই দিক-নির্দেশনা। ইসলামে মিথ্যা দোষারোপের সুযোগ নেই। এটা ঘৃণিত অপরাধ। শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর পাশাপাশি মানুষের ভেতরের খারাপ দিকগুলোর জন্য শাস্তি ঘোষণা এসেছে। এসব পরিত্রাণের উপায়ও বলে দিয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, তোমরা মিথ্যা কথন থেকে দূরে থাক (সুরা আল হজ্জ, আয়াত-২৩)। আল্লাহ বলেন, যারা বিনা অপরাধে বিশ্বাসী পুরুষ ও নারীদের কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে (সুরা আহ্যাব,আয়াত-৮৫)। মিথ্যা অপবাদে মানুষের সম্মানহানি ঘটে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে সম্মানহানি করা থেকে বিরত থাকে, আল্লাহ তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্ত করা নিজের জন্য অপরিহার্য করে নেন’ (আহমাদ, তাবারানী)। আবার কেউ অন্যায়ভাবে তার মুসলমান ভাইয়ের মান-ইজ্জত খাটো করলে তার সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে যদি এমন স্থানে লাঞ্ছিত করে যেখানে তার মানহানি ঘটে এবং সর্বদা খাটো করা হয়, আল্লাহ তাকে এমন স্থানে লাঞ্ছিত করবেন, যেখানে তার সাহায্যপ্রাপ্তির আশা ছিল’ (আবু দাউদ)।
দোষারোপ করা, কারও দুর্নাম করা তো দূরের কথা, কারও সম্পর্কে কিছু প্রমাণ ছাড়া বলাও যাবে না। অহেতুক মানুষকে দোষারোপ করা সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মুমিনদের প্রতি তোমরা ভালো ধারণা পোষণ করবে। অনুমান করেও কিছু বলা যাবে না। কারণ আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ, তোমরা অধিকাংশ অনুমান থেকে দূরে থাক। কারণ অনুমান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাপ (সুরা আল হুজরাত, আয়াত-১২)। কিছু পাপের কোনো কাফফারা হয় না। কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া তেমনই একটি পাপ।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, পাঁচটি পাপ এমন, যার কাফফারা নেই। তার মধ্যে তৃতীয়টি হলো, কোনো মুমিনকে অপবাদ দেওয়া (মুসনাদে আহমদ)। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে এমন দোষে দোষারোপ করবে, যা থেকে সে মুক্ত। আল্লাহ তাকে রাদগাতুল খাবাল নামক জাহান্নামের গর্তে বাসস্থান করে দেবেন, যতক্ষণ সে অপবাদ থেকে ফিরে না আসে (আবু দাউদ)। তাই কথা বলার সময় সতর্ক থাকা দরকার। কম কথা বলা উত্তম। হাদিসে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিহবাকে সংযত রাখতে বলেছেন।
এ পর্যায়ে অপবাদ ও অপপ্রচার নিয়ে কোরআন যা বলছে তা হলো -‘আর যদি তোমরা এক স্ত্রীর বদলে অন্য স্ত্রী গ্রহণের সিদ্ধান্ত নাও এবং প্রথম স্ত্রীকে প্রচুর অর্থবিত্ত দিয়ে থাকো, তবে তা থেকে কিছুই ফিরিয়ে নেবে না। তোমরা কি মিথ্যা অপবাদ বা জুলমের মাধ্যমে তা ফেরত নেবে?’ (সূরা নিসা ২০)
‘(হে মানুষ শুনে রাখো) কেউ কোন অন্যায় বা পাপ করে পরে তা কোন নির্দোষ ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দিলে, মিথ্যা অপবাদের দায়ভার মুক্ত হয়ে তার পাপের বোঝা আরও ভারী হবে।’ (সূরা নিসা ১১২)
‘দুঃখকষ্টের পর যখনই সত্য অস্বীকারকারীদের কিছুটা অনুগ্রহ আস্বাদনের সুযোগ দেয়া হয়, তখনই ওরা আমার বাণীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচারে লিপ্ত হয়। হে নবী! ওদের বলো, আল্লাহ পরিকল্পিত কৌশল অবলম্বনে (তোমাদের চেয়ে) অনেক অগ্রগামী। (নিশ্চিত থাকো) তোমাদের চক্রান্ত ও অপপ্রচারের পূর্ণ বিবরণ ফেরেশতারা রেকর্ড করছে।’ (সূরা ইউনুস ২১)
‘আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেননি। তাঁর কোন শরিক নেই। যদি শরিক থাকত তবে প্রত্যেক শরিক উপাস্য নিজ নিজ সৃষ্টি নিয়ে আলাদা হয়ে যেত এবং একে অন্যের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের লড়াইয়ে নেমে যেত (আর সৃষ্টির বারোটা বাজত)। ওদের অপবাদ থেকে আল্লাহ পবিত্র, মহান!’ (সূরা মুমিনুন ৯১)
‘যারা বিনা দোষে বিশ্বাসী পুরুষ ও বিশ্বাসী নারীকে কষ্ট দেয়, তারা মিথ্যা অপবাদ ও পাপের বোঝায় ভারাক্রান্ত হবে।’ (সূরা আহজাব ৫৮)
‘হে নবী! বিশ্বাসী নারীরা যখন তোমার কাছে বায়াত বা আনুগত্যের শপথ করতে এসে ঘোষণা করে যে, তারা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না, চুরি করবে না, ব্যভিচার করবে না, নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না, সজ্ঞানে কোন মিথ্যা অপবাদ রটাবে না এবং ঘোষিত ন্যায্য বিষয়ে তোমার নির্দেশ অমান্য করবে না, তখন তাদর বায়াত গ্রহণ করো এবং তাদের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো। আল্লাহ তো অতীব ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা মুমতাহানা ১২)
অপবাদ যাদের কলঙ্কিত করতে পারে না : ‘চরিত্রহীনা নারী চরিত্রহীন পুরুষের যোগ্য আর চরিত্রহীন পুরুষ চরিত্রহীনা নারীর যোগ্য। চরিত্রবতী নারী চরিত্রবান পুরুষের যোগ্য আর চরিত্রবান পুরুষ চরিত্রবতী নারীর যোগ্য। কোন মিথ্যা অপবাদই চরিত্রবানদের কলঙ্কিত করতে পারে না। এদের জন্যে রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক জীবনোপকরণ।’ (সূরা নূর ২৬)
অপবাদ রটনাকারীর শাস্তি : ‘কোন পূতচরিত্রা নারীর বিরুদ্ধে কেউ (ব্যভিচারের) অপবাদ দিয়ে যদি চার জন সাক্ষী উপস্থিত করতে ব্যর্থ হয়, তবে অপবাদ রটনাকারীকে শাস্তি হিসেবে ৮০ বেত মারবে। আর কোনদিন তার সাক্ষ্য গ্রহণ করবে না। এরা সত্যত্যাগী।’ (সূরা নূর ৪)
‘যারা চরিত্রহীনতার মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে, তারা তা তোমাদেরই একটি দল। (কিন্তু এই অপবাদে যাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে) তারা যেন নিজেদের জন্যে বিষয়টিকে ক্ষতিকর মনে না করে। বরং এটা তোমাদের জন্যে কল্যাণকর। (অপবাদ রটনাকারী) প্রত্যেককেই এ পাপের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এদের মধ্যে যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তার জন্যে অপেক্ষা করছে কঠিন আজাব।’ (সূরা নূর ১১)
‘মুনাফেক, রুগ্নমনা ও মিথ্যা গুজব রটনাকারীরা শহরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির কাজ থেকে বিরত না হলে আমি ওদের ওপর তোমাকে কর্তৃত্ব দান করব। তারপর (হে নবী!) খুব অল্প সময়ই ওরা এই নগরে তোমার প্রতিবেশী হিসেবে থাকতে পারবে। অভিশপ্ত অবস্থায় ওদের যেখানে পাওয়া যাবে, পাকড়াও ও বিনাশ করা হবে।’ (সূরা আহজাব ৬০-৬১)। অতএব অপবাদ ও অপপ্রচার থেকে দূরে থাকি, নিজের কল্যাণ সাধিত হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।