শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কুতুবউদ্দিন আহমেদ
আবু হেনা মোস্তফা কামাল গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের একজন শক্তিমান কবি। মাত্র তিনটি কবিতাগ্রন্থের প্রণেতা তিনি; অথচ কবিতার মাঠে তাঁর কী শক্তিশালী অবস্থান! বর্ণাঢ্য ও বহুবর্ণিল কবিজীবন ছিল তাঁর। কর্মজীবনের প্রথমে কলেজের অধ্যাপনা দিয়ে শুরু করেছিলেন। বেশ ক’টি কলেজে তিনি শিক্ষকতা করেছেন; এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাতেও তিনি স্থির থাকতে পারেননি। বারবার তিনি কর্মস্থল পরিবর্তন করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে শুরু করেছিলেন [১৬ মার্চ ১৯৬৩Ñ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৫]; এরপর চলে গেলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজশাহীতে তিনি বেশ কয়েকবছর থিতু হয়েছিলেন। তবে রাজশাহী তাকে সুখী করতে পারেনি। তাঁর অপ্রকশিত একটি লেখায় তিনি লিখেছেন : ‘৬৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাওয়াটা উচিত হয়েছিল কিনা সেটা এখনো ভাবি।’ এবং ‘জীবনের সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অংশ আামি কাটিয়ে এলাম অজ পাড়াগাঁয়। সেখানে কিছু লিখতে পারিনি। লেখার কথা ভাবতেও পারিনি। লোকে কেন লেখেÑ কিংবা আমি একসময় কেন লিখতাম, সব বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।’
আবু হেনা মোস্তফা কামাল ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। রাজশাহী তাঁকে সুখী করতে না পারলেও চট্টগ্রাম ঠিকই পেরেছিল। সেখানে তিনি ছিলেন ১৯৭৮ পর্যন্ত। আত্মস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন, ‘চাঁটগাঁয় আমি ক্রমশ লুপ্ত আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছি। আবার লিখতে শুরু করেছি ক্রমশ।’
চট্টগ্রামে কাটানো সময়টা ছিল আবু হেনার সবচেয়ে উজ্জ্বল সময়। এখানকার সময়টাকে তিনি কাজে লাগিয়েছেন বেশ। এখানে তিনি দুহাতে লিখেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সঙ্গে ঘনিষ্ট ও আন্তরিক সময় কাটিয়েছেন, চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সরব উপস্থিত থেকেছেন। এমনকি চট্টগ্রাম বেতারের বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও অংশ নিয়েছেন। এই চট্টগ্রামে থাকতে থাকতেই তাঁর লেখা গ্রন্থগুলো প্রকাশ হতে থাকে। বলাবাহুল্য তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘আপন যৌবন বৈরী’ [১৯৭৪] এই চট্টগ্রাম থেকেই বের হয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তাঁর দিনগুলো কীভাবে কেটেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন বাংলা বিভাগের তাঁরই এক ঘনিষ্ট ছাত্র নিতাই সেন : ‘ছাত্র সংসদ আয়োজিত সকল অনুষ্ঠানরই মধ্যমণি ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামাল। তাছাড়া সাহিত্য-সংস্কৃতির এবং প্রগতির জোয়ারে আবেগপ্রবণ তরুণ অভিযাত্রী দলেরও তিনি ছিলেন প্রধান কা-ারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো প্রগাঢ় বন্ধুদ্বয় [ড. আনিসুজ্জামান ও কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল] নতুনভাবে নতুন উদ্যমে বাংলা বিভাগ তথা সর্বত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও সংস্কৃতির অচলায়তন ভাঙতে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর মতো তুলে নিলেন এক নৌকার দুটি হাল।’
আবু হেনা মোস্তফা কামাল চট্টগ্রাম থেকে ফিরে [১৯৭৮] এসে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখান থেকে শিল্পকলা একাডেমিতে মহাপরিচালক পদে [১৯৮৪]। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হয়ে যান ১৯৮৬ তে। আমৃত্য তিনি এই বাংলা একাডেমিতেই ছিলেন। ধারণাতীত যে, মাত্র বায়ান্ন বছরের জীবনে একজন মানুষ কত জায়গায় পদচিহ্ন রেখে গেলেন!
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থাকাকালে তিনি অসাধারণ কিছু কাজ করে গেছেন। বাংলা একাডেমিকে তার মৌল অবস্থান অর্থাৎ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন।
প্রারম্ভেই বলেছি আবু হেনা মোস্তফা কামাল পঞ্চাশের দশকের গুরুত্বপূর্ণ কবি। কিন্তু তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থটি বেরিয়েছে ১৯৭৪ এ। অর্থাৎ বোঝা যায় তিনি কবিতা লিখেছেন ঠিক কিন্তু প্রকাশের ব্যাপারে অতোটা তৎপর ছিলেন না। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায় তিনি লেখা শুরু করেছিলেন বাল্যকাল থেকেই। মৃত্যুর পর তাঁর স্মারকগ্রন্থ সম্পাদনাকালে সম্পাদক আবদুল মান্নান সৈয়দের হাতে আসে তাঁর কৈশোরবেলা তৈরি একটি কাব্যগ্রন্থের পা-ুলিপি। পা-ুলিপিটি কবি নিজে তৈরি করেছিলেন ১৯৫৩ সালে। আরও আশ্চর্যের বিষয় যে, ১৯৫০ সালে কবি আশরাফ সিদ্দিকি আর কবি আবদুর রশীদ খান দুজনে মিলে ‘নতুন কবিতা’ শিরোনামে একটি কবিতা সংকলন বের করেছিলেন। সেই সংকলনের কনিষ্ঠতম কবি ছিলেন আবু হেনা মোস্তফা কামালের সমবয়সী কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর কিন্তু কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল সেখানে স্থান পাননি। তবে ৭৪ এ ‘আপন যৌবন বৈরি’ প্রকাশ হওয়ার পর কবি হিসেবে তিনি আলোচনার পাদপ্রদীপে চলে আসেন। এ-গ্রন্থটি প্রকাশের পরপরই স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ করেন ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’। এই পুরস্কারটি তাঁকে কবিতা চর্চায় রীতিমত গতি এনে দেয় এবং উল্লেখ্য যে, সে- বছরই এ পুরস্কারটির প্রবর্তনা শুরু হয়। ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ এর পরিচয়লিপিতে কবি সম্পর্কে বলা হয়েছে : বাংলা সাহিত্যের কৃতি অধ্যাপক এবং বাংলার খ্যাতনামা কবি ড. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এবার [১৯৭৫] ফরিদপুর সাহিত্য-সংস্কৃতি উন্নয়ন সংস্থা ঘোষিত ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৩ মার্চ পাবনা শহরের উপকণ্ঠে গোবিন্দা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পাবনা জেলা স্কুলে। এরপর তিনি যথাক্রমে ঢাকা কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ এম, এ ডিগ্রি লাভ করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি ডিগ্রি পান ১৯৬৯ সালে।
[কবি আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্মগ্রাম গোবিন্দা বর্তমানে সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া থানার অন্তর্ভুক্ত। সে হিসেবে বলতে হয় কবির জন্ম সিরাজগঞ্জ জেলায় ]
আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রায় চল্লিশ বছরের কবি জীবনে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে মাত্র তিনটি : আপন যৌবন বৈরী [১৯৭৪], যেহেতু জন্মান্ধ [১৯৮৪] এবং আক্রান্ত গজল [ ১৯৮৮]। আর এই তিনটি গ্রন্থেই তিনি শক্তিমান কবি হিসেবে বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্থান নিশ্চিত করেছেন।
‘আপন যৌবন বৈরী’র পঞ্চম কবিতাটির শিরোনাম ‘কবি’। কবিতাটিতে একজন প্রকৃত কবির স্বরূপ উদঘাটন করা হয়েছে। তিনি দেখিয়েছেন একজন কবির কবিতা সৃষ্টির কী মর্মান্তিক কাতরতা। জীবনের কতটুকু ব্যয় করে একজন কবি শব্দমালা তুলে আনেন কলমের নিবে; কতটুকু দুঃখ হজম করে কিনে আনেন একেকটি কবিতার প্লট। একেকটি কবিতার সঙ্গে একাকার হয়ে মিশে থাকে কবির সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, ভালোবাসা-ঘৃণা। কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল এই কবিতায় ঈশ্বরকেও কবির খাতায় নাম লিখিয়েছেন; তবে ঈশ্বর সৌখিন কবি, সুখের কবি, সুন্দরের কবি। কিন্তু একজন মানুষ যখন কবি হয়ে ওঠেন; তখন তাকে জীবনের দুঃখ ছেনে, অন্ধকার অলি-গলি চিনে এসে কবি হতে হয়; তার চলার পথ থাকে কণ্টকে ভরা। পাঠকের জ্ঞাতার্থে এই অসাধারণ কবিতাটি উল্লেখ করছি :
ঈশ্বর আপনিও কবি, কবিদের অনেকেই এরকম বলে।
কেননা আপনার হাত পাহাড়ে সূর্যাস্ত আঁকে
আকাশের বিস্তৃত পাতায়
পাখিদের চোখের পাতায় নক্ষত্রের স্বপ্ন লিখে রাখে
এবং আপনার স্বরলিপি মেঘের অর্গানে বাজে প্রথম বাদলে।
এ সবি আমার শোনা কথা। কেননা কখনো এ শহর
ছেড়ে, এই অন্ধকার গলি আর রোয়াকের দুর্বোধ্য কুহক
অস্বীকার করে কোথাও যাইনি, আচ্ছা ,বলুন ঈশ্বর,
কবিতার জন্যে আপনি কোনোদিন যন্ত্রণার জ্বলন্ত নরক
ঘেঁটেছেন? হেঁটেছেন চেনা পথে বারবার, কোনো তরুণীর
মুখ শব্দে ফোটাবেন বলে জেগেছেন অর্থহীন রাত?
তাহলে বলুন কবি, বলুন ঈশ্বর
আপনিও রক্তাক্ত তবে? আপনারো হৃদয়
একটি উপমার জন্যে অনুপম ক্রৃশবিদ্ধ হয়?
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতার স্বাদ নিতে গেলে পাওয়া যায় দার্শনিকতার ঘ্রাণ। কবিতা বয়ানের ফাঁকে ফাঁকে তিনি যেন কখনও-সখনও দার্শনিক হয়ে উঠেছেন। দার্শনিকের চোখে দেখেছেন তিনি মানুষের সাধারণ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য :
মানুষ মানে কি তবে ঘরবাড়ি? ঝকঝকে দেয়াল, মেঝে,
গালিচা, কিংবা ওয়ার্ডরোব?
মানুষ মানে কি তবে গর্বিত দেয়াল আর তোরণে সুদৃশ্য গাড়ি,
সাবধানী কুকুর?
[হাসানের ঘরবাড়ি : যেহেতু জন্মান্ধ]
আবু হেনা মোস্তফা কামালের কবিতায় প্রায়ই ফুটে উঠেছে অচরিতার্থ প্রেমের হাহাকার। কবিতার শব্দে শব্দে খুঁজেছেন হারানো নারীকে। হারানো নারীর খোঁজে তিনি অসংখ্য শব্দের মালা গেঁথেছেন। কখনও তিনি ভুগেছেন নষ্টালজিায়; হারানো বন্ধুর খোঁজে কখনও কাতর হয়েছেন। এমনই হারানো বন্ধুদের খোঁজে মন খারাপ করা কয়টি পঙ্ক্তি :
মধুর রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে
আমরা সবাই চলে গেলাম যে যার পথে
কেউ সচিবালয়ে তোপখানায়,
কেউ ইসলামাবাদে
কেউ প্যারিসে রোমে
অনেকেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে গ্রামে-গঞ্জে
রোঁয়া-ওঠা ইস্কুলে-কলেজে---
দড়ির আগুন থেকে সিগারেট ধরিয়ে
আমরা যারা শীতের রাতে ঘনিষ্ট অভিজ্ঞতার গল্প
বিনিময় করেছি
তাদের কারো সঙ্গে কারো আর যোগাযোগ নেই
কেউ গুলশানে বিশাল বাড়ি রেখে
বনানীর সংক্ষিপ্ত আঁধারেই ঘুমিয়ে পড়েছে
দূরারোগ্য রাজনৈতিক ব্যাধি নিয়ে কয়েকজন গা ঢেকে বেড়ায়
কারো চিবুকে সচ্ছলতার দ্বিত্ব
আবার কেউ তার অতীতের প্রেতচ্ছায়া অভাবে অভাবে
আমার বিশ্বস্ত কোনো আয়না নেই
কার কাছে জানতে চাইব
আমি কি খুবই বদলে গেছি?
মধুর রেস্তোরাঁয় হঠাৎ কোনো পৌষের সকাল ১০টায়
এক পেয়ালা চা কি আগের মতোই মদির!
[মোহানা থেকে ফেরা : আক্রান্ত গজল]
অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আবু হেনা মোস্তফা কামালের জন্ম হয়েছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সেবার জন্য; একজীবনে তিনি সেবা দিয়ে গেছেন। জীবৎকালে তিনি যেখানেই থেকেছেন, যেভাবেই থেকেছেন বাংলা ভাষাকে ভালোবেসেছেন। তাঁর চিন্তা-চেতনায়, ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য, বাংলা ভাষা-ভাষী মানুষ তাই তাঁর কাছে বিশেষ ঋণী; যে ঋণ কখনও পরিশোধযোগ্য নয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।