Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কুষ্টিয়ায় ট্রিপল মার্ডারের দায় স্বীকার এএসআই সৌমেনের, কারাগারে প্রেরণ

কুষ্টিয়া থেকে এস এম আলী আহসান পান্না | প্রকাশের সময় : ১৪ জুন, ২০২১, ৫:৫০ পিএম | আপডেট : ৭:৫৫ পিএম, ১৪ জুন, ২০২১

স্ত্রী আসমা খাতুনের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তা সৌমেন রায়। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সংশোধন না হওয়ায় স্ত্রী ও স্ত্রীর প্রেমিককে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন। রোববার (১৩ জুন) সকালে প্রেমিকের সঙ্গে হাতেনাতে ধরে ফেলার পর নিজের সার্ভিস রিভলবার দিয়ে গুলি করে হত্যা করেন স্ত্রী আসমা খাতুন, আসমা খাতুনের দ্বিতীয় পক্ষের শিশুসন্তান রবিন এবং শাকিল খানকে। হঠাৎ করে খুন নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে ঠান্ডা মাথায় এই ট্রিপল মার্ডার করেন পুলিশ কর্মকর্তা সৌমেন রায়।

সোমবার (১৪ জুন) আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে এসব কথা বলেছেন তিনি।

দুপুর ১টা ১০ মিনিটে কড়া পুলিশ পাহারায় কুষ্টিয়া পুলিশ লাইনের ডিবি কার্যালয় থেকে একটি মাইক্রোবাসে করে এএসআই সৌমেনকে কুষ্টিয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে নিয়ে আসা হয়। এসময় সৌমেনের মাথায় হেলমেট ও হাতে হাতকড়া পরানো ছিল। পরবর্তীতে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. এনামুল হক ১৬৪ ধারায় তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি গ্রহণ করেন। জবানবন্দি রেকর্ডের পর আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

বিকেল সাড়ে ৪টার সময় আবারো কড়া পুলিশ পাহারায় মাইক্রোবাসে করে সৌমেনকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে সেসময় সকাল থেকে গণমাধ্যমকর্মীরা আদালত চত্বরে অপেক্ষার প্রহর গুনলেও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা কুষ্টিয়া মডেল থানার (ওসি) তদন্ত নিশি কান্তা সাহা জবানবন্দির বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তারা দ্রুত আসামিকে নিয়ে আদালত চত্বর ত্যাগ করেন।

ডানে এবং আদালতে নেবার পথে (লাল হেলমেট) খুনি এএসআই সোমেন

পরবর্তীতে গণমাধ্যমকর্মীরা কোর্ট ইন্সপেক্টর আল ইমরানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনিও বলেন, সংশ্লিষ্ট আদালতের ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবেন।

সাংবাদিকরা দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর সংশ্লিষ্ট কোর্টেও পেশকার এম এ আলিম সাংবাদিকদের জানান, জবানবন্দির বিষয়ে তারা কেউ কোনো কথা বলবেন না। জবানবন্দির বিষয়ে কেউ কোনো তথ্য প্রদান না করায় শেষ পর্যন্ত বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে গণমাধ্যমকর্মীরা আদালত চত্বর ত্যাগ করেন।

তবে আদালতের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে জবানবন্দির বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিয়েছেন। সূত্রমতে, আদালতকে সৌমেন জানান, ৪-৫ বছর আগে আসমার মা হাসিনা বেগমের সঙ্গে কুমারখালী থানায় থাকাকালীন একটি মামলা সংক্রান্ত ঘটনায় সৌমেনের পরিচয় হয়। পরবর্তীতে হাসিনা বেগমের মাধ্যমে তার মেয়ে আসমার সঙ্গে পরিচয় এবং প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। একপর্যায়ে পরিবারের কাউকে কোনো কিছু না জানিয়ে গোপনে আসমাকে বিয়ে করেন।

সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু শাকিলই তাদের সংসারে অশান্তি ডেকে আনেন। স্ত্রী আসমার সঙ্গে শাকিলের পরকীয়া প্রেমের সম্পর্কের ঘটনায় তিনি তার স্ত্রীর ওপর চরম ক্ষিপ্ত ছিলেন। বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও স্ত্রী আসমা খাতুন সংশোধন হননি। শাকিলের সঙ্গে পরকীয়া চালিয়ে যেতে থাকেন।

পরবর্তীতে কুষ্টিয়ার হালসা ক্যাম্প থেকে সৌমেনকে খুলনার ফুলতলা থানায় বদলি করা হলে শাকিলের সঙ্গে আসমার পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক আরও গভীর হতে থাকে। এনিয়ে আসমার সঙ্গে তার একাধিকবার ঝগড়া-বিবাদও হয়।

এএসআই সৌমেন আদালতকে জানান, তিনি আসমার মোবাইলের কল রেকর্ডও সংগ্রহ করেন। তিনি স্ত্রী আসমাকে পরকীয়া প্রেমের জাল থেকে বের করতে না পেরে তার প্রেমিক শাকিল খানকে একাধিকবার হুমকি দেন। এমনকি শাকিলের বাড়িতে গিয়েও এ ব্যাপারে শাসিয়ে আসেন। কোনো কিছুতেই আসমাকে পরকীয়া প্রেমের সম্পর্ক থেকে পথে আনতে না পেরে তিনি শেষ পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সিদ্ধান্ত নেন।

পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী থানা থেকে ছুটি না নিয়েই রোববার ভোরে খুলনা থেকে বাসযোগে কুষ্টিয়ায় আসেন এএসআই সৌমেন। এসময় তিনি তার পিস্তল, দুটি ম্যাগজিন ও গুলি সঙ্গে নিয়ে আসেন।

সৌমেনের ভাষ্য অনুযায়ী, রোববার বেলা ১১টার দিকে স্ত্রী আসমাকে শহরের কাস্টমস মোড়ে পরকীয়া প্রেমিক শাকিল খানের সঙ্গে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। সেখানে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে নিজের গুলি ভর্তি সার্ভিস রিভলবার দিয়ে প্রথমে শাকিলকে গুলি করেন। এরপর আসমাকে গুলি করেন। এসময় শিশু রবিন দৌড়ে পালাতে গেলে তাকেও গুলি করেন। তিনজনকেই দুটি করে গুলি করেন সৌমেন। একটি ম্যাগজিনের গুলি শেষ হয়ে গেলে ব্যবহার করেন আরেকটি ম্যাগজিন।

সূত্র জানায়, সৌমেন আদালতে স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ায় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আলাদাভাবে রিমান্ডের আবেদন করেননি।

এদিকে সোমবার বাদ জোহর নিহত আসমা খাতুন, তার শিশুপুত্র রবিন এবং প্রেমিক শাকিল খানের দাফন সম্পন্ন হয়েছে। ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় রোববার রাতে কুষ্টিয়া মডেল থানায় এএসআই সৌমেন রায়কে আসামি করে নিহত আসমা খাতুনের মা হাসিনা বেগম একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং-৩৯।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আরএমও তাপস কুমার সরকার জানান, রোববার নিহত তিনজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষে রোববার রাত ১২টার পর নিজ নিজ পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। রাতে নিহত শাকিলের মরদেহ তার বাবা মেজবার রহমানের কাছে হস্তান্তর করা হয়। অন্যদিকে নিহত আসমা খাতুন এবং তার ছয় বছর বয়সী শিশুপুত্র রবিনের মরদেহ আসমা খাতুনের মা হাসিনা বেগমের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

নিহত শাকিল খানের নিজ গ্রাম কুমারখালী উপজেলার চাপড়া ইউনিয়নের সাঁওতা কারিগর পাড়া গ্রামের মেছের উদ্দিন দারুল উলুম কওমিয়া মাদরাসায় জানাজা শেষে সোমবার বাদ জোহর সাঁওতা কারিগর পাড়া গোরস্থানে দাফন করা হয়।

এদিকে এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনায় খুলনা রেঞ্জ থেকে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। খুলনা রেঞ্জের দুজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ কুষ্টিয়ায় এক পুলিশ কর্মকর্তাকে তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। ঘটনার পর পরই সৌমেন রায়কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

কুষ্টিয়া পুলিশ সূত্র জানায়, সৌমেন রায় ২০১৫ সালে কনস্টেবল থেকে এএসআই পদে উন্নীত হন। পরে ২০১৬ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থানায় যোগ দেন। সেখান থেকে জেলার অন্যান্য থানায়ও কর্মরত ছিলেন। সর্বশেষ মিরপুর থানার হালসা ক্যাম্পে ছিলেন। এরপর বাগেরহাট হয়ে খুলনা ফুলতলা থানায় যোগ দেন।



 

Show all comments
  • Belayet ১৪ জুন, ২০২১, ৮:৫৩ পিএম says : 0
    Policé no right to take his gun without duty when he off duty bec he can do what ever he like gouvernement shuld not give permisson to carré his gun ?????
    Total Reply(0) Reply
  • Jamal Hossain Mizi ১৪ জুন, ২০২১, ৮:৫৩ পিএম says : 0
    অপরাধের যথার্থ শাস্তি না হলে অপরাধী আরো ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে
    Total Reply(0) Reply
  • Imran Mahmud ১৪ জুন, ২০২১, ৮:৫৩ পিএম says : 0
    এটাকে এমন শাস্তি দিতে হবে যেন আর সবাই এধরণের জঘন্য কাজে সাহস না পায়।
    Total Reply(0) Reply
  • MD Jakir Quraish ১৪ জুন, ২০২১, ৮:৫৩ পিএম says : 0
    এই দেশের অবস্থা দিন দিন ভয়ানক হয়ে যাচ্ছে এর কারন কি। আপরাধ করতে মানুষ একটুও ভয় পাচ্ছেনা। মানুষ পরকালের কথা ভুলে যাচ্ছে। বিচার দিনের কথা ভুলে যাচ্ছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Kamal Pasha Jafree ১৪ জুন, ২০২১, ৮:৫৪ পিএম says : 0
    অতিরিক্ত ক্ষমতা আজকে এইসব ঘটনার মূল কারণ। যে দেশে রক্ষকরা ভক্ষক সে দেশে ন্যায় বিচার হওয়াটা হাস্য কর
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ট্রিপল মার্ডার


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ