পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
১৯৭২ সালে প্রথম জাতীয় বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। এরপর গত ৫০ বছরে ৫০টি বাজেট দেয়া হয়েছে। ২০২১-২২ সালের সবশেষ বাজেটের আকার ৬ লক্ষ কোটি টাকার। আপাত দৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে, টাকার অংকে বাংলাদেশের বাজেট সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা করে বাড়ছে। অংকের হিসেবে ২০২১ সালের ৬ লাখ কোটি টাকা ১৯৭২ সালের ৭৮৬ কোটির তুলনায় ৭৬৩ গুণ বেশি। প্রশ্ন উঠছে, বাংলাদেশের বাজেটের প্রকৃত আকার কি আসলেই বাড়ছে? মানুষের আয়-রোজগার কি সত্যি সত্যিই বাড়ছে, নাকি আসলে মূল্যস্ফীতিটাই কেবল বেড়ে চলেছে? এতো আয় থাকলে জনগণের সেই আয় যাচ্ছে কোথায়? আয় করলেও মানুষ সম্পদশালী হতে পারছে না কেন?
সারা দুনিয়ায় অর্থনৈতিক কাজের মূল স্ট্যান্ডার্ড বা মান হচ্ছে গোল্ড বা সোনা। বিশ্বের প্রথম মুদ্রা ব্যবস্থাও ছিল স্বর্ণভিত্তিক। সেই হিসেবে দেখা যায়, ১৯৭২ সালে প্রতি ভরি সোনার দাম ছিল যখন ১৫০ টাকা, তখন ৭৮৬ কোটি টাকা ছিল ৫ কোটি ২৪ লাখ ভরি সোনার সমান। আর বর্তমানে প্রতি ভরি সোনার দাম ৭৩ হাজার টাকা। অর্থাৎ ৬ লাখ কোটি টাকা হচ্ছে ৮ কোটি ২২ লাখ ভরি সোনার সমান। সোনার দামের বিবেচনায় বাংলাদেশের বাজেট ১৯৭২ সালের তুলনায় ৫০ বছরে মাত্র দেড় গুণের মতো বেড়েছে। ৫০ বছরে দ্বিগুণও হতে পারেনি। সুতরাং, ৫০ বছরে আসলে বাজেট বা সরকারের আয়-ব্যয় অথবা জনগণের আয়ও তেমন কিছুই বাড়েনি। বিকাশ ঘটেনি অর্থনীতির। টাকার অংকে যে প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তা আসলে মূল্যস্ফীতি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ৫শ’ গুণ বা ৫০,০০০%। ১৯৭২ সালে ১ সের (কেজি) ওজনের যে ইলিশ মাছটি মাত্র ১ টাকায় বিক্রি হতো, সেটির বাজার-মূল্য এখন কমপক্ষে ৮শ’ টাকা। অর্থাৎ ৮শ’ গুণ বা ৮০,০০০% বেশি। একই সময়ে যে চিকন চাল ১ টাকা সের (কেজি) দরে বিক্রি হতো, তা এখন ৮০ টাকার মতো। অর্থাৎ ৮০ গুণ বা ৮,০০০% বেড়েছে। চালের দামটাই সম্ভবত ৫০ বছরে সবচে’ কম বেড়েছে। এজন্য চাল উৎপাদনকারী কৃষকেরাই এদেশে এখনো সবচেয়ে গরীব।
এবারের ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেটের জন্য দুই লাখ কোটি টাকার বেশি দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিতে হবে। সরকারের রাজস্ব আয় চার লাখ কোটি টাকারও কম। পুরো উন্নয়ন ব্যয়টাই রয়েছে দেশি-বিদেশি ঋণের তলে। দেশের ইতিহাসে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট হচ্ছে, সবচেয়ে বড় ঘাটতির। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতি সাড়ে ৬ শতাংশের মতো। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে যা ছিল ৬ শতাংশের কাছাকাছি। তবে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফের শর্ত মেনে আগের দু’ দশক ধরে বাজেট ঘাটতি রাখা হচ্ছিল জিডিপি’র ৫ শতাংশের নিচে। করোনা ভাইরাসের অভিঘাতে দেশে রাজস্ব আদায় কম হওয়ার কারণেই সরকারকে এ পথে যেতে হচ্ছে দাবি করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, সরকারের এক অর্থবছরের রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা যতটুকু বেশি, সেটাই হচ্ছে বাজেট ঘাটতি। অর্থনীতিবিদদের মতে, ঋণ করে বাজেট বানালে অর্থের ছড়াছড়ি হয় এবং বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ কমে যায়, বাড়ে মূল্যস্ফীতি। আর দীর্ঘমেয়াদী ঋণের বিপরীতে সরকারকে দিতে হয় প্রায় তিন গুণ সুদ। এ কারণে বাজেটের উল্লেখযোগ্য অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে সুদ পরিশোধে এবং এতে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। তবে সরকার পক্ষের দাবি, আয় কম হলে উন্নয়ন কাজের জন্য ব্যয় কমে যায়। ফলে উন্নয়ন কাজে ব্যয় বাড়াতেই বড় করা হয় ঘাটতি বাজেট। এই উন্নয়ন ব্যয় উৎপাদন খাতে না হলেই বাড়ে মূল্যস্ফীতি।
এদিকে, দেশের জনগণের জন্য গ্রহণযোগ্য অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে বাজেট করা হচ্ছে না বলে খেদ জানিয়েছেন সাবেক অর্থসচিব এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান। তিনি তার নিজের লেখা ‘বাংলাদেশে বাজেট : অর্থনীতি ও রাজনীতি’শীর্ষক বইয়ে উল্লেখ করেছেন, সংখ্যার খেলার বাজেট নিয়ে প্রচারণাই চলছে বেশি। বাস্তবে তা শুভংকরের ফাঁকি। বাজেটের সংখ্যা নিয়ে দেশে মহা খেলাধুলা ও শোরগোল চলছে মন্তব্য করে আকবর আলি খান বলেছেন, প্রতিবছর বাজেট এলেই সদর্পে ঘোষণা করা হয়, বাজেটের আকার সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। যুক্তির চেয়েও এতে প্রচারণা থাকে বেশি। এখানে সরকারের (বিবিএস) দেয়া তথ্য সঠিক ধরা হলেও, সেই তথ্যের ব্যাখ্যা একেবারেই ভুল। আকবর আলি খানের বিশ্লেষণে ১৯৭২-৭৩ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজারমূল্যে বাজেট বেড়েছে ৭২২ গুণ। কিন্তু জিডিপি’র (মোট দেশজ উৎপাদনের) তুলনায় বাজেট বেড়েছে মাত্র আধা শতাংশ। এ যেন বাংলা পুঁথিসাহিত্যের সেই শ্লোক ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমারও করিয়া দেখি সাড়ে ৩ হাজার’-এর মতোই। তিনি বলেন, একটি পরিমাণের সঙ্গে আরেকটি পরিমাণের তুলনা করা হচ্ছে বাজারমূল্য দিয়ে। মূল্যস্ফীতিকে এখানে বিবেচনাতেই নেয়া হচ্ছে না। অথচ, বাজারমূল্যের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে গত ৫০ বছরে। বাজেটের পরিমাণের মূল্যায়ন ও তুলনা জিডিপির ভিত্তিতে করার পরামর্শ দিয়ে ড. আকবর আলি খান বলেছেন, সরকারি হিসেবেই গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের বাজেট জিডিপির এক শতাংশও বাড়েনি। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ছিল জিডিপির ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ। আর গতবছর অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণাকালে জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট জিডিপির ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ জিডিপির বিবেচনায় ৫০ বছরে বাজেট বেড়েছে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ। মানে এক শতাংশের অর্ধেক। আবার এই জিডিপি’র গণনা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। বাস্তবে বাংলাদেশের জিডিপি’র আকার সরকারের দেয়া হিসাবের তুলনায় অনেক কম। তাছাড়া বাংলাদেশের মুদ্রার বিনিময় হারও সঠিক নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের মতে, এক মার্কিন ডলারের বিনিময়ে বর্তমানে বাংলাদেশের মুদ্রার মান হওয়া উচিত ছিল অন্তত ১২০ টাকা। কিন্তু এটিকে সর্বোচ্চ ৮৫ টাকার মধ্যে বেঁধে রাখা হয়েছে। মূল্যস্ফীতির সাথে ডলারের বর্তমান দর সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এতে রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতি মাত্রায় আমদানী নির্ভর হয়ে বিদেশি পণ্যে সয়লাব হচ্ছে দেশের বাজার। আবার বিদেশে অর্থপাচারও হচ্ছে লাভজনক। আর টাকার তুলনায় ডলারের অবমূল্যায়নের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রায় জিডিপিকেও কৃত্রিমভাবে বড় করে দেখানো সম্ভব হচ্ছে এবং বাজেট ঘাটতি পূরণে সরকার ঋণও বাড়িয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। এ এক চরম গোলক ধাঁধা। অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সিপিডি’র বিশেষ ফেলো ও ডাব্লিউটিওতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য্যও মনে করেন, বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি ছাড়াই ইদানিং জিডিপি’র অস্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির মাত্রা দেখানো হচ্ছ। রাজনৈতিক স্বার্থে সরকারের সাফল্য দেখাতেই তা করা হচ্ছে। কিন্তু আয় ও ব্যয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা না হওয়ায় নানা অর্থনৈতিক সমস্যা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে।
আকবর আলি খানের মতে, অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ বিশ্লেষণ ছাড়া কাল্পনিক পূর্বানুমান নিয়ে জাতীয় বাজেট তৈরি করা হচ্ছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে আগেরবারের তুলনায় সাড়ে ৫ শতাংশের মতো বাড়িয়ে পরেরবারের বাজেট করা হচ্ছে। আয়ের ক্ষেত্রেও করা হচ্ছে প্রায় একই জিনিস। যেমন রাজস্বের ক্ষেত্রে প্রতিবছর অতিরঞ্জিত প্রাক্কলন করা হচ্ছে। বাজেটে রাজনীতিবিদদের আগ্রহ বেশি থাকে ব্যয় বরাদ্দে। যত বেশি ব্যয় বাড়বে, তত বেশি রাজনীতিবিদদের মক্কেলদের খুশি করা যাবে। সরকারের যত ব্যয় বেশি হবে, তত রাজনীতিবিদদের জন্য অনুপার্জিত মুনাফা বা ঘুষের পরিমাণ বৃদ্ধির সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাজেটের পূর্ণাঙ্গ সংস্কার সম্ভব না হলেও অনেক ক্ষেত্রে পুরো জঞ্জাল ঝেড়ে-মুছে পরিষ্কারের পক্ষে আকবর আলি খান। তাঁর ভাষায়, ‘এই ঝাড়া-মোছার একটি উপায় হলো কমপক্ষে প্রতি পাঁচ বছরে একটি সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত সমীক্ষা করা।’ অপরদিকে সাবেক অর্থসচিব মাহবুব আহমদের মতে, ‘অপচয় রোধ এবং ব্যয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধি সরকারের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এজন্য প্রতি পাঁচ বছরে একটি সরকারি ব্যয়সংক্রান্ত সমীক্ষার পক্ষে তিনিও। রাষ্ট্রকে আগে ব্যয় ঠিক করে তারপর আয়ের অর্থ জোগাড় করতে হয় বলে কাল্পনিক পূর্বানুমান দিয়ে বাজেট করা ছাড়া উপায় থাকে না বলে মন্তব্য করেন তিনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।