পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বনভূমি উজাড় হচ্ছে, এটা কোনো নতুন কথা নয়। রক্ষক ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে চোরাকাবারীদের সঙ্গে যোগসাজসে দেশের বনাঞ্চল উজাড় করছে। এভাবে উজাড় হতে থাকলে বনের পশুপাখি, হরিণ আর বাঘ ও সুন্দর সুন্দর পাখির সুমধুর কণ্ঠে গান আর শোনা যাবে না। পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে আরও হবে, প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দেবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কঠিন শাস্তি হতে আমরা কেউই রক্ষা পাব না, যার লক্ষণ ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি দীর্ঘ তিন যুগের বেশি সময় থেকে সাংবাদিকতা পেশার সাথে জড়িত। প্রকৃতি-পরিবেশ, বন-জঙ্গল, গাছপালা, জীব-বৈচিত্র্য এবং সামাজিক বিষয়-আশয় নিয়ে আমার লেখার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি। আমি সেই ছোট কাল থেকেই বৃক্ষ চারা রোপণ এবং বিতরণ করে আসছি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানাদিতে। এর স্বীকৃতি সরূপ ১৯৯৮ সালে আমাকে বৃক্ষরোপণে জাতীয় স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার ওসমানী মিলনায়তনে এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ পুরষ্কার প্রদান করেন।
অনেকেই মনে করেন, বর্তমান কালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ও উদ্যোগ সম্পূর্ণ আধুনিক। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। নির্বিচারে ও নৃশংসভাবে বন্যপ্রাণী নিধন করার ফলে ভবিষ্যতে বিস্ময়কর পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। এই আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য আমরা হালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য কিছুটা উৎসাহী হয়েছি। কাজেই আমাদের এ কাজে এগিয়ে আসাটা প্রয়োজন ভিত্তিক। কিন্তু প্রাচীন কালে বন্য পশুপক্ষী রক্ষণটা ছিল মৌলিক ও আত্মিক। কেননা, তারা বন্যপ্রাণী রক্ষণের ব্যাপারে শুধু সজাগই ছিল না, তারা বনাঞ্চল, বন্যপ্রাণী ও মানুষকে বিশ্ববোধের প্রেক্ষিতে দেখত। ইংরেজিতে আমরা যাকে ফরেস্ট বলি সে শব্দটা এসেছে ফারসি শব্দ থেকে- যার অর্থ হচ্ছে ‘বাহির’। কাজেই বনাঞ্চলকে আমরা জনাঞ্চল থেকে পৃথকভাবেই দেখতে অভ্যস্ত। বন্যপ্রাণী হিংস্র এবং বনাঞ্চল বিপদসঙ্কুল- এ ধারণা নিয়েই আমরা বড় হচ্ছি। কাজেই বনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক দূর সম্পকের্র।
কিন্তু প্রাচীন যুগে এমনটা ছিল না। তখন বনাঞ্চল ছিল তপোবন। প্রাচীন জনগণ জীবনের চারটি আশ্রমের তিনটি আশ্রমই কাটাত বনে। বন্য পশুপক্ষীদের পরিবেশেই। তারা আত্মিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখত অরণ্যকে। তাই তাদের বন্যপ্রাণী চেতনা ছিল গভীর ও অকৃত্রিম। প্রাচীন সাহিত্য রচিত হয়েছিল অরণ্যেই। এ বিষয় সম্বন্ধে প্রাচীন ইতিহাস ও সাহিত্য কী বলে দু-চারটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ধ্বংসপ্রাপ্ত মহেঞ্জদারো সভ্যতার আবিষ্কৃত সিলমোহরে অঙ্কিত ষাঁড়, হাতি, গন্ডার, বাঘ প্রভৃতি থেকেই প্রমাণিত হয় বন্যপ্রাণীদের প্রতি সে প্রাচীন যুগের মানুষের মনোভাব ও ভালোবাসার কথা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বন্যপ্রাণী রক্ষণাবেক্ষণ সম্বন্ধে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। তপোবনে ও অভয়ারণ্যে বন্য পশুপক্ষী হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল, তারও উল্লেখ রয়েছে। চতুষ্পদ জন্তু, পাখি প্রভৃতির হত্যা নিষিদ্ধ ছিল এবং নিষেধ অমান্যকারীদের ওপর কঠোর দন্ডদানের বিধানও ছিল। প্রাচীনকালে এ অঞ্চলে এমন কতকগুলো এলাকা ছিল যেখানে সবরকম চতুষ্পদ প্রাণী, পাখি, এমনকী মাছ পর্যন্ত হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল। এবার আসা যাক প্রাচীন সাহিত্যে। উদাহরণটা কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ থেকেই নেওয়া যাক। শকুন্তলা পতিগৃহে যাত্রা করবেন। এখন কণ্বমুনির আশ্রমের কী করুণ দৃশ্য! আশ্রমের সম্পূর্ণ পরিবেশ শকুন্তলার বিরহে বিমর্ষ ও কাতর। হরিণগুলো তাদের আহার ছেড়ে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শকুন্তলার পালিত মাতৃহারা মৃগশিশু তার আঁচল ধরে টানছে। প্রকৃতি এবং নিম্নপ্রাণীদেরও মানুষের সঙ্গে কী অকৃত্রিম সংযোগ! প্রাচীনদের সঙ্গে প্রকৃতির এই নিবিড় সম্পর্ক ইংরেজি কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থের বিখ্যাত লাইনগুলো মনে করিয়ে দেয়: To her Fair works did Nature link the human sand that through me ran and much it grieved my heart to think what man has made of man.
মানুষই মানুষের সর্বনাশ ডেকে আনছে নিজেদের লোভ চরিতার্থ করার জন্য নির্দ্বিধায় অবৈধভাবে বনাঞ্চল ও বন্য পশুপক্ষীর বিনাশ সাধন করে। সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায়, বিবেকহীন ও অদূরদর্শী চোরাকারবারীরা সরকারি বিধি-নিষেধ অমান্য করে একের পর এক বন থেকে কাঠ পাচার করাচ্ছে। ফলে দিন দিন বনাঞ্চল কমে যাচ্ছে। যারা মনে করেন বন্যপ্রাণী হিংস্র, তারা স্বীকার করবেন কি না জানি না, মানুষ এই হিংস্র থেকেও অধিকতর হিংস্র। তাই তো কাঠ চোরাকারবারী ও শিকারীরা বিষ, করাত, হেসো, রাইফেল, বন্দুক নিয়ে বনে ঢুকে অগণিত পশুপাখি ও মূল্যবান গাছগুলো বিনাশ করছে। সংবাদপত্রগুলো খুলেলেই খন্ডবন তো বটেই, এমনকি সংরক্ষিত বনেও দেখা যায় নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছে চিতা, এমনকি ‘লর্ড-অব জঙ্গল’ অর্থাৎ বাঘও। এভাবে বনজ সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার, বন্যপ্রাণীদের নির্দ্বিধায় হত্যা ও তাদের চামড়া, শিং, দাঁত ও হাড় নিয়ে ব্যবসা, গণবিস্ফোরণ ও তাদের বসবাসের জন্য খন্ড বনগুলোতে বাসস্থান গড়ে তোলা, খাদ্যানুসন্ধানে লোকালয়ে বানর, হাতি, বাঘ প্রভৃতি বন্যপ্রাণীর হানা দেওয়া, বড় বড় শহর ও নগরের ক্রম বিস্তৃতি, যা শুধু যে সঙ্কোচন ঘটাচ্ছে তা নয়, অনেক প্রজাতির বন্য পশুপক্ষীরও পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলুপ্তি ঘটাচ্ছে। পৃথিবী থেকে দুই খড়্গী গন্ডার ও চিতা আজ প্রায় নিশ্চিহ্ন। মরিশাস দ্বীপের ডো-ডো পাখি এবং সুন্দরবনের এক খড়্গবিশিষ্ট ছোট গন্ডার প্রায় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত। সবচেয়ে লজ্জাকর ব্যাপার, আমেরিকায় ঔপনিবেশ স্থাপনের পর রেড ইন্ডিয়ানদের প্রধান খাদ্য মহিষের মাংস থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে সরকারের নির্দেশে সেখানের মহিষকুলের বিলুপ্তি ঘটানো হয়েছে। সুন্দরবনের কর্মকর্তাদের স¤প্রতি রিপোট অনুযায়ী অবৈধভাবে বনাঞ্চল ধ্বংস করার ফলে বাঘের আবাসস্থল ও বিচরণ ভূমির সঙ্কোচন হয়েছে এবং পর্যাপ্ত খাদ্যাভাবে বাঘগুলো ছোট হয়ে যাচ্ছে। যেখানে একটি সুস্থ প্রাপ্তবয়স্ক বাঘের ওজন ১৪০ কিলোগ্রাম ছিল, এখন তা দাঁড়িয়েছে মাত্র ৯৮ কিলোগ্রামে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে ৪০ থেকে কোনো কোনো স্থানে ৭০ শতাংশ বনাঞ্চল ইতোমধ্যেই তিরোহিত। যদি এভাবেই চলতে থাকে তা হলে আমাদের এই বৈচিত্র্যময় পৃথিবী একদিন মরুভূমিতে পরিণত হবে। তাই মানব জীবন ও সভ্যতার পরমায়ুর জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বন সংরক্ষণ।
আমাদের এ অঞ্চল মূলত কৃষিভিত্তিক। শিল্প-বাণিজ্যের ক্রমোন্নতির যুগেও ৭০ শতাংশ লোক কৃষির ওপর নির্ভরশীল। সেই কৃষিকার্যে রয়েছে বন্যপ্রাণী, পাখি ও কীট-পতঙ্গের বিরাট ভূমিকা। প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য তাদের উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন। বস্তত মানবসমাজ ও প্রাণীজগতের মধ্যে আছে এক নিবিড় সম্পর্ক। প্রাণীজগতের সঙ্গে আমাদের সবার সম্পর্ক হচ্ছে খাদ্যখাদক সম্পর্ক এবং এই সম্পর্কই সুদূর অতীত থেকে রক্ষা করে আসছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য। একটা ছাড়া অন্যটা টিকে থাকা অসম্ভব। তাই আমাদের নিজেদের কল্যাণের জন্যই যে আমাদের পশুপক্ষী সংরক্ষণ একান্ত আবশ্যক, তা সবাইকে বুঝতে হবে। আমরা বন্যপ্রাণীকে তিন ভাগে বিভক্ত করে পারি। এক শ্রেণীর বন্যপ্রাণী, যারা একেবারে নিশ্চিহ্ন। যারা আর ফিরে আসবে না। আর এক শ্রেণী, যারা কমতে কমতে এখন শেষ পর্যায়ে, যাদের আমরা বিরল প্রাণী বলে থাকি। আর অন্য শ্রেণিটি, যারা মানুষের লোভ এবং প্রাকৃতিক পরিবর্তন সত্তে¡ও মোটামুটি তাদের সংখ্যাটা বজায় রেখেছে।
আমাদের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ চেতনা জাগ্রত না হওয়াটা দুর্ভাগ্যজনক, অবশ্য সংরক্ষণের কাজটা কঠিন ও তেমনই দুরূহ। সরকার অগ্রণী ভূমিকা নিলেও যতদিন না জনসাধারণ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে এগিয়ে না আসবে, এ সমস্যার সমাধান হবে না। ইতোমধ্যে সরকার অনেক কঠোর আইন প্রণয়ন করেছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য রিজার্ভ ফরেস্ট, ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙ্কচিউয়্যারি, ন্যাশনাল পার্ক স্থাপন করেছে, এমনকি স¤প্রতি বন্যপ্রাণী স্থানান্তর করছে সরকার। যদি সরকারের ভূমিকা যথেষ্ট হত তা হলে বিরল প্রজাতির পশুপক্ষী বিলুপ্ত হচ্ছে কেন? সেজন্য সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে ও বন্য পশুপক্ষী রক্ষার জন্য সদর্থক নিষ্ঠাভরা যৌথ উদ্যোগ নিতে হবে। বন সংকোচন বন্ধ করতে হবে। বন্যপ্রাণীদের পর্যাপ্ত আহার ও অবাধ বিচরণের জন্য প্রয়োজন বনাঞ্চলে বসবাসকারীদের তাদের দখলিকৃত স্থান থেকে উৎখাত করে এ সমস্ত স্থানগুলোকে পুনরায় সবুজ করে তুলতে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বন সংকোচন রোধ করার জন্য সরকার যে সমস্ত বিধি-নিষেধ জারি করেছে সেগুলো যাতে যথারীতি রূপায়িত হয় তা সরকার ও জনসাধারণের যুগ্ম দায়িত্ব। প্রতিটি সংরক্ষিত এলাকায় বন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় সশস্ত্র পাহারাদারদের নিযুক্তি দিতে, রাখতে হবে জবাবদিহির ব্যবস্থা। চোরা শিকারীদের জন্য থাকতে হবে কঠোর আইনী ব্যবস্থা। রিজার্ভ ফরেস্ট ছাড়াও খন্ড বনগুলো যাতে জনবসতিমুক্ত থাকে, তাতে সরকারি খবরদারি বাড়াতে হবে। বিরল প্রজাতির প্রাণীগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেশের চিড়িয়াখানাগুলোর ওপর ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। দেশের উন্নতি এবং অগ্রগতি অব্যাহত রেখেও যাতে বায়ু প্রদূষণ একেবারে সীমিত থাকে, সেদিকেও নজর রাখতে হবে। ঝিলে-বিলে বাড়িঘর নির্মাণ করে পরিযায়ী পাখিদের কলরব স্তব্ধ করা ঠিক হবে না।
প্রাণীদের স্থানান্তরের আগে বনবিভাগকে দেখতে হবে পরিবর্তিত বনের ভিন্ন পরিবেশ ও আবহাওয়া প্রেরিত বন্যপ্রাণীদের বাঁচার ও বৃদ্ধির অনুকূল কি না। সেখানে তাদের বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পশু ও বনভূমি আছে কি না। তা না হলে সংখ্যা বৃদ্ধি করতে গিয়ে সংখ্যা হ্রাসই হবে। দেখা গেছে, যে সমস্ত প্রাণীকে সংরক্ষণ করলে আর্থিক ফায়দা হয় সেগুলো সংরক্ষণেরই বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, আর যে সমস্ত প্রাণী সেই উদ্দেশ্য সাধনে অসমর্থ, তারা কাগজেকলমে সংরক্ষিত বললেও এ জাতীয় হাজারো প্রাণী ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। তাই সামগ্রিকভাবে তাদেরে অকৃত্রিমভাবে ভালবাসতে হবে এবং তাদের সঙ্গে সংযোগ পুনঃস্থাপন করতে হবে। বন্য পশুপক্ষীদের অস্তিত্ব কিছু সংখ্যক মানুষের ওপর নির্ভর করবে, তা কখনও হতে পারে না। আর মনে রাখতে হবে, গাছপালা, বন, বন্যজন্তু , পশুপাখি না থাকলে মানুষের অস্তিত্বই একদিন বিলীন হয়ে যাবে সুন্দর এই পৃথিবী থেকে।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট। বৃক্ষরোপনে জাতীয় পুরষ্কার স্বর্ণপদক (১ম) প্রাপ্ত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।