দেশে দেশে রোজার উৎসব
মাহে রমজান আরবী নবম মাসের নাম। চাঁদের আবর্তন দ্বারা যে এক বৎসর গণনা করা হয়,
কান পাতলে প্রায়ই লোকমুখে এ প্রবাদ শোনা যায়-‘বিপদ একা আসে না।’ বস্তুত কোনো জনপদে যে কোনো প্রকারের বিপদ ও দুর্যোগ দেখা দিলে তাতে ধনী-গরীব এবং পাপী-পুণ্যবান সবাই আক্রান্ত হয়ে যায়। লোকজ এ বিষয়টি যেমন বাস্তব ও পরীক্ষিত, পবিত্র কুরআন দ্বারা সমর্থিতও বটে। ইরশাদ হয়েছে (তরজমা) ‘আর সেই বিপর্যয়কে ভয় করো, যা বিশেষভাবে তোমাদের মধ্যে যারা জুলুম করে ফেলে কেবল তাদেরই আক্রান্ত করবে না।’ (আনফাল, ৮ : ২৫) আয়াতে বলা হয়েছে যে, সমাজে কোনো মন্দ কাজের বিস্তার ঘটলে তা সাধ্যমতো রোধ করা সবার দায়িত্ব। যদি এ দায়িত্ব পালনে অবহেলা হয় এবং সেই মন্দ কাজের দরুন কোনো বিপর্যয় দেখা দেয়, তবে মন্দ কাজে যারা সরাসরি জড়িত ছিল কেবল তারাই সেই বিপর্যয়ের শিকার হবে না; বরং যারা নিজেরা সরাসরি মন্দ কাজ করেনি, কিন্তু অন্যদের বাধাও দেয়নি, তাদেরকেও তার শিকার হতে হবে।
মন্দার কবলে বৈশি^ক অর্থনীতি: গোটা বিশ^ কঠিন মন্দার কবলে পড়েছে। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়া দুষ্করই বটে! কী কারণে এই মন্দা দেখা দিল, তার ব্যাখ্যায় নানাজনের নানামত রয়েছে। এর মধ্যে যদি কেউ বলে- এর জন্য সুদি অর্থব্যবস্থা দায়ি-তবে কি সে কঠিনভাবে তিরস্কৃত হবে না? নিশ্চয় সে তিরস্কৃত হবে। কারণ আধুনিক অর্থব্যবস্থায় সুদ হলো প্রবৃদ্ধির প্রধান নিয়ামক। আজকের বিস্তৃত এ দুনিয়া তো সুদি অর্থনীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। সমাজের এমন কোনো দিক নেই যা সুদি কারবারে জর্জরিত নয়। ক্ষুদ্র ঋণ থেকে শিল্প ঋণ, ছোট থেকে বড় লেনদেন এবং অর্থনৈতিক যাবতীয় কার্যক্রমে যেন একচেটে সুদের দৌরাত্ম্য। বাহ্যত মনে হচ্ছে যে, সুদের এই নাগপাশ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এর মধ্যেই চলছে মুসলিম-অমুসলিম সবার জীবনের পথ-পরিক্রমা। অথচ পবিত্র কুরআন-হাদীস বলছে-এই অর্থব্যবস্থার অধঃপতন অনিবার্য। দুনিয়ার কোনো শক্তি এর ভঙ্গুরতা ও অসারতা ঠেকাতে পারবে না। এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে- ‘আল্লাহ্ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান-সদাকাকে বর্ধিত করেন।’ (বাকারা, ২ : ২৭৬)
সুদে প্রবৃদ্ধি নেই: আল্লাহ্ তাআলা ইরশাদ করেন (তরজমা) ‘তোমরা যে সুদ দাও, যাতে তা মানুষের (যুক্ত হয়ে) বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ্র কাছে তা বৃদ্ধি পায় না।’ (সূরা রূম, ৩০ : ৩৯) সুদে যে প্রবৃদ্ধি নেই, তা এ আয়াত প্রতীয়মান করে। সুদখোর যখন লোকসানে পড়ে, তখন তার পুনরায় মাথা তোলার যোগ্যতা থাকে না। কেননা, ক্ষতি বরদাশত করার মতো পুঁজি যে তার ছিলই না। ক্ষতির সময় তার ওপর দ্বিগুণ বিপদ চাপে। একে তো নিজের মুনাফা ও পুঁজি গেল, তদুপরি ব্যাংকের ঋণও চেপে বসল। এ ঋণ পরিশোধের কোনো উপায় তার কাছে নেই। পক্ষান্তরে সুদবিহীন ব্যবসায়ে যদি কোনো সময় সমগ্র পুঁজিও বিনষ্ট হয়ে যায়, তবে এর দ্বারা মানুষ ফকীর হয় না-ঋণী হয়। (মাআরিফুল কুরআন, মুফতী মুহাম্মাদ শফী রহ., ১/ ৬৩২)
দুনিয়াব্যাপী সুদের ধ্বংসযজ্ঞ: পুরো দুনিয়াতে এখন সুদের রমরমা প্রচলন। আমরা দেখতে পাই- সারা বিশে^ আমেরিকার চর্চা হয়। এর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী বা সমকক্ষ বর্তমান দুনিয়াতে নেই। তারপরও আমেরিকার অর্থব্যবস্থা পুতনমুখী। এরা পুঁজিবাদে বিশ^াসী। পুঁজিবাদের কুফল ও ব্যর্থতা দিন দিন বাড়ছে। খোদ মার্কিন মুল্লকেও তার ব্যর্থতা দেখা দিয়েছে। ২০১১ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। শত শত তরুণ জমায়েত হয়েছিল নিউইয়র্কের লোয়ার ম্যানহাটনের একটি ছোট পার্কে, যার নাম জুকোট্টি পার্ক। সেখানে জন্ম হয়েছিল একটি আন্দোলন-‘অক্যুপাই মুভমেন্ট’। তখন বিশ্বজুড়ে একথা প্রচারিত হয়েছিল- ওয়ালস্ট্রিট দখল-আন্দোলন হলো পুঁজিবাদের পতন-ঘন্টা। তার কারণও কিন্তু এই সুদ। আসল কথা হলো- সুদি ব্যবস্থা বর্তমান পৃথিবীকে খাদের কিনারায় নিয়ে গেছে।
সুদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক জিহাদের ঘোষণা: যে সমাজে ও রাষ্ট্রে সুদের প্রচলন ঘটবে, সেখানে বাহ্যিকভাবে জিডিপি বাড়তে পারে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার বইতে পারে; কিন্তু সামগ্রিকভাবে সেখানে সুখ-শান্তি এবং প্রকৃত উন্নয়ন ও স্থায়ী প্রবৃদ্ধি কখনও সম্ভব নয়। কারণ সেই সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মহান আল্লাহ্র পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক যুদ্ধের ঘোষণা রয়েছে। ‘(সুদের অবশিষ্ট ছেড়ে দাও) যদি তা না কর, তবে আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের ঘোষণা শুনে নাও।’ (সূরা বাকারা, ২ : ২৭৯)
যে কারণে বাংলার আকাশে দুর্যোগের ঘনঘটা: আজ গোটা দেশ কঠিন আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। সুড়ঙ্গের ওপারে বাহ্যত কোনো আলো দেখা যাচ্ছে না। এতো প্রবৃদ্ধি আর জিডিপি কোথায় গেল! এতো মেগা প্রকল্পের ছড়াছড়ি! এতো রেমিট্যান্স ও দেশীয় শিল্প-বাণিজ্যের জোয়ার থাকা সত্ত্বেও দেশ তলিয়ে যাচ্ছে কেন? তাহলে বুঝাই যাচ্ছে-কোথাও একটা ঘাপলা আছে। কোথাও ঘুণপোকা রয়েছে, যা ধীরে ধীরে গোটা সমাজকে ফোকলা করে দিচ্ছে। যে সমাজের ভিত্তিপ্রস্তর ও বুনিয়াদ দুর্বল, তার আদ্যন্ত যে দুর্বল-এ কথা তো হলফ করেই বলা যায়। দার্শনিক কবি আল্লামা ড. ইকবাল রহ. বলেন-তোমহারি তাহযীব আপনে খঞ্জর সে আপ হি খোদ কুশী কারেগী, যো শাখে নাযুক পে আশিয়ানা বনেগা নাপায়েদার হো গা।’ (তোমাদের সভ্যতা নিজের খঞ্জর দিয়ে আত্মহত্যা করবে। নরম ডালে বাসা হলে তা ভঙ্গুরই হবে।) (চলবে)
লেখক : শিক্ষাসচিব, জামিআ মুহাম্মাদিয়া ইসলামিয়া টিএন্ডটি মাদরাসা, বনানী, ঢাকা-১২১৩
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।