পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বলেছেন, হামাসের আক্রমণ থেকে ইসরাইলের জনগণকে নিরাপত্তা দেয়া তার দায়িত্ব। তাহলে ইসরাইলের অবিরত বোমাবর্ষণের বিরুদ্ধে গাজার ফিলিস্তিনিদের নিরাপদ রাখা কার দায়িত্ব? গাজাতে ২০০৭ সাল থেকে হামাস নেতৃবৃন্দ নির্বাচিত শাসক। তাই হামাসের সেনারা ঘরোয়া রকেট দিয়ে গাজাবাসীর নিরাপত্তা রক্ষার চেষ্টা করছে। এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি রকেট তারা মেরেছে। এটা ঢিল মারার চেয়ে কিছুটা ভালো হয়েছে, তেলআবিব পর্যন্ত ছোঁড়া যাচ্ছে আগুনের ঢিলাগুলো। আয়রন ডোমের ব্যারিকেড এড়িয়ে কিছু রকেট ইসরাইলে পড়েছে, যাতে বেশ কিছু মানুষও হতাহত হয়েছে। আর গাজায় ইসরাইলি বোমায় নিহত হয়েছে দুশ’র ওপর ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক নারী ও শিশু।
এই রকম অসম যুদ্ধে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বাইডেন মানবতার মুখোশটি খুলে স্বরূপে হাজির হয়ে যা বলেছেন তার মর্মার্থ দাঁড়ায়, সব দোষ ফিলিস্তিনি মুসলমানদের, তারা চুপ করে মার খায় না কেন? তার ভাষায়, ‘নিজ প্রতিরক্ষার জন্য মুসলমান ফিলিস্তিনিদের মাইর দেয়ার অধিকার আছে ইসরাইলের।’
একই ধরনের ঘটনা ইহুদিরা আরেকবার ঘটিয়েছিল ৫২৩ বা ৫২৫ খ্রিস্টাব্দে সৌদি আরবের নাজরানে। তখন সেই এলাকার নাম ছিলো আল উখদাদ, অর্থ পরিখা। এটি সে সময়কার কথা, যখন ইহুদিরা মুসা (আ.)-এর আসল ধর্ম থেকে বিভ্রান্ত হয়ে সরে গেছে। অন্যদিকে রোমান সাম্রাজ্য আর আবিসিনিয়া খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। আল উখদাদে তখন হায়ান নামে একজন খ্রিস্টান রাজা বিভ্রান্ত ইহুদিদের উপাসনালয় ধংস করে তৎকালীন একেশ্বরবাদী খ্রিস্টানদের রাজত্ব স্থাপন করেন। যারা ঈসা (আ.)কে আল্লার পুত্র নয়, বরং নবী মানতেন। রাজা হায়ানের মৃত্যু হলে ইয়েমেনের সর্বশেষ হিমায়ারিন রাজা নধু নৌয়াজ আল উখদাদ দখল করে নেয়। সে আগে যদিও নাস্তিক ছিল, পরে ইহুদি ধর্ম-বিশ্বাসী হয়। কিন্তু তখন ইহুদি ধর্ম ছিল পরিবর্তিত ও বিভ্রান্ত, তারা নবী ওজায়ের (আ.)কে আল্লাহর পুত্র বলে বিশ্বাস করতো।
রাজা নৌয়াজ উখদাদের আহলে কিতাব খ্রিস্টানদের ইহুদি হতে আদেশ দেয়, কিন্তু তারা ধর্ম ছাড়তে রাজি হয়নি। তখন নাজরানে কাবার মতো দেখতে খ্রিস্টানদের চৌকোণা গির্জাঘর ছিল, যেখানে ঈসা (আ.)-এর অনুসারী ‘পল’র অস্থি সংরক্ষিত ছিল, তা-সহ স্থাপনাটি পুড়িয়ে দেয়। খ্রিস্টান তথ্যসূত্রে জানা যায়, হায়ান রাজার কন্যা হাবসাকে আটক করা হলে তিনি একেশ্বরবাদ থেকে সরতে রাজী হলেন না। তখন তার দুই কন্যা আর নাতনীকে শিরোচ্ছেদ করে তাদের রক্ত পান করাতে বাধ্য করেছিলো শিশুদের মা-রাজকন্যাকে। পরে রাজকন্যা শহীদ হলেও পুরো রাজ্যের কেউ সত্যের রাস্তা থেকে কোনভাবেই সরে আসেনি। যখন জেল-জুলুম অকেজো প্রমাণিত হয়, তখন রাজা নৌয়াজ পুরো শহরবাসীকে মৃত্যুদÐ দেয়ার ঘোষণা দেয়। এক আল্লাহতে বিশ্বাসী উখদাদ শহরবাসী রাজাকে জানালো, তারা মৃত্যুর পথ দিয়ে আল্লাহর কাছেই পৌঁছাবে, কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু বিভ্রান্ত ইহুদিদের আধিপত্য মানবে না কোনভাবেই।
রাজা সত্যি সত্যি বিশাল আগুন জ্বালালো পরিখাগুলিতে। প্রায় ২০ হাজার মানুষকে অবরোধ করে গ্রেফতার করে জ্বালিয়ে আর শিরোচ্ছেদ করে হত্যা করলো।
ইহুদিদের জবরদস্তি আর দখলদারিত্বের শাসনের বিরুদ্ধে তৎকালীন আহলে কিতাবী হাজার হাজার মানুষ এইভাবে প্রথম ইন্তিফাদা করেছিলো নবী (সা.)-এর জন্ম হবার অনেক আগে। সেই ঘটনার প্রায় ১০০ বছর পর সুরা আল বুরুজের ৪-৭ নম্বর আয়াত নাজিল করে সেই অসম অবিচারী গণহত্যার কথা মুমিনদের জানিয়ে ভবিষ্যতের মানুষদের জন্য আল্লাহ বুঝিয়ে দিলেন, বিশ্বাসীদের জন্য পৃথিবীতে এই ধরনের একতরফা জুলুম আগেও এসেছে, আরো আসবে বার বার বিভিন্ন দেশে, বিভিন্নভাবে, বিভিন্ন সময়ে। আল্লাহ এই আয়াতসমূহে বলেন, ‘অভিশপ্ত হয়েছে পরিখাতে অগ্নিসংযোগকারীরা। বিশ্বাসীদেরকে আগুনে পুড়িয়ে মারার দৃশ্য দেখছিল তারা কিনারায় বসে, অথচ যাদেরকে তারা পুড়িয়ে মারলো, তারা শুধু প্রশংসিত আল্লাহকে বিশ্বাস করেছিল। যারা এই নিপীড়ন করেছে আর তওবা করেনি, তাদের জন্য আছে জাহান্নাম।’ এভাবেই মুসলমানদের উপর অকথ্য নির্যাতন করে বিভিন্ন দেশের অত্যাচারী শাসকেরা এখনো ক্ষমতার চেয়ারের কিনারায় বসে আমাদের মরার দৃশ্য দেখছে আনন্দে।
পবিত্র কোরানে বর্ণিত সেই ঘটনার সাথে বর্তমান ফিলিস্তিনের ঘটনাবলী অতি সাদৃশ্যপূর্ণ। তখন সাহাবারা (রা.) হয়তো জানতে চেয়েছিলেন, এই জুলুম কীভাবে শেষ হয়েছিলো? সেই সময়ের দখলদারি ইহুদিদের ধ্বংস করেছিলেন আল্লাহ আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান রাজা নাজাসসী বা নেগুসকে দিয়ে। তিনি রোমানদের সহায়তায় ৭ বা ৭০ হাজার সেনা নিয়ে ইহুদি রাজত্বের অবসান ঘটান। নেতানিয়াহুর মতো তস্কর রাজা নৌয়াজ তার নিজের জ্বালানো আগুনে পুড়ে মরেছিলো, অথবা কারো মতে নিহত হয়েছিল অবিসিনিয়ান সেনাদের হাতে। কাবা’র আদলের চেহারার গির্জা নাজরানে তৈরি করা হয়েছিল আবার। নিশ্চয়ই বিশ্বাসীরা সেদিন উচ্চস্বরে বিজয়ের তকবির দিয়েছিলো ‘আল্লাহু আকবর’। আর্মেনিয়া, গ্রিকসহ কয়েকটি দেশের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা কেউ ডিসেম্বরে, কেউ অন্য মাসে কোরানে বর্ণিত ইহুদিদের দ্বারা খ্রিস্টান নিধনের সেই দিনটি এখনো পালন করে তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য হিসেবে। নাজরানে কাবেলা নামের গ্রামে চৌকোণা যে গির্জাকে কাবা নামে ডাকতো বিশ্বাসীরা, তার ধ্বংসাবশেষ ও ভিটির চিহ্ন এখনো টিকে আছে। গির্জার নাম থেকে গ্রামটির নাম কাবেলা হলো কিনা, কেউ জানে না। সৌদি সরকার একটি মিউজিয়াম বানিয়েছে কাবেলা গ্রামে। সেখানে ঢোকার মুখে প্রস্তর ফলকে উৎকীর্ণ আছে সুরা আল বুরুজের ৪-৭ নম্বর আয়াত।
আমি নিজে কাবেলা গ্রামে গিয়ে সুরা বুরুজের নিদর্শন নিয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় আরব আলেমগণ জানালেন, আগুনে মারা ছাড়াও তরবারী দিয়ে যাদের হত্যা করা হয়েছিল তাদের অস্থি একসময় দেখা যেত, এখন সব মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হয়েছে। পাথরে ঢাকা পরিখার ফাঁক ফোঁকর দিয়ে পাথরে এখনো কালো শিখার দাগ নাকি দেখা যায়। আমি ঘুরে আসার কয়েক বছর পরে প্রত্নতাত্তিকরা আল উখদাদের অনেক স্থাপনা আবার খুঁজে বের করেছেন। পাথরের ওপর লেখা হায়েরওগিফগুলি এখন সৌদি সরকারের কাবেলা যাদুঘরে। কার্বন ডেটিংয়ের সাথে সব কিছু মিলে যাওয়ার আগে পশ্চিমের পন্ডিতেরা কোরআনের এই ঘটনাকে ‘কথিত’ বলে প্রচার করত, এখন আর সে সুযোগ নেই, এখন এটি প্রমাণিত ইতিহাস।
ফিলিস্তিন আর ইসরাইলের সংঘাত যুগ যুগ ধরে চলমান। এই সংঘাতে নিশ্চয়ই আল্লাহ নির্যাতিত ফিলিস্তিনি মুসলমানদের সঙ্গেই আছেন। উখদাদে দখলদার নৌয়াজের যে পরিণতি হয়েছিল, নেতানিয়াহুদের জন্যও অনুরূপ পরিণতি অপেক্ষা করছে। ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধারা প্রতি-আক্রমণের সময় শ্লোগান দিচ্ছেন, ‘আল্লাহু মাআনা’- আল্লাহ আমাদের সঙ্গে। তাই ফিলিস্তিনিদের মার খেতে দেখে বিশ্বাসীদের হতাশ হবার কিছু নেই, বিজয় শেষতক অবশ্যই হবে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।