পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ফিলিস্তিনের ভূমির অধিকার শুধুই আরবদের। জর্ডানের একজন এমপি সংসদে বক্তৃতা দিতে দাঁড়িয়ে এ কথা আবারো অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে স্মরণ করিয়ে দিলেন। হাজার বছর ধরে আরব ইহুদি ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে আসছিল। খৃষ্টীয় ৬ষ্ঠ শতকে ইসলামের আর্বিভাবের অনেক আগেই আরব ইহুদিরা রোমান ও খৃষ্টানদের দ্বারা বাস্তুচ্যুত, ধর্মান্তরিত হয়ে একটি ক্ষয়ীষ্ণু ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠিতে পরিণত হয়েছিল। ইসলামের বিজয়ের পর ইহুদি ও খৃষ্টানদের ধর্মান্তরকরণে বাধ্য করা হয়নি। ইতিপূর্বে রোমান ও খৃষ্টানদের অনুরূপভাবে মানবেতর শর্ত জুড়ে দিয়ে তাদেরকে শৃঙ্খলিতও করা হয়নি। ইহুদি জাতির গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসে শুধুমাত্র স্পেনের মুসলিম শাসনের সময়টাকেই জুইশ গোল্ডেন এজ বলে অভিহিত করা হয়। সে সময় আইবেরিয়ান পেনিনসুলায় ইহুদিরা যে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা পেয়েছিল সে সুযোগ কাজে লাগিয়ে ইহুদিরা নিজেদের সামাজিক-অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। ইসলামের সাথে অন্যান্য ধর্মাবলম্বিদের জীবনাচার ও রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের সুস্পষ্ট পার্থক্য ও অধিকতর গ্রহণযোগ্য হওয়ার কারণেই আরব ইহুদি-খৃষ্টানরা ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। আব্রাহামিক রিলিজিয়নের ইতিহাস অনুসারে, বিশ্বের প্রাচীনতম ধর্মীয় ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জনপদ ফিলিস্তিন ও জেরুসালেমের আল আকসা মসজিদ, ডোম অব দ্য রক বা খৃষ্টান, ইহুদি ও মুসলমানদের পবিত্রতম গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্যবাহী স্থান ও টেম্পলগুলো বারবার আক্রান্ত ও ধ্বংস্তুপে পরিণত হলেও শুরু থেকে মুসলমানদের হাতে এসব পবিত্র স্থানের কোনো ক্ষতিসাধিত হয়নি। খলিফা ওমর (রা.) থেকে সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এবং পরবর্তী ৮শ’ বছর ধরে চলা উসমানীয় খেলাফতের সময়ে ফিলিস্তিন ও জেরুসালেমের পবিত্র স্থান এবং জাতিসমূহের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করা হয়েছিল। মুসলমান শাসকরা যদি চাইতেন ফিলিস্তিন বা আরব ভূখণ্ডে ইহুদি জনগোষ্ঠির অস্তিত্ব নিশ্চিহ্ন করে দিতে, তাহলে তা অসম্ভব ছিল না। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী ও ভাষাতাত্বিক, ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতির পন্ডিত শেলডন পোলক এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভারতের মুসলমান সুলতান ও মোঘল শাসকরা যদি হিন্দুদের ধর্মান্তরকরণে ইচ্ছা করতেন, তাহলে মুসলমান শাসনের ৭-৮শ’ বছরে ভারতে কোনো হিন্দু থাকতো না। ভারতের মুঘল শাসকদের হিন্দুদের ধর্মীয় সংস্কৃতি পুনরুদ্ধারে চেষ্টা করেছিলেন বলেও এই ইহুদি পন্ডিত মন্তব্য করেছেন। অথচ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর অর্ধ শতাব্দীর মধ্যেই পশ্চিমা আধুনিক গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার সাংবিধানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ভারতের হিন্দু শাসকগোষ্ঠি সে দেশে হাজার বছর ধরে বসবাসরত মুসলমানদের বিতাড়িত করার হুমকি দিচ্ছে! এভাবেই ইতিহাসের ঘটনাক্রম অন্যান্য ধর্মীয় সংস্কৃতির সাথে ইসলামের পার্থক্য ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রমানিত হয়। তবে ভারত থেকে বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে বিতাড়িত করার ইতিহাস আছে। হয়তো গোপণ রাজনৈতিক এজেন্ডা নিয়ে ঠিক সেভাবে মুসলমানদেরও বিতাড়িত করতে চায় হিন্দুত্ববাদীরা।
মানবসভ্যতা, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও প্রযুক্তিগত উত্তরণ স্রেফে সামরিক শক্তিমত্তার উপর নির্ভর করে অগ্রসর হয়নি। জাতিগত বিভাজন, গোষ্ঠিগত পক্ষপাত ও সাম্প্রদায়িক মনোভাবের প্রভাব সত্তে¡ও মানব সমাজের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে রয়েছে গ্রহণ ও বর্জনের এক নিবিড় বিচারিক ক্ষমতা। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে বিশেষ ক্ষমতা, সুযোগ সুবিধা ও মর্যাদা ভোগ করেও পশ্চিমা মিশনারিদের নিরন্তর প্রয়াস সত্তে¡ও দুইশ’ বছরে ভারতের ২ ভাগ মানুষও খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেনি। অন্যদিকে ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টরের কারণে বৃটিশ শাসকরা মুসলমানদেরকে নানাভাবে বঞ্চনা ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শোষণের টার্গেটে পরিণত করার পরও ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় পরিচয় ও চেতনা পরিত্যাগের কোনো নজির নেই। গত সাড়ে সাত দশক ধরে ফিলিস্তিনের মুসলমানরা তাদের হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইঙ্গ-মার্কিন সমর্থনপুষ্ট জায়নবাদি দানবদের সাথে লড়াই করছে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্রে জায়নবাদিদের অবস্থান। তারা ছলেবলে কলাকৌশলে জেরুসালেম ও আল-আকসাসহ পুরো ফিলিস্তিনসহ সমগ্র আরব ভূমিতে জায়নবাদিদের আধিপত্য কায়েম করতে তাদের সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে চায়। ফিলিস্তিনের জনসংখ্যার শতকরা ১০ ভাগের কম সংখ্যক ইহুদির জন্য পৃথক ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগটি ছিল রাজনৈতিকভাবে অপরিপক্ক ও অবাস্তব। সেই অবাস্তবকে বাস্তবায়ণের লক্ষ্য হাসিলে অস্ত্রের জোরে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর দখল ও বুলডোজার দিয়ে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী জনপদ গুঁড়িয়ে দিয়ে লাখ লাখ আরব মুসলমানকে নিজ দেশে পরবাসি-উদ্বাস্তুতে পরিনত করা হয়। গত শতাব্দীতে দুইটি মহাযুদ্ধসহ অনেক যুদ্ধ ও প্রাকৃতিক দুযোর্গজনিত কারণে বিশ্বের দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষের উদ্বাস্তু সংকটের জন্ম হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কোরিয়া, জার্মানি, ভিয়েতনামসহ প্রতিটি যুদ্ধে সৃষ্ট উদ্বাস্তু ও বিভাজনের সংকট আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগের মধ্য দিয়ে সমাধান হলেও সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রেক্ষাপট ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট ফিলিস্তিন আরবদের সংকট সমাধানে বিশ্বসম্প্রদায়ের ব্যর্থতা মানব সভ্যতার চরম অবক্ষয় ও নেতৃত্বের ব্যর্থতার অমার্জনীয় নজির সৃষ্টি হয়েছে। ফিলিস্তিন ও জেরুসালেম সংকটের ন্যায়সঙ্গত সমাধানের ব্যর্থতা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পতনের নীতিগত সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমাদের উপর দোষ চাপিয়ে দেয়াই যথেষ্ট নয়, মুসলমান ও আরবদের মধ্যকার বিভাজন, বিভক্তি, ক্ষীণদৃষ্টির কারণে সৃষ্ট অনৈক্য শুধু ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করছে তা নয়, বিশ্বের শতকোটি মুসলমানকে জায়নবাদ প্রভাবিত পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র ও আধিপত্যের টাগের্টে পরিণত করা হয়েছে।
পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশকে লায়লাতুল ক্বদর বা কোরআন নাজিলের মহিমান্বিত রজনীতে মুসলমানদের জন্য মাগফিরাতের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। আর মুসলমানদের পবিত্রতম স্থানগুলোর মধ্যে মক্কামুনাওয়ারা ও মদিনার মাসজিদে নববীর পর মাসজিদুল আকসা বা বাইতুল মোকাদ্দাস হচ্ছে অন্যতম পবিত্র স্থান ও দ্বিতীয় ক্বিবলা। রমজান মাসে বিশেষ সওয়াব লাভের আশায় হাজার হাজার মুসলমান মাসজিদুল আকসায় ভিড় জমায়। অব্যাহত আগ্রাসন, শত বঞ্চনা, কষ্ট-যন্ত্রণার মধ্যেও ফিলিস্তিনের আরব মুসলমানরা প্রতিরোধ যুদ্ধ ও নিজেদের মুসলিম আত্মপরিচয় ও ইমানী দৃঢ়তার পরীক্ষা দিয়ে চলেছে। জায়নবাদীরা এই শক্তি ভেঙ্গে দিতে তাদের উপর বারবার বর্বরোচিত হামলা করেছে। ১৯৪৮ সালে ১৪ মে রাতের অন্ধকারে যুদ্ধজাহাজ বোঝাই করে পশ্চিমা সমরাস্ত্র, ট্যাঙ্ক ও বুলডোজার নিয়ে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর হামলে পড়েছিল। এভাবে ফিলিস্তিনিরা নিজেদের ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়েছিল। তিহাত্তর বছর ধরে এদিনটিকে নাকবা বা বিপর্যয় দিবস নামে পালন করছে ফিলিস্তিনী আরবরা। তিহাত্তর বছর পেরিয়ে এসে ২০২১ সালের ১৩ ও ১৪ মে ছিল আরবদের ঈদ ও ‘নাকবা’ দিবস। ঈদের দিন এবং নাকবার দিন ইসরাইল থেকে উড়ে আসা যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে শত শত ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে। ঈদের দিনসহ রমজানের শেষ ১০ দিনে দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি ইসরাইলী গোলার আঘাতে শহীদ হয়েছে। আহত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। উদ্বাস্তু শিবিরের উপর বর্বরোচিত হামলায় বাস্তুচ্যুত হয়েছে লক্ষাধিক ফিলিস্তিনী। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনে গাজাসিটিকে বিশ্বের বৃহত্তম খোলা কারাগারে পরিনত করেছে ইসরাইলিরা। স্থল, সমুদ্র ও আকাশপথ বন্ধ করে দিয়ে এখানকার ২০ লক্ষাধিক মানুষকে প্রতিবেশি বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সাথে যোগাযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। তাদের উপর বিশ্বসম্প্রদায়ের মানবিক সহায়তার পথও বন্ধ করে দেয়ার বর্বরোচিত নজির সৃষ্টি করেছে দখলদার জায়নবাদীরা। অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইলের অমানবিক দখলদারিত্ব ও আগ্রাসনের কারণে ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র আরব মুসলমানদের জন্য বারবার মৃত্যুর বিভীষিকা সৃষ্টির পরও আরব দেশগুলোর শাসক ও বিশ্বসম্প্রদায় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে আসছে। শুধু তাই নয়, ফিলিস্তিনের সাথে শান্তি আলোচনা ও দ্বিরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সমাধানের প্রতিশ্রæতি ভঙ্গ করার পরও আরব লীগ এবং ওআইসিভুক্ত ৃকতিপয় আরব দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসক্রিপশনে ইসরাইলের সাথে একপাক্ষিক সম্পর্কন্নোয়ন বা নর্মালাইজেশনের ফর্মুলা গ্রহণ করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রæতি এবং ফিলিস্তিনিদের রক্তের সাথে এসব আরব শাসকের বিশ্বাসঘাতকতা অগ্রাহ্য করার মত নয়।
সাম্র্যাজ্যবাদী ঠান্ডা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে উপনিবেশবাদ ও ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ শেষ হলেও আরব ভূখণ্ডের পশ্চিমা আধিপত্যবাদী নীতি শত বছরেও শিথিল হয়নি। তবে সাধারণ আরব জনগণ পশ্চিমাদের চক্রান্ত এবং শাসক রাজাদের বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে সচেতন রয়েছে। গত দশকে তিউনিসিয়া থেকে সৃষ্ট আরব বসন্তের ঢেউয়ে সমগ্র আরব উপদ্বীপে টালমাটাল অবস্থা থেকে সেটা সহজেই উপলব্ধি করা গেছে। মধ্যপ্রাচ্যের উপর পশ্চিমা আধিপত্য কায়েমের নীল নকশার অধীনে সৃষ্ট আরব রাজতন্ত্রের পশ্চিমা বশংবদ রাজাদের বশে রাখতে পশ্চিমারা নানা রকম কারসাজি ও জুজুর আশ্রয় গ্রহণ করে থাকে। ‘ঝিকে মেরে বউকে শেখানো’র মতো কখনো কখনো আরব প্রতিবেশীদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে তাদেরকে ভয়-ভীতিতে রাখার কোশেস করতে দেখা যায়। নাইন ইলেভেন বিমান হামলার ঘটনায় সরাসরি ওসামা বিন লাদেনসহ সউদী নাগরিকদের সরাসরি সম্পৃক্ততার কথা বলা হলেও যুদ্ধ ও দখলদারিত্ব কায়েম করা হয়েছে আফগানিস্তান ও ইরাকের উপর। আরব বসন্তের ঢেউয়ে তিউনিসিয়া ও মিশরে পশ্চিমা সমর্থনপুষ্ট শাসক বেন আলী ও হোসনি মোবারক ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতনের পর এই ঢেউ সউদী আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের শাসকদের গদি নাড়িয়ে দেয়ার উপক্রম হয়েছিল। সেই সাথে ইরানের সামরিকশক্তির অগ্রগতি ও পারমাণবিক প্রকল্পের জুজু দেখিয়ে আরব রাজাদের কাছে হাজার হাজার কোটি ডলারের অস্ত্র বিক্রি ও প্রতিরক্ষা চুক্তি করে আরব জনগণের সম্পদ লুন্ঠনের মধ্য দিয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক মন্দা কাটিয়ে ওঠার সহজ পন্থা গ্রহণ করতে দেখা গেছে। আরব রাজপরিবারের নানা অপকর্ম ঢেকে রেখে জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত রাখার বিনিময়ে শত শত কোটি ডলারের নগদ উপঢৌকনের তথ্য এখন ওপেনসিক্রেট। সউদী বংশদ্ভুত মার্কিন সাংবাদিক জামাল খাশোগি সউদী আরবে গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলতেন। তুরস্কের সউদী কনসুলেট ভবনের অভ্যন্তরে জামাল খাশোগিকে নির্মমভাবে হত্যার পেছনে সউদী যুবরাজের সম্পৃক্ততার তথ্য চাপা থাকেনি। এই ইস্যুকে কাজে লাগিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন সউদী আরবের কাছ থেকে বিপুল অর্থের স্বার্থ হাসিল করেছে বলে নানা মাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়। এভাবেই গত এক শতাব্দীতে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের অপকর্ম ও গদি রক্ষার বদৌলতে জনগণের স্বার্থকে গলাটিপে হত্যার সুদীর্ঘ ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। এটি মধ্যপ্রাচ্যসহ তৃতীয় বিশ্বে যেমন সত্য, তেমনি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও তার ব্যতিক্রম নয়। জায়নবাদী লবির এজেন্ডার পরোক্ষ গাইডলাইনের বাইরে গিয়ে জনগণের স্বার্থের পক্ষে যারাই কাজ করতে গেছেন তারাই নিহত অথবা গদিচ্যুত হয়েছেন। আব্রাহাম লিঙ্কন থেকে শুরু করে জন এফ কেনেডির হত্যাকান্ড এবং রিচার্ড নিক্সনের ক্ষমতা হারানো বা বৃটিশ রাজবধূ লেডি ডায়ানা বা ইয়াসির আরাফাতের মৃত্যুর নেপথ্য ঘটনাবলী বিশ্লেষণ করলে এই সত্য স্পষ্ট হয়ে যায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ এবং বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ মূলত কাদের হাতে? শোষণমূলক বিশ্বব্যবস্থা, বৈষম্য, অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাবস্থা ও আরব-ইসরাইল বিরোধ মীমাংসা করতে হলে এই প্রশ্নটির মিমাংসা জরুরী। ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পেছনের ইতিহাস এবং পরবর্তী ৭৩ বছর ধরে ফিলিস্তিনী জাতিকে নিশ্চিহ্ন করার জায়নবাদি এজেন্ডার পেছনে মদদদাতা হিসেবে ইঙ্গ-মার্কিনীদের ধারাবাহিক ন্যাক্কারজনক ভূমিকা সম্পর্কে বিচার বিশ্লেষণ করলে এটাই বেরিয়ে আসে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা তথা বিশ্ব অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি জায়নবাদি ইহুদি কর্পোরেট শক্তি ও মিলিটারি ইন্ডাসট্রিয়াল কমপ্লেক্সের হাতে। আমেরিকায় ক্ষমতার পালাবদল মধ্যপ্রাচ্য নীতি বা আরব-ইসরাইল সমস্যার সমাধানে আমেরিকার ভূমিকায় কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটায় না। এর কারণ হচ্ছে, আমেরিকার নির্বাচন ব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজানো হয়েছে যাতে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া ও নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে হলে জায়নবাদী লবির অনুমোদন ছাড়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ইহুদি ব্যাংকার কপোর্রেট প্রতিষ্ঠান, থিঙ্কট্যাঙ্ক, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, প্রযুক্তিগত ও সামাজিক-রাজনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মূল নিয়ন্ত্রণ জায়নবাদীদের হাতে। এ কারণেই ডোনাল্ড ট্রাম্প, জর্জ বুশ বা জো-বাইডেনের মত প্রেসিডেন্টরা জায়নবাদী ইহুদিদের শিখণ্ডী বা ক্রীড়নক ছাড়া আর কিছুই নন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ শ্লোগান তুলেন, তখন এর নেপথ্য মানে দাঁড়িয়েছিল, ‘ইসরাইল ফার্স্ট’। তাঁর ৪ বছরের শাসনামলে মার্কিন জনগণের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তেমন কিছু না ঘটলেও বিশ্বজনমত এবং মার্কিন জনগণের সাধারণ আকাক্সক্ষার বাইরে গিয়ে পুরো সময় ব্যয় করেছেন জায়নবাদী ইসরাইলীদের তুষ্ট করতে। মুসলমান দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের অবনমন, ভিসা বন্ধ করা, ইরানের সাথে পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি বাতিল করা, ইসরাইলের দাবির প্রশ্নে ইউনেস্কো, আইসিসি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সদস্যপদ প্রত্যাহার, আরব-ইসরাইল শান্তি আলোচনা এবং দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কমিটমেন্ট থেকে সরে যাওয়া এবং জেরুসালেমের অবস্থান ও মর্যাদার প্রশ্নে আন্তর্জাতিক সনদ ও মতৈক্যকে অগ্রাহ্য করে জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া এবং মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত থেকে বুঝা গেছে, ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতানিয়াহুর ক্রীড়নক ছিলেন।
ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে ট্রাম্পের তুঘলকি কান্ডের মূল অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছেন ট্রাম্পের জামাতা ও হোয়াইট হাউসের সিনিয়র এডভাইজার জেরেড কুশনার। ট্রাম্প হোয়াইট হাউস ছাড়লেও জায়নবাদীদের পোষ্য জেরেড কুশনার তার দায়িত্ব পালন অব্যাহত রেখেছেন। মার্চে বিজনেস ইনসাইডার অনলাইনে প্রকাশিত একটি ওপিনিয়ন কলামে জেরেড কুশনার ইসরাইলের সাথে কতিপয় আরবদেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করণের সাম্প্রতিক চুক্তির প্রতি ইঙ্গিত করে আরব-ইসরাইল সংকটকে একটি অতীত ইস্যু বলে মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে নিজের গদি হারানোর সমূহ আশঙ্কার মধ্যেও ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনীদের চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন। বিনা উস্কানিতে, বিনা কারণে রমজান মাসের শেষদিকে এসে আল আকসা মসজিদে নামাজরত মুসল্লিদের উপর বর্বরোচিত হামলার মধ্য দিয়ে এবারের যুদ্ধ শুরু করেছেন নেতানিয়াহু। এটাকে যুদ্ধ বলা চলে না, এথনিক ক্লিনজিং বলাই সঙ্গত। তিনি ফিলিস্তিনীদের প্রতিরোধ শক্তি ভেঙ্গে দিয়ে আরো বহু বছরের জন্য কবরের শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ যোদ্ধারা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙ্গে দিয়ে ইসরাইলের মাটিতে নজিরবিহীন পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ওআইসি, আরবলীগসহ বিশ্বসম্প্রদায়ের সমর্থন ফিলিস্তিনী যোদ্ধাদের মনোবল বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গত দেড় দশকে হিজবুল্লাহ ও হামাসের কাছে অন্তত তিনবার পরাস্ত আইডিএফ এবার মরণ কামড় বসাতে চাইছে। ফিলিস্তিনের উদ্বাস্তু নিপীড়িত ভূমিপুত্র জনগণ, হামাস-হিজবুল্লাহসহ সব প্রতিরোধ সংগ্রামী এবং ইরান-তুরস্কসহ মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তিগুলোর জোরালো অবস্থান জায়নবাদি ইসরাইলের আগ্রাসী শক্তির দাঁত ভেঙ্গে দেয়া খুব কঠিন বিষয় নয়। ফিলিস্তিনিদের মানবাধিকার, জায়নবাদিদের কবল থেকে আল আকসা মসজিদসহ জেরুসালেমের মুক্তি এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের বাস্তবতা এখন সময়ের দাবি। এ ছাড়া বিশ্বশান্তির প্রত্যাশা পূরণ হওয়া অসম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।