Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মমতার অবিস্মরণীয় জয়

| প্রকাশের সময় : ৪ মে, ২০২১, ১২:০২ এএম

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেস বিপুল বিজয় অর্জন করেছে। এটা দলটির হ্যাট্রিক বিজয়। অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের বিধানসভা নির্বাচন ছিল অনেকটাই আলাদা। পর্যবেক্ষকদের মতে, এটা ছিল একটা ঐতিহাসিক নির্বাচন। এই নির্বাচনের একদিকে ছিল রাজ্যে ক্ষমতাসীন তৃণমূল, অন্যদিকে ছিল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি। একদিকে ছিলেন তৃণমূলের অবিসংবাদী নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় অন্যদিকে ছিলেন কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। কেন্দ্রীয় সরকার ও পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র তৃণমূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেমেছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ নির্বাচনের প্রচার শুরুর পর থেকে পশ্চিমবঙ্গেই পড়ে ছিলেন। এসময় মোদি পশ্চিমবঙ্গে ১৫ বার আসেন। আর অমিত শাহ আসেন ৬২ বার। এছাড়া বিজেপির মন্ত্রিসভার অনেক সদস্য ও কেন্দ্রীয় নেতাও প্রচারণায় অংশগ্রহণ করেন। তৃণমূলকে রাজ্যের ক্ষমতা থেকে হটিয়ে বিজেপির প্রতিষ্ঠা ছিল মূল লক্ষ্য। এটাই ছিল বিজেপির লড়াইয়ের আসল কথা। তৃণমূলও একে লড়াই হিসেবেই নিয়েছিল। তার লড়াইয়ের উদ্দেশ্য ও সারকথা ছিল, উগ্র হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিষ্ঠা রুখে দেয়া। একইসঙ্গে বহিরাগতদের হাতে যাতে পশ্চিমবঙ্গের নিয়ন্ত্রণ না যায়, সেটা যে কোনো মূল্যে, নিশ্চিত করা। কিছুটা হলেও এই লড়াইয়ে পিছিয়ে থাকা তৃণমূলই ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছে। মোদি-অমিত শাহের শত চেষ্টা ও কৌশল কাজে আসেনি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতাকে গ্রহণ করেনি। তারা বাংলার নিজের মেয়ে মমতাকেই বিজয়মালা পরিয়েছে। এর আগেও তৃণমূল বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু এবারের বিজয় ও ক্ষমতায় আসা যে কতটা জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা সহজেই উপলব্ধি করা যায়।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন যখন হয়েছে, তখন আরো ৪টি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়েছে। ওইসব রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক গুরুত্ব কম পেয়েছে। একই সঙ্গে মিডিয়া কাভারেজও কম পেয়েছে। ভারতের সর্বত্র ও সর্বক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব পেয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। অন্যান্য রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফলে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন আসেনি। বলা যায়, যা ছিল তাই। কেরলে বাম, আসামে বিজেপি, তামিলনাডুতে ডিএমকে ও পদুচেরিতে এনডিএ বিজয়ী হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা আবহ বিজেপি তৈরি করে, যাতে অনেকের মধ্যে এই বিভ্রান্তি দেখা দেয় যে, বিজেপিই এবার রাজ্য ক্ষমতার দখল নেবে। এজন্য চেষ্টার এতটুকু ত্রুটি বিজেপি করেনি। নরেন্দ্রমোদি বাংলাদেশ সফরে এসে ভোটের রাজনীতি করেছেন। অমিত শাহ বাংলাদেশবিরোধী বক্তব্য দিয়ে একইভাবে ভোট কবজা করার চেষ্টা করেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কিছু হয়নি। মোদি-অমিত শাহের খায়েশ পূরণ হয়নি। তৃণমূল ২৯২ আসনের মধ্যে ২১৩, বিজেপি ৭৭ ও অন্যান্য ২টি আসন পেয়েছে। রাজ্য সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ছিল ১৪৮ আসনে বিজয়। কারো অজানা নেই, বিজেপি ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়। এই লক্ষ্যেই সে দীর্ঘদিন করে কাজ করে যাচ্ছে। ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। বিজেপি এই রাষ্ট্র-চরিত্র পাল্টাতে চায়। এজন্য হিন্দুত্ববাদকে আদর্শ হিসেবে নিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও হিন্দুত্ববাদ জাগিয়ে হিন্দুভোট হাতিয়ে ক্ষমতায় যেতে চেয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ অত্যন্ত সচেতনভাবে তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বিজেপি একটা শক্ত ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। তার এই অর্জনের পুরোটাই হিন্দু ভোটের ওপর নির্ভর করে এসেছে। হিন্দু তোষণ ও মুসলিমবিদ্বেষ ছড়িয়ে হিন্দু ভোট বাগানোর কৌশল অনেকখানি সফল হয়েছে। এটা অশনিসংকতে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। আগামীতে তৃণমূলকে এই হিন্দু-মুসলিম বিভেদ ও সম্প্রদায়িকতাকে বাড়তে না দেয়ার পদক্ষেপ নিতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের অসাম্প্রদায়িক ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সচেতন জনগোষ্ঠিকেও সতর্ক থাকতে হবে। আশার কথা এই, এত বিরোধিতা, এত প্রভাববিস্তারী কর্মকান্ড, এত বিদ্বেষ ও অপপ্রচার সত্তে¡ও আগের তুলনায় তৃণমূলের ভোট অন্তত ৬ শতাংশ বেড়েছে। তৃণমূলের এই ভূমিধ্বস বিজয়ে সচেতন মুসলমানদের একটা বড় ধরনের অবদান রয়েছে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন।

বিজেপির রাজনীতি গোটা ভারতকে বিভক্ত ও বিশৃংখল করে দিয়েছে। সর্বত্র নৈরাজ্য ও সন্ত্রাস বিস্তৃত করেছে। সমাজ ও অর্থনীতিকে করে তুলেছে বিপর্যস্ত। আঞ্চলিক পর্যায়ে ক্ষমতার দম্ভ, অস্ত্রক্রয়ের মাধ্যমে সামরিক শক্তিবৃদ্ধি ইত্যাদি মোদিশাসনের বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। হিন্দুত্বের মাহাত্ম্য প্রচার ও মন্দির স্থাপন, সংস্কারের মাধ্যমে জনতুষ্টি অর্জনের প্রয়াস মোদির মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। একটা ফলস ইমেজ তিনি এসবের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন। তবে দারিদ্র্যের বিস্তার, করোনা মোকাবেলায় শোচনীয় ব্যর্থতা ইত্যাদি কিন্তু তিনি এর মাধ্যমে আড়াল করতে পারেননি। মোদি শাসনের বিরুদ্ধে ভারতের সব দল মিলে যা করতে পারেনি, মমতার তৃর্ণমূল তা করে দেখিয়ে দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ও উগ্রসাম্প্রদায়িকতা রোধ করা যে সম্ভব, মমতা তা প্রমাণ করে দিয়েছেন। তিনি কেবল পশ্চিমবঙ্গের নন, গোটা ভারতের অন্যতম শীর্ষ নেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর দলের বিজয় বাংলাদেশসহ এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য ইতিবাচক বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা। বিজেপির দ্বারা বিভেদ, উগ্রতা, সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টির আশংকা এর ফলে কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে বলে তাদের ধারণা। আমরা মমতা বন্দোপাধ্যায়কে তার অবিস্মরণীয় বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাই।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন