পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রোজার মাস, তার ওপর চলছে লকডাউন। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীদের পোয়াবারো। রোজার মাস এলে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী কখন কীভাবে পণ্যের দাম বাড়ানো যায়, সে ভাবনায় যেন ওৎ পেতে থাকে। সরকার সচেষ্ট থাকে পণ্যের দাম যেন সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকে। এ জন্য আগে ভাগেই পর্যাপ্ত মজুত নিশ্চিত করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে। এবারও তা হয়েছে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকলেও কৃত্রিম সংকট তৈরি করার জন্য প্রস্তুত থাকে ঐসব অসাধু ব্যবসায়ী। বাজারে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানো হয়। মওকা বুঝে এ সময়টাতেই চাহিদা সম্পন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন তারা। বড় ব্যবসায়ী থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবার লক্ষ্য থাকে এই সময় বেশি লাভ তুলে নেয়া।
মোট জনসংখ্যার ৯০ ভাগ মুসলমানের এই দেশে পবিত্র মাসে এ অমানবিক কাজটি কেন হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। দেশে ব্যবসায়ীদের ৯০ ভাগেরও বেশি মুসলমান বলেই জানি। মুসলমান হয়ে রমজান মাসে এমন কাজ তারা করেন কী করে? সারা দুনিয়ায় ধর্মীয় উপলক্ষ বা উৎসবের সময় জিনিসপত্রের দাম বরং কমে। উৎসব ঘিরে ইউরোপ-আমেরিকায় ছাড়ের হিড়িক পড়ে যায়। মাসখানেক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় উৎসব। এ সময়টার জন্যই অনেকে অপেক্ষা করে। সারা বছরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে রাখে। ছাড় আর সেলের এ রীতি দুনিয়াজোড়া।
ব্যতিক্রম শুধু বাংলাদেশ। এখানে উৎসবের আগে পণ্যের দাম বাড়ে। রমজান মাসে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের অনেক মুসলিম দেশে মূল্য ছাড়ের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় পবিত্র রমজানে পণ্যে মূল্য ছাড় দেয়া হয়। এমনকি বাজারদর স্বাভাবিক রাখতে সরকারিভাবে নজরদারি চলে এসব দেশে। মুসলিম দেশগুলোতে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা তাদের পূর্বের মুনাফা থেকে ছাড় দিয়ে ব্যবসা করে। পণ্যের দাম না বাড়িয়ে সেখানে কমিয়ে দেন। বিশেষ ছাড় আবার অনেক ব্যবসায়ী লাভবিহীন পণ্য বিক্রি করে মাস জুড়ে। হিন্দু-অধ্যুষিত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও রোজার মাসে পণ্যের দাম বাড়ে না। সেখানেও কিন্তু আমাদের দেশ থেকে বেশি মুসলমানের বসবাস। প্রায় ১৭ কোটি ২২ লাখ।
আমাদের দেশের চিত্র উল্টো। রোজার মাসে প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যে পরিমাণ বাড়ানো দরকার ততোটাই তাদের ইচ্ছমতো বাড়িয়ে ছাড়ে ব্যবসায়ীরা। এবারো বাড়ছেই। করেরানাকারণে লকডাউনের অজুহাত পণ্যমূল্য বাড়ানোর উপলক্ষ হয়েছে। তাতে দামে পণ্য কিনতে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
কী হারে পণ্যমূল্য বেড়েছে তা সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) কাছ থেকেই জানা যাক। তথ্যমতে, ৩০ দিনের ব্যবধানে ১৪টি নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। চাল, প্যাকেটজাত আটা ও পেঁয়াজের কেজিপ্রতি দাম বেড়েছে যথাক্রমে পাঁচ, এক দশমিক ৬৫ এবং ৪৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ। খাসির গোশত ও মুরগির দাম প্রতি কেজিতে বেড়েছে যথাক্রমে পাঁচ দশমিক ১৭ এবং ছয় দশমিক ২৫ শতাংশ। এক মাসে প্রতি কেজি মোটা চালের দাম ৪৮ থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ টাকা, আর সরু চালের দাম প্রতি কেজি ৫৮ থেকে বেড়ে ৬৫ টাকায় দাঁড়িয়েছে। ভোজ্যতেলের দাম প্রতি লিটার ১২৫ থেকে বেড়ে ১৩৮ টাকা এবং গরুর গোশত প্রতি কেজি ৫৫০ থেকে বেড়ে ৫৭০ টাকায় পৌঁছেছে। গত এক বছরে চালের দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ, তেলের ৩৭ শতাংশ। তারপর রোজার রীতি অনুযায়ী, আবার আরেক দফা দাম বেড়েছে বিভিন্ন পণ্যের। সাধারণ মানুষের জন্য সেটা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এমনিতেই করোনারকারণে বেকার হয়েছে বহু মানুষ। আর চাকরি যাদের আছেও, তাদের আয়-রোজগার কমেছে। জরিপ বলছে, মহামারিতে মানুষের গড় আয় কমেছে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ। ফলে বর্তমান দাম যদি স্থিতিশীলও থাকে, তারপরও সাধারণ মানুষের চলা দায় হয়ে যাবে। এর মধ্যে আরো মূল্যবৃদ্ধি কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না।
পণ্যমূল্য বৃদ্ধির এই লাগামহীন ঘোড়া কোনো সরকারই রোধ করতে পারেনি। এমনকি সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত¡াবধায়ক সরকারও ছিলো এক্ষেত্রে ব্যর্থ। হুমকি-ধমকিতে সব জায়গায় তারা পারঙ্গম হলেও বাজার নিয়ন্ত্রণে তারা তেমন ভূমিকা রাখতে পারেননি। তখনও রোজায় নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি বাজার। মোটকথা, রোজা শুরু হলে যা হওয়ার তাই হয়। আর এ পরিস্থিতি অনেকটা গা সওয়া হয়ে গেছে আমাদের। পণ্যের দাম এতোটাই বাড়ে যে, গায়ে সয় কিন্তু পেটে সয় না। যাদের অনেক টাকা আছে তাদের সয়ে যায় সবই। আর যারা নিম্ন-আয়ের মানুষ, তাদেরই যতো জ্বালা। লকডাউনে মধ্যবিত্তের অবস্থাও ভালো নয়। যারা শহরে থাকেন তারা আছেন আরও বিপদে। বাচ্চাদের নিয়ে ভুখা থাকতে হয় অনেককে। এক বেলা খাবার জোটে তো অন্য বেলা জোটে না।
পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের কার্যকর ভূমিকাও অপ্রতুল। সঙ্গতকারণে সাধারণ মানুষের হতাশা ও দুর্ভোগ দিন দিন বাড়ছেই। কয়েক মাস ধরে অহেতুক অস্থির হয়ে পড়ে ভোজ্যতেল, চাল আর চিনির বাজার। আমদানির ওপর নতুন করে শুল্ক আরোপ করা না হলেও আমদানি করা ভোজ্যতেলের দাম বাড়ায় ব্যবসায়ীরা। রমজানকে ঘিরে দুই সপ্তাহ ধরে বাজারে ভোজ্যতেলের কৃত্রিম সংকটও সৃষ্টি করে আসছে ব্যবসায়ীরা। অতীতেও দেখা গেছে ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এসব তাদের পুরনো কৌশল। এসব যে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলের অজানা, তাও না। কাজেই সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ শক্ত হলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কেন সম্ভব নয়, তা আমাদের বোধগম্য নয়। মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ীর জন্য জনসাধারণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠবে, তা হতে পারে না। অযৌক্তিক মূল্যবৃদ্ধি কঠোরভাবে রোধ করতে হবে। সর্বোপরি বাজার নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ও দৃশ্যমান উদ্যোগ সবার প্রত্যাশিত।
নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসমূহের মূল্য স্থিতিশীল রাখার ব্যাপারে বর্তমান পরিস্থিতিতে যা করা দরকার তা হলো: বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোকে কার্যকর করতে হবে। মধ্যবর্তী শ্রেণির কারসাজি বন্ধ করতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণে ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর মূল্য সামঞ্জস্য আছে কিনা নিয়মিত তা তদারক করতে হবে। পরিবহন খাতের চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে। রমজান মাসে যেসব পণ্যের চাহিদা বেশি, তা বেশি করে জোগান দিতে হবে। পাইকারি বাজার থেকে মধ্যবর্তী শ্রেণি যাতে স্বার্থ হাসিল না করতে পারে, সেজন্য পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজার পর্যন্ত সরকারি নিজস্ব পরিবহন ও জনবলের মাধ্যমে পণ্যসামগ্রী পৌঁছে দিতে হবে। বেশি করে পণ্য আমদানি করে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন-বিক্রীর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি বিক্রয় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও সমাজ গবেষক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।