Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাংলা প্রবাদে ঈদ ও পূজা প্রসঙ্গ

প্রকাশের সময় : ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম | আপডেট : ১২:০২ এএম, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

ড. আশরাফ পিন্টু
পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর মানুষ রয়েছে। তারা নানা ধরণের ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। প্রত্যেক ধর্মের মানুষের কাছে তাদের নিজ নিজ উৎসব খুবই পবিত্র। বাংলাদেশে দুটি বৃহৎ ধর্মের অনুসারী রয়েছে। এরা হলো মুসলমান ও হিন্দু  সম্প্রদায়। এ দুটি সম্প্রদায় বছরে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব পালন করে থাকে। আমাদের আলোচ্য বিষয় হলোÑ ‘বাংলা প্রবাদে ঈদ ও পূজা প্রসঙ্গ’। এখন আমরা দেখব বাংলা প্রবাদে ঈদ ও পূজা কতটুকু প্রভাব ফেলেছে।
    ঈদ : ঈদ হলো মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব। বছরে দু’বার তারা এ উৎসব পালন করে থাকে। ১. ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ ২. ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ। এ দু’টি উৎসবের পৃথক পৃথক পটভূমি রয়েছে।
    ঈদুল ফিতর : আরবি রমজান মাসের রোজা পালন শেষে শাওয়াল মাসের প্রথম দিনে ‘ঈদুল ফিতর’ অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ১ মাস রোজা রেখে সংযম ও সহানুভূতির শিক্ষা গ্রহণ করে। ‘ঈদুল ফিতর উৎসব’ পালনের পূর্বে মুসলমানরা একত্ববাদ বিবর্জিত ‘নওরোজ’ ও ‘মিহিরজান’ উৎসব পালন করত। কোরানের আদেশ অনুযায়-ই মুসলমানরা ঈদ উৎসব পালন শুরু করে। যা হোক, ঈদ মানে আনন্দ বা ‘খুশি’। এই আনন্দ বা খুশির ঢেউ বয়ে যায় একমাস সিয়াম সাধনার পর। অর্থাৎ দীর্ঘ এক মাস কঠোর সংযম সাধনার পর মুসলমানরা ১ শাওয়ালে চির আকাক্সিক্ষত ঈদের চাঁদ পশ্চিমাকাশে খুঁজতে থাকে। আর এ থেকেই ‘ঈদের চাঁদ’ প্রবাদধর্মী বাক্যাংশ (বাগধারা)Ñ এর উৎপত্তি। এই আকাক্সিক্ষত ‘ঈদের চাঁদ’ ছোট-বড়  ধনী-গরিব, কালা, খোড়া সবাই দেখে। সেখানে কোন ভেদাভেদ নাই। তবুও কুঁজো যখন চাঁদ দেখে তখন কারো কারো যেন আপত্তিÑ
‘কুঁজোর আবার চাঁদ দেখার সাধ’।
এতে অবশ্য কুঁজোর কোনো যায় আসে না। কেননা মহান আলাহর কাছে সবাই সমান; সবাই তার বান্দা। আবার কেউ কেউ আলস্যভরে ঘরের ভিতরেই বসে থাকে তাদের বক্তব্যÑ            ‘দুদিনের চাঁদ ঘরে বসেই দেখা যায়’।
    ঈদুল আজহা : ‘কোরবানি’ এর অর্থ ‘ত্যাগ’ বা উৎসর্গ। হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর প্রাণপ্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আ.)Ñকে আল্লাহর নামে কোরবানি করতে নিয়ে যান। আল্লাহ তাঁর অগ্নিপরীক্ষায় সন্তুষ্ট হয়ে ইসমাইলের পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি করার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে এ স্মৃতি স্মরণ করে উট, দুম্বা, গরু, ছাগল ইত্যাদি গবাদিপশু কোরবানি বিধান চালু হয়। তখন থেকে মুসলমানেরা জিলহজ মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ পালন করে আসছে।
    যা হোক আমরা বাংলা প্রবাদে ঈদুল আজহার প্রভাবও দেখতে পাই। কোরবানির জন্য বা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে পশু কোরবানি দেওয়া হয় তা হতে হয় অবশ্যই নিখুঁত বা মোটাতাজা। আর এজন্য ঈদের অনেক পূর্বে থেকেই সে পশুকে মোটাতাজাকরণের জন্য সবাই ব্যস্ত হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে পশুটি হয়ে ওঠে ‘খোদার খাসি’। এরপর পশু কোরবানি করা হয় ঈদের দিন।    ঈদের দিনে মাংস বণ্টন করা হয় গরিব, ফকির, মিসকিন ও আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে। কিঞ্চিত পরিমাণ রাখার নিয়ম রয়েছে কোরবানিকারী ব্যক্তির। কেননাÑ ‘ভোগে সুখ নয় ত্যাগেই সুখ’। কিন্তু আমরা প্রবাদের এ নিয়ম না মেনে কোরবানির ‘সিংহ ভাগ’ মাংসই রাখছি নিজের জন্য, মাসের পর মাস সংরক্ষণের জন্য নিজস্ব হিমাগারে।
    দুর্গাপূজা :  প্রবাদ আছেÑ ‘হিন্দুদের বারোমাসে তেরো পার্বণ’। অর্থাৎ হিন্দুদের আরাধ্য দেব-দেবী যেমন অসংখ্য তেমনি পূজা-পার্বণও অনেক। এরমধ্যে দূর্গাপূজা হলো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। হিন্দুশাস্ত্রে আছে : দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেন মহাদেবের স্ত্রী দুর্গা। দুর্গম অসুরের কাজ ছিল জীবকে দুর্গতি দেয়া বা দুঃখ-কষ্টে ফেলা। সেই দুর্গম (মহিষাসুর)Ñকে বধ করে তিনি (দুর্গা) জীব জগৎকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন। বাংলাদেশে দুর্গা পূজা হয় শরৎকালে বা আশ্বিন মাসে। এ নিয়েও প্রবাদ আছেÑ
পাঁজি হয়েছে উজন-সুজন
কার্তিক মাসে দুর্গা পূজা।
    দুর্গাপূজা যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় উৎসব কিন্তু সে উৎসবে ঘটা না করে যদি অন্য কোনো ছোটখাটো উৎসব ঘটা করে পালন করা হয় তখন স্বভাবতই মুখ দিয়া বেরিয়ে আসেÑ
‘দুর্গা পূজায় ঢাক বাজে না,
ষষ্ঠী পূজায় ঢোল’।
    আবার অন্যান্য সম্প্রদায়ের লোকেরা খড় ও মাটির তৈরি দুর্গা প্রতিমা দেখে ব্যঙ্গ করে। তাদের কাছেÑ
    ‘হিঁদুদের দুগ্গা পূজো উপরে চিন-চাকন
                ভিতরে খড়ের বুঁজো।
    লক্ষ্মীপূজা :    শিব ও দুর্গার কন্যা হলেন লক্ষ্মী দেবী। ঐশ্বর্যের দেবী হিসেবে হিন্দুদের ঘরে ঘরে লক্ষ্মী দেবীর পূজা হয়ে থাকে। লক্ষ্মী সম্পর্কিত বহু প্রবাদ শোনা যায়।
যেমনÑ
১.    হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা।
২.    লক্ষ্মী আসতে দুয়ারে আগড়।
৩.    লক্ষ্মীর ঘরে কালো পেঁচা।
৪.     হাড়ির লক্ষ্মী শুঁড়ির ঘরে।
৫.    দক্ষিণে তাল উত্তরে বেল
    লক্ষী ছাড়িয়ে গেল।
    বাঙালি সমাজ জীবনে লক্ষ্মীদেবী বা লক্ষ্মীর এমনই প্রভাব যে হিন্দু মুসলমান উভয়ের কাছে তিনি ‘গুণ’ বা ‘ভালো’র প্রতীকরূপে স্থায়ী আসনে অধিষ্ঠিত।
    কালীপূজা : কালী হলেন শিবের পতœী কালীদেবী দেখতে কালো ও ভয়ঙ্কর। তার এ চেহারা নিয়েও প্রবাদÑ ‘রক্তদন্তী কালী’। কালীর চেহারা যাই হোক তাঁর সামনে পাঁঠাবলি দিয়ে ভক্তরা পূণ্যি সঞ্চয় করে। তবে নিচের প্রবাদটিতে ভক্তি অপেক্ষা পাঁঠা খাওয়াই যে মূল উদ্দেশ্য তা প্রকাশিত হয়েছেÑ
‘কালীর দোহাই দিয়ে পাঁঠা খাওয়া’।
    কালীকে নিয়ে এমন কিছু প্রবাদ আছে যা হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়কে ঐক্যসূত্রে গ্রোথিত করেছে। সব ধর্মই সমান এমন কথাই প্রকাশিত হয়েছে; সেই সাথে তীব্র কশাঘাতে সামাজিক ভেদবুদ্ধিকে নিন্দা করা হয়েছেÑ
১.    রাম, রহিম, কালী,
    ভেদ করলেই মলি।
২.    কালী কালী বনমালী
    শেখ পরাণে জয়ধর আলি।
    পরিশেষে বলা যায়Ñ ঈদ বা পূজা যে উৎসবই হোক না কেন তা আনন্দের। সেই আনন্দের পাশে হৃদয়পটে আঁকা থাকে যেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমরা ঈদ-পূজা বিষয়ক বাংলা প্রবাদে যেমন স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের সন্ধান পাই, তেমনি পাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার সন্ধান।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বাংলা প্রবাদে ঈদ ও পূজা প্রসঙ্গ
আরও পড়ুন