শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
কাজী সিকান্দার
জামিল সাহেব চিন্তায় মগ্ন। এলোমেলো ভাবনার আনাগোনা। খানিক যেন ক্লান্ত। দেখা যাক জীবনের মোড় কোন দিকে যায়। নিঝুম রাত। সে বারান্দা থেকে ঘরে এলো। তাকালো ঘুমন্ত মানবীর দিকে, ভাবছে। কতটি বছর আমার সাথে কাটিয়ে দিল। যেন সে কিছুই বুঝে না জীবন, সংসার। কোন চিন্তা নেই, ভাবনা নেই, যা মনে চায় তা করে। এমনি একটি কাজ করে বসলো। এলোমেলো করে দিল তার পরিকল্পনাকে, চিন্তা ও চেতনাকে। ইচ্ছা ও আশাকে। তবে তার রক্তের উপর বিশ্বাস ছিল। তার নিজ অর্জিত সম্পদের উপর আস্থা ছিল। সেই রক্ত ও উপর্জনের খাদ্যই তো নাহিদার শরীরে বহমান। সে নিজেই তার বিহিত করলো। এখন যেন ভালোয় ভালোয় দিন অতিবাহিত হয় এই কামনা। জামিল সাহেব ভবতে ভাবতে ঘুমিয় গেল। নাহিদা আজ কয়েকদিন তার স্বামীর বাড়ি থেকে এসে বড় ভাইয়ের বাসায় উঠেছে। বাড়িতে যায়নি। না জানি নাস্তিকের খপ্পরে আবার পড়ে নাকি। বড় ভাই সব শুনে যেমনি বিস্ময় প্রকাশ করেছে তেমনি খুশিও হয়েছে।
এক ভাই ও এক বোন। নাহিদা ছোট। কোনোদিন মা-বাবা কোন কিছুর অভাব অনুভব করতে দেয়নি। কোন কাজও করতে বাধা দেয়নি। তাই বেড়ে উঠেছে নিজের মত করে, একান্তই নিজের মত। ভাই ও বাবার অমতে ছয় মাস আগে তার খালতো ভাইয়ের সাথে চলে গেছে। বিয়ে করেছে। তার মা ও খালা সম্পূর্ণ রাজি ও খুশি। কিন্তু বাবা ও ভাই বার বার তাকে বুঝিয়েছে যে, নাস্তিকদের জীবন হায়ওয়ান জানোয়ারের জীবনের ন্যায়। তাদের সংসার ঠুনকো কাগজের ঘরের ন্যায়। তারা অভিভাবকহীন ও মালিকহীন। বন্য তাদের জীবনধারা। নাহিদা কথাগুলো শুনে হাসতো। খিলখিলিয়ে হাসতো। উচ্চ স্বরে হাসতো। কিছুই বলতো না। একসময় তারা ঘর বাঁধলো। সুখেই যাচ্ছিল সময়। বাসা ভাড়া নিয়ে সংসার পেতে বসেছে। দিন যায় রাত আসে। এমনি করে সময় পার হচ্ছে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে। বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় ভ্রমণ করছে। হয়তো আরো কিছুটা কাল যেতে পারতো। বা সারাজীবন এমনি করে পার করতে পারতো। কিন্তু পার করা হলো না।
সেদিন তারা নাইট ক্লাবে গেছে। কত রঙবেরঙের বিষয় বা রঙ ভাসছে চোখের সামনে! নাহিদা দর্শক, কিন্তু শাকিল অভ্যাস অনুযায়ী সবই করলো। নাচলো, গাইলো ও খেলো। কয়েক দিন পর শাকিলদের সেমিনারে নিয়ে গেলো নাহিদাকে। সে গেলো, শত বুলি শুনলো, খুবই ভালো লাগলো। আপসোস করে ভাবলো- হায়, এই বক্তাদের মতো যদি সারা দেশের মানুষ হত। তা হলে শান্তি অচিরেই চলে আসতো। তাদের দর্শন নারী মুক্তি ও সমাজ সংস্কার তার খুবই ভালো লাগলো। মনে মনে স্থির করলো তাদের সাথে কাজ করার। এতদিন তাদের সাথে সম্পৃক্ত হতে পারেনি ভেবে নিজের কাছেই নিজেকে ছোট মনে হলো।
কয়েক দিন পর রাতে হই হই করে অনেক বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে শাকিল বাসায় উপস্থিত। নাহিদাকে বলল নাস্তা নিয়ে তাদের কাছে যেতে। তাদের সাথে গল্প ও আড্ডা দিতে। নাহিদা বাবা জামিল সাহেবের শিক্ষা অনুযায়ী মুখ ঢেকে তাদের সামনে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
শাকিল মুখের নেকাব খুলে দিয়ে বলল, এভাবে যাও।
থমকে দাঁড়ালো নাহিদা।
শাকিল বলতে লাগলো, দাঁড়ালে কেন, যাও? শোনো, এতদিন কিছুই বলিনি নতুন বলে। আমার সাথে সব জাগায় ওই নেকাব পরে গেছ। আমি কত লজ্জা পেয়েছি জান?
নাহিদা কিছুই বলেনি। যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে তাকে কষ্ট দেয়া ঠিক না। নিজ রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
কয়েক দিন পর শাকিল কয়েকজন মেয়ে ও ছেলে নিয়ে এলো, সাথে কিসের পানি। কি নাকি উদযাপন করবে। নাহিদাকে বলল পরিবেশন করার জন্য, তাদের সাথে আড্ডা ও কথা বলার জন্য। নাহিদার এগুলো একটুও ভালো লাগে না। ভিন্ন নর-নারীর সাথে আড্ডা দেয়া। খোলা মেলাভাবে চলাফেরা করা।
সে বলে, আমার এগুলো ভালো লাগে না। তাছাড়া অন্য পুরুষের সাথে মেলামেশা ভালো দেখায় না। তুমি আমার স্বামী। তোমার সাথে আমার সব গল্প, হাসি-তামাসা ও আনন্দ-উৎসব। শাকিল মেনে নেয় না, বলে, না, তোমাকে আমার ভাইদের সাথে দেখা করতে হবে, আমার বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে হবে। মুখ ঢেকে রাখা চলবে না।
নাহিদা বলে, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আর তা আমার একান্তই ব্যক্তিগত অধিকারও। আমার অধিকার কেন খর্ব করবেন? নিজের বৌকে অন্যের সামনে যেতে বলেন, পর পুরুষের সাথে আড্ড দিতে বলেন, লজ্জা করে না?
শাকিল আচমকা নাহিদার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।
নিস্তব্ধ নাহিদা দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবনায় বিভোর। এই তাদের লম্বা লম্বা বক্তৃতার সার নির্জাস! এই তাদের স্বাধীনতা! তা হলে আমি কেন আমার মত করে থাকতে পারবো না? তাহলে তাদের স্বাধীনতা কেমন? মনে পড়ে গেলো বাবা ও ভাইয়ের কথা। সে শুনেছিল নাস্তিক যারা হয় তাদের কোনো বাদ বিচার নেই। কোনো আত্মচেতনা নেই। হুযুগের উপর চলে। লোভ ও ভোগের যুক্তিতে তারা বলিয়ান। ভোগ তো এমন যা কোন কিছুর বাধা রেখা মানে না। তারা সেই যুক্তির পিছনে রাত দিন ছুটে চলে।
সে ভাবতে লাগলো, না, আর হবে না। সে যা শুনেছে তা যে সম্পূর্ণ বাস্তব বুঝতে পারেনি। আজ কয়দিনে তার পরিপূর্ণ দৃশ্য তার সামনে এলো। তাদের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকে না। না নিজের উপর না পরের উপর। নিয়ন্ত্রণ নেই বলেই তারা নাস্তিক। আস্তিক হলে তো তাদের নিয়মের সীমায় চলে আসতে হবে, তাই তারা তা চায় না। না, নাস্তিক ও আস্তিকের সাথে কখনো হবে না। দু পথের দু পথিক কখনো একসাথে চলতে পারে না। সে চায় না বেলালা পনা। অবাধ বিচরণ। অবাদে মেলামেশা যা মানব দেহে আনে এইডস আর আত্মার দেহে আনে পঙ্কিলতা। তার মতে মেয়ে হল ঘরের শোভা। সে ঘরকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বল করবে তার মহিমা, আদর ও নারীত্বের শোভা দিয়ে। সাজাবে নিজ ঘরকে। সাজাবে সন্তান ও স্বামীকে। তবে ঘর থাকবে নিরাপদ ও সুন্দর। পুরুষটি শক্তি, সাহস ও উদ্দামতা নিয়ে ঘর থেকে বের হতে পারবে। জয় করতে পারবে সারাজগত। ঘর যদি হয় অবসাদে পরিপূর্ণ তা হলে পুরুষ কিভাবে জয় করবে দেশের পর দেশ, মানুষের হৃদয়। সে সিন্ধান্ত নিল। না, আর এক পাও অগ্রসর হওয়া যায় না। সে তাদের কথা ও কাজে কোনো মিল খুঁজে পায় না।
বড় ভাইয়ের বাসায় চলে এলো নাহিদা। বাবাকে ফোন করে সব বলল। বড় ভাই ও বাবা মহাখুশি। যাক, নাস্তিকের কবল থেকে মেয়ে ও বোনটি বেঁচে এসেছে। তাদের আশা ছিল নিশ্চয়ই তার ভুল ভাঙবে।
দুই
দেখতে দেখতে তিন-চার মাস পার হয়ে গেল। শুভ্র সফেদ সকাল। নির্মল প্রভাত। নাহিদা সুন্দর একটি সকাল করলো আজ এতদিন পর। পরম আনন্দে ও খুশির সাথে। আস্থা ও নিষ্ঠার সাথে। স্থিতির দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে যেন আজ রবি উদিত হল। শহিদের পাশে বসে নির্ভয় ও পরম তৃপ্তির সাথে বললো, আজ হৃদয়ে যেন প্রশান্তির বায়ু প্রবাহিত হলো। যেন খুশির বান ড়েকেছে আজ মনে। আজ অনেক দিন পর একটি রাত কাটালাম। যেন অমি নতুন জন্মগ্রহণ করেছি। পানিতে যেমন মাছ প্রশান্তির ঢেকুর তোলে তেমনি যেন আজ শান্তি আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলছি।
শহিদ বলল, মজার ব্যাপার তো! আজ আমারও মনে হচ্ছে শত বছর পর একটি রাত কাটালাম প্রশান্তি ও তৃপ্তির সাথে। এমন রাত যেন আর কোন দিন ফিরে না যায় আমাদের থেকে।
নাহিদা বলে, না, আর যাবে না। কারণ আমি এতদিন মাছ হয়ে ডাঙ্গায় ছিলাম আজ জলে নেমেছি।
শহিদ বলে, আমিও এমন একটি মাছ ও পানির আশায় ছিলাম। আমার জীবনে যে মাছ আর পানি যা ছিল তার নাম বিউটি। কিন্তু তার হৃদয়ে সুন্দরের কিছুই নেই। সাজগোজ আড্ডা ও ঘুরে বেড়ানো বেহায়ার মত। এটাই নাকি স্বাধীনতা। নাস্তিকতা চর্চা করতো। আমাকে বলতো আমিও যেন তার মত মেয়েদের সাথে ঘুরি, আড্ডা দিই সে যেভাবে তার শত বন্ধুর সাথে রাত দিন কাটায়। যা ছিল একদম বিষতুল্য। আমার বৌ হয়ে আবার অন্য জনের সামনে যাওয়া তো দূরের কথা, দেখা করা, বিনা প্রয়োজনে কথা বলা, একদম অসহ্য আমার। অনেক চেয়েছি বুঝাতো, না সে ফিরে আসবে না। আমিও সিন্ধান্ত নিলাম নাস্তিকের সাথে আমার হবে না। নাস্তিকদের কোন স্বকীয়তা নেই। তারা বেলাল্লাপনাকে স্বাধীনতা মনে করে। ভোগ করতে পারাকে স্বাধীনাতা মনে করে। যার তার মেয়ে, বৌ, ছেলে ও স্বামীর সাথে ঘুরা কে স্বাধীনত মনে করে। তারা নিয়ম ভঙ্গ করাকে গৌরব মনে করে। তারা মিথ্যা যুক্তির পিছনে ঘুরে। মেনে নেয়ার যোগ্যতা তাদের নেই বিধায় তার নাস্তিকতা চর্চা করে। যারা নাস্তিক হয় তারা বেয়াদব হয়। যারা মানতে পারে না তারাই নাস্তিক। যে দেশে নাস্তিকতা চর্চা হবে সে দেশে সুখ শান্তি কিছুই আসবে না। তাদের সাথে কিভাবে বসবাস করা যায় তুমিই বল।
নাহিদা তার অতীতের সাথে শহিদের অতীত মেলাচ্ছে। ঠিক ঠিক মিলে যাচ্ছে যেন তাদের দুজনার চলা ও গতি। সে ভাবছে, চলা যায় এই মানুষটির সাথে বাকি পথ। যেমনটি কেটেছে আজ রাত।
ওদিকে শহিদ মনে মনে শুকরিয়া আদায় করছে সৃষ্টিকর্তার কাছে। এত দিনের বঞ্চনা, গঞ্জনা ও অপ্রাপ্তির সকল দুঃখ এক লহমায় যেন ঘুচে গেছে। সে তাকিয়ে আছে নাহিদার দিকে। ভারী জ্ঞান ও প্রজ্ঞার দিকে। শান্তি ও প্রশান্তির দিকে। জীবন ও ভবিষ্যতের দিকে।
নাহিদা চোখ তুলতেই লজ্জায় অড়ষ্ট হয়ে গেল। আঁচল টানতে টানতে বলল, কি হয়েছে? নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছেন যে? এত তীক্ষè দৃষ্টিতে তো আমি গলে যাবো!
শহিদ উঠে দাঁড়ালো। দৃষ্টি নাহিদার দিকে। এক হাতে হাঁচকা টান দিল নাহিদাকে। উড়ন্ত পাখি উড়ে এসে যেন ডালে বসে গেল। দু’জন এগিয়ে যাচ্ছে পায় পায়। সামনে সজ্জিত বিছানা।
শহিদ বললো, আমি আমার বন্ধু তোমার বড় ভাইয়ের কাছে শুনেছি তোমার নাম নাকি সুকন্যা। বাস্তবিকই তুমি সুকন্যা। চল আমরা আজ নাস্তিকতাকে দলিত মথিত করার জন্য একটি ভবিষ্যৎ ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে তুলি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।