Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মওদুদ আহমদ রাজনৈতিক দশ দিগন্ত

সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল | প্রকাশের সময় : ১ এপ্রিল, ২০২১, ১২:০২ এএম

এ দেশের রাজনীতির বেলা ভূমিতে এক গভীর স্পষ্ট চিহ্নের নাম মওদুদ আহমদ। বৃষ্টি ভেজা আকাশে ঝকঝকে রং ধনুর মতো বর্ণাঢ্য প্রাণোচ্ছল মওদুদ ভাই কয়েক প্রজন্মের ভাই, নেতা। জারমানের হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৭৬-১৯৮০-১৯৯৬), অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৯৩, হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয় (১৯৮১, ১৯৯৮) এর ফেলো।
জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলিয়ট স্কুলের ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন ১৯৯৭ সালে। মওদুদ আহমদ আজ ছবি হয়ে গেছেন। কিন্তু কী বর্ণাঢ্য জীবন, কী পরিপাটি, হাস্যোজ্জ্বল সদালাপী মহিরুহ ছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন অভিনেতা হতে, উচ্চতর শিক্ষাজীবনে মনে প্রাণে নিজেকে ছায়াছবির নায়ক ভাবতেন। আমার কাঁধে হাত রেখে একদিন হালকা মেজাজে বললেন, ‘চেয়েছিলাম অভিনেতা হতে বুঝলে, অথচ কী হলাম’। আমি বললাম, ‘একাংশে তো হয়েছেনই’। উৎসুক চোখে বললেন, ‘কী রকম?’ বললাম, ‘অভি বাদ গেছে’ নেতা তো হয়েছেন। সহাস্যে আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, So that I Admire you। দুঃখ-কষ্ট-আনন্দ সব পরিস্থিতিতে নিজেকে খুব পরিপাটি করে রাখতেন। চুল, পোশাক, পায়ের জুতা কিংবা চপ্পল সবকিছু। সময়ের মূল্য দেওয়াটা তাঁর চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ছিল। যে কোনো অনুষ্ঠানে অনুজদের প্রশংসা করা, উৎসাহ দেয়া তাঁর সহজাত ছিল। ব্যক্তিত্ব এবং মেকী গাম্ভীর্য্য যে এক জিনিস নয় তা তিনি জীবনের প্রতিটি আচরণে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। আমার দৃষ্টিতে একজন অসাধারণ সহজ মানুষ তিনি। অনেকেই তাঁর রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তনের জন্য কটুবাক্য বলেন। কিন্তু তাঁর লেখনী কিংবা বক্তৃতায় কখনো কি তাঁকে দলকানা মনে হয়েছে? নিজের দলের ভুল, অপারগতা, নিজের সীমাবদ্ধতা এসব জায়গায় তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন। তাঁর Constitutional quest for Autonomy Era of Sheikh Mujib. Emergency & after math ২০০৭-২০০৮ প্রভৃতি গ্রন্থ তার সাক্ষ্য দেয়।
Accommodation-compromise-give & take হলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার দীর্ঘস্থায়ীত্বের উপাদান, একথা তিনি প্রায়ই বলতেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় ও সহাস্য প্রশংসা/সমালোচনা করতেন, যা বর্তমান রাজনৈতিক ব্যাকরণে বিলুপ্ত প্রায়। কথা বলার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মওদুদ আহমদ ভাষা আন্দোলনে প্রতিবাদী কিশোর হিসেবে প্রথম গ্রেপ্তার হন।
তার পর বহুবার ২০১৫-১৬ পর্যন্ত। কারাজীবনে তাঁর লেখনি চলত নিয়মিত। দুপুরে অল্প সময়ে তন্দ্রা-বিশ্রামে খাতার ভেতরে কলম রেখে শুয়ে পড়তেন। ঐ সময় কোনো হাজতি কর্মী দেখা করতে এলে হতাশ হতেন। আবার বিকেলে সেই পরিপূর্ণ মওদুদ আহমদ। কিছু সময় সহাস্য হাঁটাহাঁটি-নামাজ আদায়, নাস্তা-বাথরুম-খাওয়া বাদে জেগে থাকা বাকিটা সময় লেখাজোকা নিয়েই থাকতেন। তাঁর মূল প্রকাশনা সংস্থা ইউপিএল শেষ দিকে প্রচন্ড সরকারি চাপের কারণে নতুন কোনো গ্রন্থ ছাপাতে অপারগতা প্রকাশ করেছিল। আমার জানা মতে, মওদুদ আহমদের রচিত কিন্তু অপ্রকাশিত কিছু গ্রন্থ রয়েছে তাঁর সংগ্রহশালায়। শেষ পৃষ্ঠাগুলোতে তাঁর জীবনগাঁথা বড় কষ্টের-বেদনার। বহু বছরের দুঃখ-সুখের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি থেকে উচ্ছেদ তাঁর হৃদপিন্ডে কষ্টের ফাটল তৈরি করেছিলো। আদরের পুত্র সন্তানের শোকাবহ মৃত্যু বোধহয় তাঁকে শেষ ঠিকানার দিকে অনেকটা এগিয়ে দিয়েছিলো। সুপ্রিমকোর্ট মসজিদ এলাকায় পুত্র আমান মওদুদের জানাজার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে শিশুর মতো দীর্ঘক্ষণ কাঁদলেন।
বাকরুদ্ধ কণ্ঠে অনেক কথা বলায় যেটুকু বুঝলাম তা হলো, ‘আমি বড় একা হয়ে গেলাম, সম্পূর্ণ চিকিৎসা বিভ্রাটে কলিজার টুকরাটা ঝরে গেল ভাই’। এক অনেক চেনা মওদুদ আহমদকে সেদিন অচেনা এক অসহায় পিতার প্রতিচ্ছবিতে দেখলাম, যা এখনো অনেকের স্মৃতি পটে জ্বলজ্বল করছে। আবার সেই তাঁকেই পুত্র আমানের দোয়া মাহফিলে এক পাহাড় কষ্ট বুকে চেপে রেখে অশ্রু সজল চোখে ছোটবড় সবার কুশলাদি জানতে দেখেছি স্বাভাবিক ভদ্রতায়। জীবনের বিবর্ণ পাতাগুলো মওদুদ আহমদের জীবনখাতার ভিন্ন মাত্রার উজ্জ্বলতাকে কখনো ম্লান করতে পারেনি। আমার কারাজীবনে যতবার তাঁর সান্নিধ্যে ছিলাম প্রতিবারই তিনি আমার আগে মুক্ত হয়েছেন। প্রতিবারই বের হয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন করে সান্তনা দিতেন। একজন দরদী অভিভাবকের অস্তিত্ব পেতেন আমার স্ত্রী। তাঁর অসুস্থতা এবং পরবর্তী মৃত্যু সংবাদ আমার পরিবারকেও দারুণভাবে ব্যথিত করেছে। মনে হচ্ছে, তিনি যেন বলছেন, Please Keep me in our prayer.
ভালো মানুষদের জন্য প্রশংসায় যাদের কৃপণতা থাকে, তারা নিজ ভুবনে সম্রাট-সম্রাজ্ঞী হতে পারেন, কিন্তু জনারণ্যে তারা আগাছা। আর আগাছা বনে কিংবা চাষের জমিতে আবর্জনা হিসাবেই বিবেচিত। মওদুদ আহমদের নিজ নির্বাচনী এলাকার পৌরমেয়র কাদের মির্জা বলেছেন, ‘অত্র এলাকার উন্নয়নের পথ রচনাকারী হচ্ছেন মওদুদ আহমদ’। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ বলেছেন, ‘রাজনীতি এখন উল্টো পথে চলছে। কিছু মানুষ রাজনীতিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন।’ ব্যক্তির চেয়ে দল, দলের চেয়ে দেশ বড়। ব্যক্তি সর্বস্বতা অকল্যাণ কর। তাই প্রশ্ন জাগে, কারা এখন পেশাদার? রাষ্ট্রপতি তো আইনী পেশার মানুষ, মওদুদ ভাইও একই পেশায় সুস্থতার শেষ দিন পর্যন্ত নিয়োজিত ছিলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ে বর্তমান মন্ত্রী বাদে কোনোদিন কি ব্যবসায়ী কেউ ছিলেন? তথ্যমতে, এরকম হলকা চটুল বাক্যধারী কেউকি আগে ছিলেন? বিএনপি নেতাকর্মীরা স্তম্ভ নাড়া-চাড়া করে রানাপ্লাজা ধ্বসিয়ে দিয়ে ১২০০ মানুষ হত্যা করেছে, এমন কথা বলা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী? দায়িত্বে থাকাকালীন সকল নিয়ম কানুন ভঙ্গ করে ব্যাংকের মালিক হয়েছেন। নিপুণ হস্তে আবার সেই ব্যাংকে লাল বাতিও জ্বালিয়েছেন। টাকা পাচার সম্পর্কে অর্থমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, ‘ব্যাংক ডাকাতদের শাস্তি বিধানে আমার নিজ দলের লোকেরাই বড় বাধা’। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো’। পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, ‘গরুতে যদি কচুরীপানা খেতে পারে মানুষ কেন পারবে না?’ নৌ মন্ত্রী বলেন, ‘গরু ছাগলের চিহ্ন বুঝলেই তাকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। মওদুদ আহমদের পরিশিলিত বক্তব্যে সারাজীবনে কোনো বে-ফাঁস কথা পাওয়া যাবে না। তাই বোধহয় বলা যায়, শ্রদ্ধেয় মওদুদ আহমদ অনুচ্চারিত শব্দে বলে গেছেন, Love me or Hate me both are in my favour. Because it keeps always me in your mind. Simplicity ছিলো তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফলবান গাছ যেমন ফলের ভারে মাথা নুইয়ে পড়ে, তিনি তেমনি সবসময় মাথা নিচু করে হাঁটতেন। সেই মাথায় বোঝা হিসেবে পড়ে রইল অনেকগুলো রাজনৈতিক মামলা। অবিশ্বাস্য হাস্যকর অভিযোগের মামলা। এর আগেও খন্দকার দেলোয়ার-ব্রি. জে. হান্নান শাহ, এম.কে. আনোয়ার, তরিকুল ইসলাম, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, তরুণ শফিউল বারী বাবু, হাসানরা চলে গেছেন অগণিত রাজনৈতিক মামলার নথি রেখে। দুঃখ করে একজন বলেছিলেন, ‘বিএনপির লোকেরা ড্রয়ার খুললে পাবেন মামলার নথি আর আওয়ামী লীগের লোকেরা খুললে দেখেন কোটিপতি।’



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মওদুদ আহমদ


আরও
আরও পড়ুন