পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পোশাক-আশাকে পরিপাটি। সদা হাস্যোজ্জ্বল। ব্যবহারে অমায়িক। বন্ধুবৎসল। জ্ঞান-গরিমায় অতুলনীয়। বক্তৃতায়-প্রতিক্রিয়ায় পরিমিতি। পরমতে সহনশীল ও সশ্রদ্ধ। দেশপ্রেম অপরিমেয়। গণতন্ত্র ও মূল্যবোধের প্রশ্নে নিরাপস। এতসব বৈশিষ্ট্য একজন মানুষের মধ্যে থাকতে পারে? হ্যাঁ পারে। তার প্রমান দিয়ে গেছেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। ক্ষমতার চৌহদ্দিতে জীবনের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েও লুট আর আখের গোছানোতে মনযোগী হননি। সরকারের চুড়ায় আরোহন করেও থেকেছেন পরিচ্ছন্ন ও নির্লোভ।
বাংলাদেশের রাজনীতির আকাশটা ক্রমেই তারকাশূন্য হয়ে যাচ্ছে। মওদুদ আহমদের ইন্তেকাল বস্তুত: আরেকটি নক্ষত্রের পতন। জাতীয় রাজনীতিতে যখন সভ্যতা-ভব্যতা, মেধা, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, রুচিবোধ, সৌজন্যতা ও পরমতসহিষ্ণুতার আকাল, তখন এসব বিরল গুণাবলীর সমন্বয়ে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। একাধারে তিনি ছিলেন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান, আইনজ্ঞ, সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও অন্ততঃ ছয় দশকের রাজনীতির উত্থান-পতনের জীবন্ত সাক্ষী। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মওদুদ আহমদ গণতান্ত্রিক সমাজ ও মানবিক মূল্যবোধের জন্য সংগ্রাম করেছেন বিরামহীন।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও উপপ্রধানমন্ত্রী কিংবা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন মন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। এসব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি টানা কয়েক যুগের আলোচিত রাজনীতিক ও সত্যনিষ্ঠ লেখক হিসেবে সুখ্যাত। বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের অবৈতনিক একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে শেখ মুজিবসহ অন্যদের মুক্ত করতে অগ্রণী ভূমিকা, একাত্তরে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গোলটেবিল আলোচনায় উপস্থিতি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও মুজিবনগর সরকারের পোস্টমাস্টার জেনারেল মওদুদ আহমদের রয়েছে দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। মওদুদ আহমদ নামটি বাদ দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস রচনা সম্ভব হবে না।
একটি মানুষের অনেকগুলো সত্তা থাকতে পারে। আবার সব সত্তা সমানভাবে আলো ছড়ায় না। কিন্তু মওদুদ আহমদ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। বহুমাত্রিক প্রতিভা এবং অসাধারণ মেধাবী মওদুদ আহমদের প্রতিটি পরিচয়ই তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। একজন রাজনীতিক যে কমল হাতে দ্যুতি ছড়াতে পারেন তার উদাহরণ হয়ে থাকবেন সত্যনিষ্ঠ ও সাহসী লেখক মওদুদ আহমদ। একটি রাজনৈতিক আদর্শের ধারক হয়েও বিপরীত আদর্শের নেতাকেও যে শ্রদ্ধা জানানো যায়, নিজের রাজনৈতিক পরিমন্ডলের জন্য অপ্রিয় সত্যও সাদাকালোতে তুলে আনা যায় তা দেখিয়ে গেছেন তিনি।
মওদুদ আহমদ ছিলেন গণমাধ্যমের বন্ধু। বিভিন্ন সরকারের সময়ে বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলো যখনই বিপদে পড়েছে তখনই আইনজীবী হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আলোচিত কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। একটি প্যারোডিকে কেন্দ্র করে দৈনিক ইনকিলাব, আমার দেশ, মানবজমিন পত্রিকা বিভিন্ন সময়ে সরকারের রোষানলে পড়লে পত্রিকাগুলোর সম্পাদকের পক্ষে আইনী লড়াইয়ে স্বত:প্রণোদিত হয়ে অক্লান্ত শ্রম দিতে দেখা গেছে তাঁকে। এছাড়াও সংবাদপত্র ও সাংবাদিক দলন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিটি সংগ্রামে তাঁর সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
ব্যারিস্টার মওদুদের সমালোচকরা তাঁর বিরুদ্ধে বড়দাগে যে অভিযোগ করেন তা হলো, ‘তিনি দেশের বড় সব দলই করেছেন, বার বার দল বদল করেছেন । এর সঙ্গে অনেকে তাঁকে নীতিহীন রাজনীতিকের তকমা দেন। কিন্তু প্রতিটি দল পরিবর্তন বা সরকারের যোগ দেওয়ার পেছনে তাঁর রয়েছে অকাট্য যুক্তি ও ব্যাখ্যা। এ প্রসঙ্গে একটি অভিজ্ঞতার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলো ১০ অক্টোবর। তিনি শপথ নিলেন মন্ত্রী হিসেবে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর সম্ভবত ১২ অক্টোবর সচিবালয়ে অফিসে আসেন। আমি তখন ইনকিলাবের সিনিয়র রিপোর্টার। দুপরের পরে তাঁর সামনে হাজির হলাম। ছোটখাটো একটি সাক্ষাতকার নিয়ে নিলাম। যে প্রশ্নটি তাঁকে সবচেয়ে বিব্রত করার মত সেটি করলাম সব শেষে। জানতে চাইলাম, আপনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আর এখন দায়িত্ব নিলেন একটি মন্ত্রণালয়ের। এটা আপনার জন্য কতটা শোভন হলো? প্রমোশন না ডিমোশন?
নিশ্চিত ছিলাম তিনি চটে যাবেন না। কারণ সহনশীল মানসিকতা তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রশ্ন শেষ না হতেই তিনি স্বভাবসুলভ হাসিমুখে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লেন, “আচ্ছা আবদুল্লাহ, আমি মন্ত্রী না হলে তুমি কি আজ সাক্ষাতকার নিতে এখানে আসতে? বলেন, মানুষের জন্য কাজ করাই রাজনীতির মূলকথা। এ দায়িত্ব নেওয়ার সুবাদে দেশের জন্য, এলাকার জনগণের জন্য অনেক কাজ করার সুযোগ হবে। অতীত পজিশনের কথা ভেবে ঘরে বসে থাকলে মানুষের জন্য কাজ করতে পারবো?” আরও অনেক কথা বললেন। সারমর্ম হচ্ছে, অতসব ভেবে কাজ করা যায় না। যখন যেখানে সুযোগ আসে তা কাজে লাগাতে হয়। প্রসঙ্গতঃ শহীদ জিয়াউর রহমানের সরকারে যোগ দেওয়া, এরশাদের সঙ্গী হওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বললেন, দু’টি ক্ষেত্রেই আমি চেয়েছি সামরিক শাসন থেকে দেশকে গণতন্ত্রে ফেরাতে সাধ্যমত ভূমিকা রাখার।
ছাত্রজীবন থেকেই মওদুদ আহমদ ছিলেন সংগ্রামী। ভাষা আন্দোলনের সময় সেন্ট গ্রেগরী স্কুলের ছাত্র। ওই স্কুল থেকে হরতাল, ধর্মঘটসহ কোন আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু তাঁর সংগ্রামী চরিত্র সেই নিষেধাজ্ঞা মানেনি। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা স্কুলের পাশ দিয়ে মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বেরিয়ে আসো, বেরিয়ে আসো’ বলে ¯েøাগান দিলে ব্রাদার লিগুরীর ক্লাস থেকে জানালা টপকিয়ে মিছিলে অংশগ্রহণ করেন কিশোর মওদুদ। এ কারণে মেধাবী ছাত্র হওয়া সত্বেও শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে বছর শেষে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেওয়া এবং ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রæয়ারির শহীদ দিবসে কালোপতাকা উত্তোলনের অপরাধে প্রথম বারের মত জেলে যেতে হয়েছিল তাঁকে।
১৯৫৬ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে অনার্সে ভর্তি হয়ে ১৯৬০ সালে একই বিষয়ে এম এ সম্পন্ন করেন মওদুদ। তার পর ব্যারিস্টারী পড়ার জন্য ১৯৬১ সালে চলে যান বিলেতে। ওই সময়ে মেধাবী ও ভালো ফলাফলকারিরা সিএসপি হওয়ার জন্য মরিয়া প্রচেষ্টায় মত্ত হলেও মওদুদ আহমকে সেটি টানেনি। মেধার জোরে লন্ডনের লোচিনভার স্কুলে একটি চাকরি জুটে যায়। তাঁকে চাকরি দেওয়ার আগে স্কুলের গার্ডিয়ানদের কাছে মতামত জানতে চাওয়া হয়েছিল ‘একজন এশিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ ভদ্রলোককে’ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলে তাদের কোন আপত্তি আছে কিনা। কারণ লন্ডনে সেসময় পুরো পাবলিক স্কুল সেক্টরে মওদুদই প্রথম অশেতাঙ্গ হিসেবে চাকরি পান। ওই স্কুলে ৫ বছর পড়িয়ে পাশাপাশি তিনি ব্যারিস্টারী পাস করেন।
বিলেতের প্রবাস জীবনে তিনি স্বাধীন পূর্বপাকিস্তান আন্দোলন সংগঠিত করেন। অনেকেই জানেন লন্ডনেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনের গোড়াপত্তন হয়। পাকিস্তানে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার কথা প্রথম বলা হয় লন্ডনের কিংসক্রসে সেন্ট প্যাঙ্কারস হলের প্রথম সভায়। তার পরে সেখানে একটি বাড়ি কিনে অফিস চালু করে নাম দেন ‘ইস্ট পাকিস্তান হাউস’ এবং দু’টি পত্রিকা বের করে ক্রমাগতভাবে পূর্বপাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিলেত থেকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অন্যতম সংগঠকের ভূমিকায় ছিলেন মওদুদ। ‘এশিয়ান টাইড’ আর ‘পূর্ব বাংলা’ নামে পত্রিকা দুটি বের করতেন। ইস্ট পাকিস্তান হাউসের সেক্রেটারি এবং পত্রিকা দুটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ওই সময়ে দোর্দন্ড প্রতাপশালী আইয়ুব খান লন্ডনে বাকিংহাম প্রাসাদের কাছে মারলবারা হাউসে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের নৈশভোজে গেলে ফেরার সময় তার গাড়ি লক্ষ্য করে ডিম ও টমেটো ছুঁড়ে মেরে আলোচিত হন মওদুদ আহমদরা। পড়াশোনা শেষ করেও মূলত এই দায়িত্ব পালনের জন্য অতিরিক্ত দেড় বছর বিলেতে থাকতে হয় তাঁকে। ১৯৬৭ সালের অক্টোবরে দেশে ফিরে আসেন ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। শুরু করেন আইনী লড়াই ও মুক্তি সংগ্রামে সহায়তা। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যে চার তরুন আইনজীবী শেখ মুজিবের পক্ষে লড়াইয়ে নামেন তার অন্যতম মুওদুদ আহমদ। এরা কেউই আওয়ামী লীগের সদস্য বা নেতা ছিলেন না। মওদুদসহ চার আইনজীবী বেগম মুজিবের সঙ্গে ৩২ নম্বরে দেখা করে এবং ইত্তেফাকের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সহায়তায় ওকালতনামায় সই নিয়ে বিলেত থেকে আইনজীবী টম উইলিয়ামসকে নিয়ে এসে মামলায় লড়েন। হাইকোর্ট থেকে ঐতিহাসিক রুলের পর গোলটেবিল আলোচনায় যাবেন এ শর্তে শেখ মুজিব ও অন্যান্যদের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি মেলে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, যে বঙ্গবন্ধুকে আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত করার জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁর শাসনামলেই মওদুদ আহমদকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়।
মওদুদ আহমদের একটি মানবিক গুণ ছিল অধস্তনদের সঙ্গে কখনও খারাপ ব্যবহার করতেন না। এ শিক্ষাটা তিনি শৈশবে তাঁর আলেম বাবার কাছ থেকে পেয়েছেন বলে আত্মজীবনীতে জানান। বাবা মাওলানা মমতাজ উদ্দিন আহমদ ছিলেন উর্দু, আরবী, ফারসী ভাষায় পন্ডিত ও প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ। কোলকাতা আলীয়া মাদ্রাসার হেড মাওলানা ছিলেন। নিবাস ছিল নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার মানিকপুর গ্রামে। মওদুদ আহমদ জানান- বাড়ির চাকরকে একবার তিনি মেরেছিলেন। বাবা বাড়ি ফিরে এটা জানতে পেরে তাকে বেদম প্রহার করে শাস্তি দিয়েছিলেন। এটি তাঁর জীবনে বাবার হাতে একমাত্র শাস্তি। এতে তাঁর মনে দাগ কেটেছিল। এ থেকে তিনি শিখেছেন- বাড়িতে, অফিসে, অধস্তনদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা, তাদেরকে সমানভাবে দেখা, মানুষের মর্যাদা দেওয়া এবং সহানুভূতিশীল থাকা।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট ও সভাপতি, বিএফইউজে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।