পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সাথে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া হচ্ছে ধূমপান। সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকগণসহ সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ নানা রোগের অন্যতম প্রধান কারণ এবং ধারক ও বাহক। ধূমপায়ী যখন জলন্ত সিগারেট বা বিড়ি বা চুরুট থেকে উদ্ভূত ধোঁয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে টেনে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করায় তাকে সক্রিয় ধূমপান বলে।
ধূমপানের সময় ধোঁয়ার অংশবিশেষ যখন চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনৈচ্ছিকভাবে অন্য মানুষের দেহে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে তখন তাকে বলা হয় নিষ্ক্রিয় ধূমপান। গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজমান। ২০১০ সালে প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়, নিজে ধূমপান না করলেও পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ছয় লক্ষ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে এক লক্ষ পয়ষট্টি হাজার-ই হলো শিশু।
শিশুরা পরোক্ষ ধূমপানের কারণে নিউমোনিয়া ও অ্যাজমায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়ে। এছাড়া পরোক্ষ ধূমপানের কারণে হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত রোগও দেখা দেয়। গবেষণায় আরও বেরিয়ে এসেছে যে, পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় একাশি হাজার নারী মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ২০০৪ সালে পরিচালিত এ জাতীয় আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো যে, পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের চল্লিশ ভাগ শিশু, তেত্রিশ ভাগ অধূমপায়ী পুরুষ এবং পয়ত্রিশ ভাগ অধূমপায়ী নারী রয়েছেন। তাতে এও ফুটে ওঠে যে, পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ।
বেশিরভাগ ধূমপায়ী কৈশোর বা প্রাথমিক বয়ঃসন্ধিকালে ধূমপান শুরু করে। ধূমপানে ঝুঁকি গ্রহণ এবং বিদ্রোহের উপাদান আছে, যা প্রায়ই তরুণদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। উচ্চ মর্যাদার মডেল এবং সমবয়সীদের উপস্থিতি ধূমপানকে উৎসাহিত করে। যেহেতু কিশোর-কিশোরীরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় তাদের সমবয়সীদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়, তাই মানুষকে ধূমপানের চেষ্টা থেকে বিরত রাখার জন্য পিতামাতা, স্কুল এবং স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের প্রচেষ্টা সবসময় সফল হয় না। ধূমপায়ীরা প্রায়ই বলে সিগারেট মানসিক চাপ দূর করতে সাহায্য করে। প্রাপ্তবয়স্ক ধূমপায়ীদের মানসিক চাপের মাত্রা অধূমপায়ীদের তুলনায় সামান্য বেশি।
মেজাজ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হিসেবে কাজ করার বদলে, এর ফলে যে নিকোটিন নির্ভরতার সৃষ্টি হয় তা মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়। ধূমপায়ীদের বর্ণনা করা দৈনন্দিন মেজাজের অবস্থা থেকে এটা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ধূমপানের সময় মেজাজ স্বাভাবিক থাকে এবং যখন ধূমপান করা হয়না তখন মেজাজ খারাপ খারাপ হয়ে যায়। এইভাবে, ধূমপানের আপাত চাপ নিরসনমূলক প্রভাব কেবলই যখন ধূমপান করা হয়না সে সময়ের বিকশিত উত্তেজনা এবং বিরক্তিরই প্রতিফলন। ধূমপানে নির্ভরশীল ব্যক্তির স্বাভাবিক বোধের জন্য নিকোটিনের প্রয়োজন হয়।
সিগারেটের ধোঁয়ায় ক্যান্সার সৃষ্টিকারী মিউটাজেন থাকে। এটি মানুষের মুখ, শ্বাসনালি, গ্রাসনালি এবং ফুসফুসে ক্যান্সার সৃষ্টি করে। ধূমপান থেকে শ্বাসনালিতে প্রদাহ এবং কাশির সৃষ্টি হয়, যাকে ব্রংকাইটিস বলে। এতে শ্বাসনালি ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে হাঁপানি ও শ্বাসকষ্ট হয়। ফুসফস অনেকাংশে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। ধূমপানের ফলে শ্বাসনালিগুলোর বায়ুপথসমূহ সরু হয় এবং ফুসফুসে অতি স্ফীতি দেখা দেয়। একে এমফাইসিমা বলে। এর ফলে ফুসফুসে জটিল পরিবর্তন লক্ষিত হয়। ধূমপানের জন্য অনেকের প্রচন্ড কাশি এবং কাশির সাথে ফুসফুস থেকে মিউকাস বেরিয়ে আসতে দেখা যায়। একে উদ্গারি কাশি বলে।
শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের শিক্ষা এবং কাউন্সেলিং তামাক ব্যবহারের ঝুঁকি কমাতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। পদ্ধতিগত পর্যালোচনায় দেখা যায় যে সামাজিক ও মনস্তাত্তি¡ক হস্তক্ষেপ মহিলাদের গর্ভাবস্থার শেষ দিকে ধূমপান বন্ধ করতে এবং নিম্নওজনের সন্তান প্রসব এবং অকাল জন্ম কমাতে সাহায্য করতে পারে। ২০১৬ সালের একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে যে ওষুধ এবং আচরণগত সমর্থনের সমন্বয় ন্যূনতম হস্তক্ষেপ বা স্বাভাবিক যত্নের চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল। আরেকটি পর্যালোচনা পরামর্শ প্রদান করে যে ধূমপান বন্ধ করা বা হঠাৎ করে ত্যাগ করার ফলে উচ্চতর ত্যাগের হার বৃদ্ধি পায় না। তাই কিভাবে ধূমপান ত্যাগ করা যেতে পারে সে ব্যাপারে জনগণকে একাধিক বিকল্প দেওয়া যেতে পারে এবং যারা বিশেষভাবে ধূমপান কমাতে চান তাদের সমর্থন প্রদান করা যেতে পারে।
যেহেতু ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলনে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করার জন্য Framework Convention on Tobacco Control (FCTC) নামীয় কনভেনশনে বাংলাদেশ ১৬ জুন, ২০০৩ তারিখে স্বাক্ষর এবং ১০ মে, ২০০৪ তারিখে অনুস্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ অনুযায়ী কোন ব্যক্তি কোন পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহণে ধূমপান করতে পারবেন না। কোন ব্যক্তি এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনধিক তিনশত টাকা অর্থদন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরণের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দন্ডের দ্বিগুণ হারে দন্ডনীয় হবেন।
কোন ব্যক্তি- (ক) প্রিন্ট বা ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায়, বাংলাদেশে প্রকাশিত কোন বই, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড বা সাইনবোর্ডে বা অন্য কোন ভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না; (খ) তামাকজাত দ্রব্য ক্রয়ে প্রলুব্ধকরণের উদ্দেশ্যে কোন নমুনা বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে জনসাধারণকে প্রদান বা প্রদানের প্রস্তাব করবেন না বা করাবেন না; (গ) তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার বা ব্যবহার উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে কোন দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান, বা কোন অনুষ্ঠানের ব্যয়ভার বহন করবেন না বা করাবেন না; (ঘ) কোন প্রেক্ষাগৃহে, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় বা ওয়েব পেইজে তামাক বা তামাকজাত দ্রব্য সম্পর্কিত কোনো বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না; (ঙ) বাংলাদেশে প্রস্তুতকৃত বা লভ্য ও প্রচারিত এবং বিদেশে প্র¯‘তকৃত কোন সিনেমা, নাটক বা প্রামাণ্য চিত্রে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের দৃশ্য টেলিভিশন, রেডিও, ইন্টারনেট, মঞ্চ অনুষ্ঠান বা অন্য কোন গণমাধ্যমে প্রচার, প্রদর্শন বা বর্ণনা করবেন না বা করাবেন না।
তবে, কোন সিনেমার কাহিনীর প্রয়োজনে অত্যাবশ্যক হলে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার দৃশ্য রয়েছে এরূপ কোন সিনেমা প্রদর্শনকালে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে লিখিত সতর্কবাণী বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পর্দায় প্রদর্শনপূর্বক প্রদর্শন করা যাবে; (চ) তামাকজাত দ্রব্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার অনুরূপ বা সাদৃশ্য অন্য কোন দ্রব্য বা পণ্যের মোড়ক, প্যাকেট বা কৌটার উৎপাদন, বিক্রয় বা বিতরণ করবেন না বা করাবেন না; (ছ) তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে যে কোন উপায়ে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করবেন না বা করাবেন না।
কোন ব্যক্তি সামাজিক দায়বদ্ধতা কর্মসূচীর অংশ হিসেবে সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করলে বা উক্ত কর্মকান্ড বাবদ ব্যয়িত অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে কোন তামাক বা তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, সাইন, ট্রেডমার্ক, প্রতীক ব্যবহার করবে না বা করাবে না অথবা ব্যবহারে অন্য কোন ব্যক্তিকে উৎসাহ প্রদান করবেন না। কোন ব্যক্তি এই ধারার বিধান লঙ্ঘন করলে তিনি অনূর্ধ্ব তিন মাস বিনাশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক এক লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডে দন্ডনীয় হবেন এবং উক্ত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার বা পুনঃ পুনঃ একই ধরনের অপরাধ সংঘটন করলে তিনি পর্যায়ক্রমিকভাবে উক্ত দন্ডের দ্বিগুণ হারে দন্ডনীয় হবেন।
ধূমপান যেহেতু আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর সেহেতু এই নেশা প্রত্যেকের ছাড়া উচিত। ধূমপান ছাড়ার সহজ ও কার্যকরী এমন কিছু উপায় হল - ১. আজ থেকেই ধূমপান ছাড়ার প্রতিজ্ঞা করুন। ২. এড়িয়ে চলুন সেই সমস্ত কাজ যেগুলো ধূমপানের কথা মনে করিয়ে দেয়। ৩. অনেকে কাজের চাপ, চিন্তা ইত্যাদি থেকে সাময়িক মুক্তি পেতে ধূমপানের আশ্রয় নেই, তারা মন হালকা রাখতে গান শুনতে পারেন, গল্পের বই পড়তে পারেন অথবা বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে পারেন। এতে মন হালকা থাকবে এবং ধূমপান কে এড়িয়ে যেতে পারবেন। ৪. আপনার আশেপাশে যারা ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে তাদের কাছে পরামর্শ নিন। ৫. ধূমপানের ক্ষতিকর দিক গুলো সম্বন্ধে অবগত থাকুন।
আপনি, আমি বা আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে ধূমপানের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ সহ প্রতিকার করতে পারি। যা শুরু হতে পারে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, পাড়া, মহল্লা, থানা, উপজেলা, জেলা, বিভাগ ক্রমান্নয়ে দেশ পর্যায়ে। যারা কর্তা ব্যক্তি প্রশাসনে আছেন সবার আগে তাদের আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ধূমপান বন্ধ করার জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। বেসরকারী এনজিও, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াকে ধূমপানের কুফল সম্পর্কে বিজ্ঞাপন, নাটক, সিনেমা, আর্টিকেল সহ এর বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে জনগণের কাছে সরাসরি প্রচার করতে হবে। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসন যদি সঠিকভাবে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারেন তাহলে ধূমপান বন্ধ করা সহজ থেকে সহজতর হবে। শুধু তাই নয়, মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা বা সকল প্রকার ধর্মীয় উপসানলয়ে দায়িত্বরত কর্তা ব্যক্তিরা ধূমপানের কুফল সম্পর্কে প্রচার করলে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
লেখক: সহকারী কর্মকর্তা, ক্যারিয়ার এন্ড প্রফেশনাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিসেস বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।