পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে চীনের বাণিজ্যিক ও সংস্কৃতিক প্রভাব চোখে পড়ার মতো। বিগত কয়েক দশক ধরে চীন যে শুধু বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ভারত, ভিয়েতনাম ও মায়ানমারের সঙ্গে অর্থনৈতিক কর্মকার্ন্ড পরিচালনা করছে তা নয়, মধ্যপ্রাচ্যেও প্রায় সকল দেশে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অত্যন্ত দৃঢ় ও দীর্ঘস্থায়ী। এখন পৃথিবীর এমন কোনো দেশ নেই, যেখানে চীনের নানাবিদ পণ্য নেই। চীন সারা দুনিয়ার সব ধরনের পণ্যের বাজারে তার দৃঢ় অবস্থান ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। চীনের বড় কৌশল হচ্ছে, সে কখনো কোনো দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নাক গলায় না। তাই যে কোনো দেশের সঙ্গে চীনের সহজে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে এবং সে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়। চীন নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থকে সবচেয়ে বড় করে বিবেচনা করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ভূূ-রাজনীতির কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে। তাই বাংলাদেশের প্রতি চীনের যেমন আগ্রহ রয়েছে তেমনি রয়েছে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্টেরও। পাকিস্তান আমল থেকে এশিয়ার অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের সঙ্গে রয়েছে চীনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক অনেক পুরাতন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের ক‚টনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ সালে তখনকার পূর্ব পাকিস্তান চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ-এন-লাই দুই দুইবার সফর করেন। ১৯৫৭ সালে আবদুল হামিদ খান ভাসানাী চীন সফর করেন। পরবর্তীতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৫৭ সালে চীন সফর করেন। ১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালে প্রেসিডেন্ট এরশাদ চীন সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকা কালীন চীনা প্রধানমন্ত্রী জিয়াবাউ বাংলাদেশ সফর করেন। ২০০৫ সালকে উভয় দেশ Bangladesh China Friendship Year ঘোষণা করেন। ২০০৭ সালে চীন প্রথমবারের মতো এক মিলিয়ন ডলার সাইক্লোনদুর্গত জনগণের জন্য দান করে।
বর্তমানে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক অতি চমৎকার। বহুমাত্রিক সহযোগিতার মাধ্যমে দুই দেশে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক ব্যবসায়িক। ১৯৯৭ সালে প্রথম Power Chine নামক কোম্পানি বাংলাদেশে বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে এগিয়ে আসে। বিগত কয়েক বছর ২০টির অধিক চীনা কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগে কাজ করেছে। Power Chine কোম্পানির বর্তমানে ১৪টির মতো প্রকল্পের কাজ চলছে। বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। এই কোম্পানি পরিকল্পনা, ডিজাইন, প্রকল্প, অপারেশন এবং মেইনটেনেন্স খাতে কাজ করে চলেছে। একটি বড় প্রতিবেশী দেশ হিসাবে চীন আমাদের উন্নয়নের বড় অংশীদার। দীর্ঘ ৪৫ বছরের কূটনৈতিক সম্পর্কের পটভূমি। বর্তমান সম্পর্ক অতি উচ্চতায় রয়েছে।
চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন নিদর্শন বঙ্গবন্ধু চীনমৈত্রী হল, যেটি শেরে-ই-বাংলা নগর এলাকায় অবস্থিত। দীর্ঘদিন ধরে হলটি থেকে আমরা উপকৃত হয়ে আসছি। বর্তমান নাম বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র। পূর্বে নাম ছিল বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স সেন্টার। ২০০১ সালে এটি তৈরি হয়। চালু হয় ২০০২ সালে। খরচ হয় ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পরবর্তী সময় চীন সরকার পুরো হলটি বাংলাদেশকে সৌজন্যে প্রদান করে। ৭ জুন ২০২০ সালে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, বাংলাদেশ সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই সকল প্রকল্পের আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ১১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার। এই ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প চীন সরকারের নিকট অনুমোদনের ও বিনিয়োগের জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রকল্প রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগে। Power grid Strengthening Project যার খরচের হিসাব ধরা হয়েছে ৯৭০ মিলিয়ন ডলার। Over loaded transformer পরিবর্তনের জন্য একটি প্রকল্পে খরচ ধরা হয়েছে ২৩০.৫৯ মিলিয়ন ডলার। আর System loss rejection project -এ খরচ ধরা হয়েছে ২০০ মিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশ রেলওয়ের রয়েছে চারটি উন্নয়ন প্রকল্প। জয়দেবপুর-ঈশ্ব্দী ডবল লাইন প্রকল্প, যার খরচ ধরা হয়েছে ১০৪৫.৫৯ মার্কিন ডলার। আখাউড়া সিলেট মিটার গেজ লাইনকে ডবল গেজ লাইনে পরিবর্তন করা হবে, যার খরচ ধরা হয়েছে ১২৭২.৯ মিলিয়ন ডলার। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ-জামালপুর ডবল গেজ লাইন নির্মাণ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ৫৮১.২৬ মিলিয়ন ডলার। Inland Container depot নির্মিাণ বাবদ খরচ ধরা হয়েছে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। সড়ক বিভাগের অধীনে দুইটি উন্নয়ন প্রকল্প রাখা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ঢাকা-আশুলিয়া Express way|। যার খরচ ধরা হয়েছে ১১৫৫.১৮ মিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সীতাকুন্ড-কক্সবাজার Urine drive Expressway| প্রকল্প। এ প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ২৮৫৬.৫৬ মিলিয়ন ডলার।
১৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে ICT মন্ত্রণালয়ের দুইটি প্রকল্প রয়েছে। প্রথম প্রকল্প হচ্ছে Digital Conductivity প্রকল্প। এই প্রকল্পের খরচ হতে পারে ৮৩৭ মিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় প্রকল্প হচ্ছে শহর গ্রামের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ICTমাধ্যমে। এই প্রকল্পের আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ৫০০ মিলিয়ন ডলার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের রয়েছে একটি প্রকল্প। উক্ত প্রকল্পের অধীনে ছয়টি পূর্ণাঙ্গ টিভি স্টেশন তৈরি করা হবে। প্রকল্পের খরচ ধরা হয়েছে ১২৫ মিলিয়ন ডলার। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের রয়েছে দু’টি প্রকল্প। প্রথমটি হচ্ছে রাজশাহী ওয়াসা পানি শোধনাগার নির্মাণ, যার আনুমানিক খরচ ধরা হয়েছে ২৭৬ মিলিয়ন ডলার। দ্বিতীয় প্রকল্প হচ্ছে Sanitation and waste man gent প্রকল্প, যা মিউনিসিপালিটি এলাকায় স্থাপন করা হবে। খরচ ধরা হয়েছে ১৫০ মিলিয়ন ডলার।
এ ছাড়া আরও দু’টি উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে। একটি হচ্ছে জুট মিল আধুনিকরণ প্রকল্প। খরচ ধরা হয়েছে ২৮০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে এই প্রকল্প। এছাড়া চীনের জন্য নির্মিত Economic zone প্রকল্প, চট্টগ্রাম। এর জন্য খরচ ধরা হয়েছে ২২১ মিলিয়ন ডলার। এই ১৭টি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নেয়া প্রকল্পে শিপিং মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প রয়েছে। তা হচ্ছে মংলা বন্দর আধুনিকরণ প্রকল্প। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৫৩.৫২ মিলিয়ন ডলার। প্রকল্পসমূহ চীন সরকারের নিকট বিগত জুন ২০২০ প্রেরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকার ও চীন উভয়ে প্রকল্পসমূহের কাজ দ্রুত এগিয়ে নেয়ার জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। বাংলাদেশে চীনের চলমান প্রকল্পসমূহ ও আগামীতে সম্ভাব্য প্রকল্পসমূহ দৃশ্যমান হলে, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক অনন্য উচ্চতায় গিয়ে পৌঁছাবে।
চীন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে তার বাণিজ্যিক কর্মকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ভারত, ভিয়েতনাম ও মায়ানমারের সঙ্গে সমানতালে চীন ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ বিনিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। চীন বহুদিন ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের সঙ্গে একটি নীতি অনুসরণ করে আসছে, যা আধিপত্য বিস্তারের নীতিকে বিরোধিতা করে এবং বহুমুখী বিশ্বনীতিকে সমর্থন করে। চীন তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ক্ষমতা, আঞ্চলিক শক্তি ও বৈশ্বিক প্রভাব নিয়ে এবং এশিয়ার অন্য দেশসমূহের সহযোগিতায় বিশ্বে শান্তি ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে আসছে। এশিয়ার স্বার্থ সংরক্ষণে চীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও নানাবিধ সহযোগিতা এই দেশের মানুষের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক আরও বেশি গভীর ও নিবিড় করবে। আমাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব রাখবে। বিশেষ করে চীনের বিশেষ শিল্প অঞ্চলে শিল্প স্থাপিত হলে, উৎপাদন শুরু হলে বাংলাদেশে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কর্মচারী ও কর্মকর্তার চাকরির সংস্থানসহ প্রচুর বিদেশি মুদ্রা অর্জনের নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হবে। উল্লেখিত ১৭টি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের অর্থনীতির গতিময়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদান যোগ করবে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান
ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।