পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের আসাম প্রদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করা হয়েছে। এই প্রদেশটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং বিজেপির সাবেক সভাপতি, বর্তমানে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ শাসিত। আসাম রাজ্য বিধান সভায় শাসকদল হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের সংখ্যাগরিষ্ঠার জোরে সমস্ত মাদ্রাসা বন্ধ করে দেওয়া তথা মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা বিলোপ করে দেওয়ার এই বিল গত ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পাস হয়। আগামী এপ্রিল মাস থেকে এটি কার্যকর হবে। এই বিল পাস করার সপক্ষে বলা হয়েছে যে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নাকি সাব স্ট্যান্ডার্ড বা নিম্ন মানের। রাজ্য বিধানসভার সমস্ত বিরোধীদলীয় সদস্য এই সরকারি বিলের তীব্র বিরোধিতা করেন। তাঁরা বলেন যে, হিন্দু প্রধান রাজ্য বা দেশে মাদ্রাসা শিক্ষা বিলোপ করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপির তীব্র মুসলিম বিরোধী মনোভাবের প্রতিফলন ঘটেছে। আসাম প্রদেশের শিক্ষামন্ত্রী হেমন্ত বিশ্বাস শর্মা প্রাদেশিক পরিষদে বলেন যে, এই বিল পাশ হওয়ার ফলে আগামী এপ্রিল মাস থেকে প্রদেশটির ৭০০ মাদ্রাসা বন্ধ হবে। বন্ধ হওয়ার পর এসব মাদ্রাসা নিয়মিত স্কুলে রূপান্তরিত হবে। হেমন্ত শর্মা আরো বলেন, এসব মাদ্রাসা মানুষের জাগতিক চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম নয়।
আমি আজ মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেই লিখবো। আধুনিক শিক্ষিত একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের ইতিবাচক মন্তব্য সহ বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে দেখাতে চেষ্টা করবো যে, মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা মোটেই বিজেপির ভাষায় সাব স্ট্যান্ডার্ড নয়। একজন সুপন্ডিত আলেম আধুনিক শিক্ষিত একজন স্কলারের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
এখানে বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে বিজেপি, বিশেষকরে এই দলটির নেতা নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, উমা ভারতী এবং রাজনাথ সিং চক্র ক্ষমতায় আসার পর থেকে সুপরিকল্পিতভাবে, পর্যায়ক্রমে, ধাপে ধাপে শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা নয়, তারা ভারতের ২০ কোটি মুসলিম জনগোষ্ঠিকেই নির্মূল করার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কাশ্মীরের সমগ্র জনগোষ্ঠির ৯০ শতাংশ মানুষ, অর্থাৎ মুসলমানদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সেনাবাহিনীর বুলেটের তলায় দাবিয়ে রেখেছে। নাগরিকপঞ্জী করে এবং নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে কোটি কোটি মুসলমানদের বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে বিতাড়ণের ব্যবস্থা করেছে। আবার ঐসব দেশের হিন্দুকে ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার টোপ দিয়ে ভারতে আনার চেষ্টা করেছে। যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি আরএসএসের কোর কমিটির সদস্য। সেই উত্তর প্রদেশ রাজ্য বিধানসভায় ‘লাভ জিহাদ’ নামক আইন পাশ করে পবিত্র কোরআনের সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে সরাসরি আঘাত করা হয়েছে। গরু জবাই এবং গোমাংস ভক্ষণ এবং সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে একাধিক মুসলমানকে হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া, সেখানে রাম মন্দির নির্মাণ করা, অসংখ্যবার মুসলিম বিরোধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নারকীয় তান্ডব তো রয়েছেই। এসব কিছু অপকর্ম করে বার বার হিন্দুত্বাবাদীরাই প্রমাণ করেছে যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্তি ভুল তো ছিলই না, বরং এখনও ভারতে শুধুমাত্র দ্বিজাতিতত্ত্ব নয়, বরং বহুজাতিত্ত্ব দারুনভাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে। এই সব বিষয় নিয়েই আমি একটা একটা করে এই কলামে আলোচনা করবো। আজ শুরু করছি মাদ্রাসা শিক্ষা দিয়ে।
দুই
অধ্যাপক সলিমুল্লাহ্ খান ইউ ল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। গত ২১ ডিসেম্বর একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালে তার এক সুদীর্ঘ বক্তব্য ছাপা হয়। এ সম্পর্কিত তার বক্তব্যের শিরোনাম, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করবো, আমাদের চেয়ে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত ও ভাল।’ ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, ‘দীপ্ত টিভির’ টক শোয়ে উপস্থিত হয়ে তিনি বলেন, ‘মাদ্রাসা শিক্ষার লোকজন পড়া লেখা জানে না, এমন প্রচারণা ঠিক নয়। বরং আমি চ্যালেঞ্জ করবো, আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫ জন অধ্যাপকও পাবেন না, যারা মাদ্রাসা শিক্ষকদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে পারবেন। আমাদের দেশে এবং এই উপমহাদেশে অনেক ব্যক্তি রয়েছেন যারা মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণ করে বরেণ্য ব্যক্তি হয়েছেন। তাদের জ্ঞানের ভান্ডার ব্যাপক।’
প্রিয় পাঠক, যারা বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের খবর রাখেন, তাঁরা জানেন যে, অধ্যাপক সলিমুল্লাহ্ খান ডান ঘরানার কোনো বুদ্ধিজীবি তো ননই, বরং তিনি সেক্যুলার শিবির এবং বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবি হিসেবেই পরিচিত। বক্ষমান কলামের লেখক আমি, অর্থাৎ মোবায়েদুর রহমান, স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছি। আমাদের পরিবার এবং বংশেরও সকলেই তাই। কেউই মাদ্রাসায় পড়েনি। সেই আমি বলছি, ইংরেজী সিলেবাস যেমন আন্তর্জাতিক, তেমনি মাদ্রাসা সিলেবাসও আন্তর্জাতিক। এটি পড়ানো হয় ভারতে, সউদী আরবে। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়েও সেই সিলেবাস অনুসরণ করা হয়। প্রগতিবাদী বন্ধুরা একমূখী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবীতে সোচ্চার। একমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা বলতে তাঁরা বোঝান স্কুল কলেজের শিক্ষা। আর মাদ্রাসা শিক্ষা থাকলেই নাকি দ্বিমূখী শিক্ষা ব্যবস্থা হয়ে যায়। এদের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, ইংলিশ মিডিয়াম বলে যে শিক্ষা রয়েছে, সেগুলি তাহলে কি? এই যে কিন্ডার গার্টেন, নার্সারী, প্লে গ্রুপ, ও লেভেল, এ লেভেল - এগুলো আসলে কি? এগুলো কি একমূখী শিক্ষা ব্যবস্থার আওতায় হচ্ছে? ও লেভেল, এ লেভেলের যে পরীক্ষা সেগুলোও তো আমাদের শিক্ষা বোর্ডের অধীনে নয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় বৃটেন থেকে। এদের পরীক্ষার ফলাফলও বের করে সেই তারাই। কেজি ওয়ান, কেজি টু- ইত্যাদি সিলেবাস কি আমাদের কাঙ্খিত একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার সিলেবাস? ছেলে মেয়েরা ফুটুর ফাটুর করে ইংরেজী বলুক, সেই আশায় একমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবক্তাদের অনেকের সন্তানকে কি ‘জাতে ওঠানোর’ জন্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়ানো হচ্ছে না?
তিন
আমি এখানে একটি কথা খুব স্পষ্ট করে বলতে চাই। আমি ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধী নই। তেমনি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থারও বিরোধী নই। অনুরূপভাবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার নামে যা বহাল আছে তারও বিরোধী নই। ইংলিশ মিডিয়ামে নার্সারী এবং কেজিসহ প্রথম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত যেসব বিষয় পড়ানো হয় তার সাথে আমাদের স্কুলগুলির পাঠ্যক্রমের কোনো মিল নাই। ওখানে রয়েছে প্রাচীন সভ্যতা, ব্যাবিলনীয় সভ্যতা, মিশরীয় সভ্যতা ইত্যাদি। ওদের অষ্টম শ্রেণীতে সরকার শুধু একটি বিষয় বাধ্যতামূলক করে দিয়েছে। সেটি হলো, ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’। কিন্তু নবম ও দশম শ্রেণীতে বাংলাদেশ স্টাডিজও অপশনাল। ওদের ভূগোল, মেথডলজি সব কিছু আলাদা। ওদের ‘ও’ লেভেলের পরীক্ষা পদ্ধতি কেমব্রিজ এবং এডেকশন। পক্ষান্তরে আসামের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ নির্ভর। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড তাদের নিয়ন্ত্রক। ভারতেও ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা ব্যবস্থা রয়েছে। এবং বেশ দাপটের সাথেই রয়েছে।
কথা হলো, শিক্ষা ব্যবস্থার যদি সংস্কার করতে হয় আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা উভয় ক্ষেত্রেই সংস্কার করতে হবে। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থায় অধিক পরিমাণে ধর্মীয় শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আবার মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় অধিক পরিমাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ধর্ম বা ধর্মীয় শিক্ষার কথা শুনলেই যারা ভ্রু কুঞ্চন করেন তাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই সহস্রাব্দের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সেই কালজয়ী উক্তি, Science without religion is lame, religion without science is blind. অর্থাৎ ধর্মছাড়া বিজ্ঞান খোঁড়া, বিজ্ঞান ছাড়া ধর্ম অন্ধ। আল কোরআন যে কতখানি বিজ্ঞানময় সেটি জানার জন্য প্রগতিবাদী বন্ধুদের একটি পুস্তক পড়ার জন্য অনুরোধ করছি। বইটির নাম, Scientific Indications in the Holy Quran. এই অমূল্য গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদও বেরিয়েছে। নাম, ‘আল-কুরআনে বিজ্ঞান’। প্রকাশ করেছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ। প্রকাশকাল, ইংলিশ তৃতীয় সংস্করণ, ২০০৪। বাংলায় তৃতীয় সংস্করণের প্রকাশকাল ২০১২।
চার
বাংলাদেশের আগে ভারতে দরসে নিজামিয়া শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লক্ষ্মৌতে। ১৮৬৭ সালে উত্তর প্রদেশের দেওবন্দ শহরে কতিপয় মুসলিম স্কলারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় দেওবন্দ মাদ্রাসা। মোটামুটি তারই ধারাবাহিকতায় চলছে বাংলাদেশে কওমী মাদ্রাসা। ১৯২০ সালে মওলানা আবুল কালাম আজাদের উদ্যোগে কোনরূপ সরকারি অর্থ সাহায্য ছাড়াই আলিগড়ে জামিয়া মিল্লিয়া ইসলামীয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ভারত বিভক্তি সম্পর্কে মওলানা আজাদের অবস্থান আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু শিক্ষা, বিশেষ করে ইসলামী শিক্ষা বিস্তারে তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৯৩৪ সালে জামিয়া মিল্লিয়া দিল্লীতে স্থানান্তরিত হয়।
২০২০ সালে ভারতের সমস্ত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জামিয়া মিল্লিয়াকে ভারত সরকার ১নং বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়েছে। অথচ মওলানা আজাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। তাঁর জন্মই তো এদেশে হয়নি। মওলানা আজাদের জন্ম হয়েছিল পবিত্র নগরী মক্কায়। তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। অথচ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের মত বিশাল সংগঠনের তিনি সভাপতি ছিলেন এবং তাও টানা ৭ বছর, ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৬ পর্যন্ত। ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনি ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। তিনি যদি মুসলমান না হতেন তাহলে নেহুরুর বদলে তিনিই হয়তো ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতেন। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা সত্ত্বেও India Wins Freedom এর মত একটি অবিস্মরণীয় গ্রন্থ তিনি লিখে গেছেন।
যারা মনিষী হন তাদের জন্য একাডেমিক শিক্ষাটা বড় হয় না। রবীন্দ্রনাথের কোনো ডিগ্রী ছিল না। তাঁর বয়স যখন ১৭ তখন তাঁর পিতা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তাঁকে ইংল্যান্ড পাঠান। কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি লন্ডনের স্কুল ছেড়ে দেন। নিজস্ব উদ্যোগে লেখাপড়া করে তিনি বিশ্বকবি হয়েছেন। বিদ্রোহী কবি নজরুলও তাই। পেটের দায়ে তিনি রুটির দোকানে চাকরি করেছেন। মসজিদের মুয়াজ্জিনও হয়েছেন।
আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে মনিষী হওয়া যায়, মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও মনিষী হওয়া যায়। বড় হওয়ার জন্য যেটি প্রয়োজন সেটি হলো সাধনা ও একাগ্রতা।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।