Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কোভিড মোকাবেলায় ব্লুমবার্গ স্বীকৃতি

মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান | প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০২১, ১২:১০ এএম

এই মুহূর্তে বিশ্বে করোনায় মোট মৃত্যু ১৭ লাখ ৮১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আক্রান্ত ৮ কোটি ১৬ লাখের বেশি। কোভিড মোকাবেলায় ব্যর্থতার জেরেই আমেরিকায় এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরে গেছেন বলেই অনেকের ধারণা। ইউরোপের অনেক দেশেই দ্বিতীয় বারের মতো লকডাউন চলছে। দিন যতই যাচ্ছে, আমেরিকা-ইউরোপসহ বিশ্বে অনেক শক্তিধর দেশের অর্থনীতির করুণ চিত্র ততই ফুটে উঠছে। পার্শ্ববর্তী দেশ পাকিস্তান, ভারতের অবস্থাও খারাপ। এই কোভিডে ভারতে মোট মৃত্যু ১ লাখ ৪৮ হাজার, আক্রান্ত ১ কোটি ২ লাখ ২৪ হাজারেরও বেশি। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশে মোট মৃত্যু ৭ হাজার ৪’শ জন, আক্রান্ত ৫ লাখ ১০ হাজারের মতো।

সম্প্রতি আমেরিকার ডাটাভিত্তিক জনপ্রিয় মিডিয়া ব্লুমবার্গ কর্তৃক করোনা মোকাবেলায় সক্ষমতার ভিত্তিতে বিশ্বের দেশগুলির উপর একটি জরিপ চালিয়েছে। জরিপে পাকিস্তান ২৯তম, যুক্তরাজ্য ৩০তম এবং খোদ আমেরিকার অবস্থান ৩৭তম। ভারতের অবস্থান ৩৯তম। এছাড়াও বাংলাদেশের নিচে রয়েছে জার্মানি, মালয়েশিয়া, রাশিয়া, সুইজারল্যান্ড, মিশর, সুইডেন, ইরান, ইরাক, ইন্দোনেশিয়া থেকে অন্তত প্রায় ১৮৫টির মতো দেশ। আর বাংলাদেশ ভালো অবস্থানে থাকা দেশগুলির মধ্যে ২০তম অবস্থানে ওঠে এসেছে। এর থেকেও বড় সংবাদ হচ্ছে, এই জরিপে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের উপরে অবস্থান করছে। দেশের মানুষতো বটেই খোদ বিশ্ববাসীই অবাক হয়েছে, কোভিড মোকাবেলায় বাংলাদেশের এত বড় সাফল্য দেখে। এমন নয় যে, ব্লুমবার্গ কেবল বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উত্থান দেখেই এই র‌্যাংকিং করেছে, বরং প্রতিষ্ঠানটি জরিপ চালিয়েছে অন্তত কোভিডের ১০টি মেট্রিকসের উপর। যেখানে ছিল কোভিডে মৃত্যুহার, কোভিড পরীক্ষা সুবিধাদি, জনবল, স্বাস্থ্যসেবা দানের সক্ষমতা, চলাফেরা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি। এই সকল গুরুত্বপূর্ণ মেট্রিকস থেকে বিশ্বের সকল দেশের মধ্যে ২০তম অবস্থান ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে প্রথম হওয়াটা নিঃসন্দেহে অলৌকিক কোন ঘটনায় হয়নি।

জনসংখ্যা, আয়তন বা আর্থিক সক্ষমতা কিংবা জনবল, কারিগরি সুযোগ-সুবিধা যেদিকেই বলি না কেন, বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে উল্লিখিত ইউরোপ-আমেরিকায় দেশগুলির নিচে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫৪ লাখের মতো। সেই তুলনায় আমেরিকার ৩৩ কোটি, যা বাংলাদেশের থেকে দ্বিগুণের কিছুটা কম। অথচ কোভিড আক্রান্তে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪০ গুণ বেশি। ব্রাজিলের জনসংখ্যা ২১ কোটির মতো, যা বাংলাদেশের থেকে সামান্য বেশি। অথচ করোনায় আক্রান্ত বিবেচনায় বাংলাদেশ থেকে ১৫ গুণ বেশি। ইউরোপের প্রায় সব দেশেরই বাংলাদেশের থেকে জনসংখ্যা কম, অথচ আক্রান্তে ও মৃত্যুতে বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ বেশি তাদের। যুক্তরাজ্যে জনসংখ্যা মাত্র ৬ কোটি, অথচ কোভিডে আক্রান্ত ২৩ লাখ। জনসংখ্যায় যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের অর্ধেকেরও অনেক কম। অথচ বাংলাদেশ থেকে করোনায় মৃত্যুতে ১০ গুণেরও বেশি। ফ্রান্সে জনসংখ্যা সাড়ে ৬ কোটি। কোভিডে আক্রান্ত সাড়ে ২৫ লাখ, যা বাংলাদেশ থেকে ৫ গুণ বেশি, আর মৃত্যুতে ৯ গুণ বেশি। অথচ এই দেশগুলির সক্ষমতা বা আর্থিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশ থেকে বহুগুণ বেশি। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জনসংখ্যা ১৩৮ কোটি, যা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭ গুণ বেশি। ভারতে করোনায় মোট আক্রান্ত ১ কোটিরও বেশি, মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ মানুষের। ভারতের সাথে আমাদের আবহাওয়াগত মিল থেকে শুরু করে সব দিকেই মিল রয়েছে। অথচ ভারতে মৃত্যু বাংলাদেশের থেকে ২৯ গুণ বেশি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কোন জাদুশক্তিবলে বিশ্বের অর্থনৈতিক শক্তিধর ও পরাক্রমশালী দেশগুলিকে পেছনে ফেলে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হলো? কোভিডের এই বিপর্যয়ে বিশ্বের মেগা শক্তিধর দেশগুলি যেখানে অর্থনৈতিকভাবে জিরো থেকে মাইনাস প্রবৃদ্ধিতে চলে যাচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ বৃদ্ধি হয়েছে। বৈদেশিক রেমিটেন্সে এই কোভিড মহামারির সময়ে অতি আশ্চর্যজনকভাবে সর্বোচ্চ এসেছে।

অবশ্যই এমনি এমনি বা কোনো অদৃশ্যশক্তিবলে বাংলাদেশের এই অর্জনটি সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। এই দেশে কোভিডের মতো এত বড় বিপর্যয় সামলানো মোটেও সহজ কাজ ছিল না। অবশ্যই দেশের চিকিৎসাখাত, দেশের প্রশাসন ও দেশের সর্বোচ্চ সিদ্ধান্ত সঠিক ও সময়োপযোগী ছিল।

মার্চে দেশে করোনা ভাইরাস প্রথম সংক্রমিত হবার আগে থেকেই স্বাস্থ্যখাত কোভিড মোকাবেলায় চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন প্রস্তুত করেছিল এবং একই সাথে বহুসংখ্যক চিকিৎসক ও নার্সকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। দেশে গত ৮ মার্চ প্রথম আক্রান্ত ব্যক্তি সনাক্ত হবার আগেই অর্থাৎ ১ মার্চ মাননীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে ত্রাণ ও দুর্যোগ, বিমান, পররাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, স্বরাষ্ট মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবসহ অন্যান্য সিনিয়র সচিব, সচিব পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের রাখা হয়। এই কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অতি দ্রুত দেশের সকল বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কোভিড মোকাবেলায় অত্যন্ত কার্যকর বেশ কিছু কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিগুলি বিদেশ ফেরত ও আইসোলেশনে থাকা ব্যক্তিদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণসহ, কোভিড সচেতনতায় প্রচারণায় ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছেন।

এভাবে দেশের সবচেয়ে খ্যাতনামা ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কোভিড পরামর্শক কমিটিসহ সময়ে সময়ে যখন যে কমিটি গঠন করা প্রয়োজন তা করা হয়েছে। এগুলি কোভিড মোকাবেলায় কাজে লেগেছে। দেশের চিকিৎসকদের জীবন বাজি রেখে চিকিৎসা দেয়া থেকে শুরু করে সময় মতো হাসপাতালে শয্যা প্রস্তুত রাখা, আইসিইউ-এর শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি, দ্রুত ১২৪টির মতো সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা, হাসপাতালগুলিকে আরো সেবামুখী করেছে।

কোভিডের উৎপত্তি নিয়ে নানামনে নানা প্রশ্ন রয়ে গেছে। মূলত এর উৎপত্তি কীভাবে হয়েছে, মানুষ না অন্য কোনো প্রাণী থেকে সেটি আজও বিতর্কিত বিষয়। কোভিডের চিকিৎসা নিয়ে শুরুর দিকে কেবল বাংলাদেশই না, বিশ্বের বহু দেশই সিদ্ধান্তহীনতায় ছিল। চিকিৎসক, নার্সসহ সব মানুষই উৎকণ্ঠায় দিন কাটিয়েছে। খোদ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড ট্রিটমেন্ট নিয়ে অন্তত ৮ বার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। বাংলাদেশে সে সময় কেবল আইডিসিআর-এর একটি মাত্র কোভিড পরীক্ষা সেন্টার ছিল। বর্তমানে দেশে ১১৮টি কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র। এর সাথে পর্যাপ্ত অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নানারকম উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশ্বের বহু দেশই তাদের নিজ নিজ দেশের সাথে বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করায় কোভিড পরীক্ষা কেন্দ্র বৃদ্ধি করার কাজটি একেবারেই সহজ কাজ ছিল না। পরীক্ষার জন্য কিট সংগ্রহ করাটাও একই কারণে কঠিন ছিল। মানুষ মানুষকে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কোভিড আক্রান্ত ব্যক্তির পরিবারকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হতো সেসময়। ভয়ে মানুষজন কোভিডে আক্রান্ত হলেও গোপন করতো। তথ্য গোপন করায় দেশের শতাধিক চিকিৎসক মারা গেছেন।

এমন দুঃসময়ে দেশের স্বাস্থ্যখাতের হাল ধরেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে পাশে নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে থাকলেন তিনি। প্রায় প্রতিদিনই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে করনীয় ঠিক করে দিতেন। স্বাস্থ্যখাতের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করলেন। একদিকে করোনা মোকাবেলা করতে থাকলেন, অন্যদিকে, দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে দেশের শিল্প কলকারখানা খুলে দিলেন। অনেকেই অনেক সমালোচনা করলেন। কারো কথায় কর্ণপাত না করে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডকে সোজা করে ধরে রাখলেন তিনি। দেশেই প্রস্তুত হতে থাকলো চিকিৎসক, নার্সদের জন্য পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই)। এতই পিপিই দেশে প্রস্তুত হলো যে, সেগুলি দেশের চাহিদা পূরণ করে অধিক লাভে বিদেশেও রপ্তানি হতে থাকলো। হোটেল, মুদি দোকান, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলা রেখে দেশের কর্মজীবী মানুষদের আর্থিক অনটনে পড়তে দিলেন না। বিমান চলাচল চালু রেখে বিদেশে জনবল পাঠানো ও বৈদেশিক আয় কেবল ধরেই রাখলেন না, সর্বোচ্চ রেমিটেন্স পেলো দেশ। করোনাকালীন মহামারিতে অর্থনীতিতে যুক্ত হলো আরো ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।

অনেকেই বলে থাকেন, আবহাওয়াগত সুবিধার কারণে বাংলাদেশ কোভিড মোকাবেলায় এতটা সফল হয়েছে। কিন্তু এই একই আবহাওয়া নিয়ে ভারত বর্তমানে বিশ্বে আক্রান্ত তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে আছে। অর্থনৈতিকভাবে ভারতের করুণ অবস্থা যাচ্ছে। করুণ অবস্থায় যাচ্ছে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেরই।

ভ্যাকসিন সংগ্রহের দিক দিয়েও বাংলাদেশ অনেক দেশকেই চমকে দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ গত ৫ নভেম্বরে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করায় ধরে নেয়া হচ্ছে, জানুয়ারি-২০২১ অথবা ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বাংলাদেশে ৩ কোটি অক্সফোর্ড ভ্যাকসিন চলে আসবে। এই কাজটিই মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কার মতো দেশগুলি করতে পারেনি।

দেশের কোভিড নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা ছিল হাসপাতাল চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা, টেলিমেডিসিন সেবা, সঠিকভাবে প্রচারণা ও প্রশাসনিক দক্ষতা। আর অবশ্যই সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শিতা। অন্য দেশগুলি কোভিডকে অবহেলা করেছে। কোভিডকে ‘চায়না-ভাইরাস’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেছে। বাংলাদেশ শুরু থেকেই দায়িত্ব নিয়ে কোভিড মোকাবেলা করেছে। দেশের স্বাস্থ্যখাতকে প্রস্তুত করে রেখেছে। দেশের স্বল্প পুঁজি নিয়ে সঠিক পন্থায় করণীয় ঠিক করে যেভাবে এই পৃথিবী কাঁপিয়ে দেয়া করোনা মোকাবেলা করে যাচ্ছে, এটি কেবল বিরলই নয়; এটি সত্যিই ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট পাওয়া।
লেখক: সিনিয়র তথ্য কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: কোভিড-১৯


আরও
আরও পড়ুন