পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নদীর বুকে বাঁশ পুঁতে ঘের তৈরি করে মাছ শিকার করছে একশ্রেণির দখলদার। শীতলক্ষ্যা ও বালু নদে এরকম ঘের বা স্থানীয় ভাষায় ছোঁপ আছে প্রায় ৩০০। দখলদারের সংখ্যা প্রায় ২০০। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরের বলা হয়েছে, এই দু’নদের রূপগঞ্জ এলাকায় ছোঁপগুলো অবস্থিত এবং দখলদাররাও সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রভাবশালী বলে চিহ্নিত। প্রতি ছোঁপে বছরে দু’বার মাছ ধরা হয়, যার মূল্য অন্তত এক লাখ টাকা। এই হিসাবে সব ঘের মিলালে বছরে কমপক্ষে ৩ কোটি টাকার মাছ ধরা হয়। ছোঁপের মালিকদের দৌরাত্ম্যে জেলেরা পর্যন্ত মাছ ধরতে পারে না। তাছাড়া ছোঁপের কারণে নৌচলাচলও ব্যাহত হয়। নদী দখল করে এভাবে মাছ শিকার আইনে বারিত এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসাবে গণ্য হলেও দখলদাররা এর তোয়াক্কা করছে না। তাদের বক্তব্য, ইজারা নিয়ে তারা ছোঁপ তৈরি করেছে। কিন্তু স্থানীয় ভূমি অফিসে এরকম কোনো ইজারার তথ্য নেই। এ থেকে বুঝা যায়, প্রভাব বলেই তারা নদদ্বয়ে ছোঁপ বানিয়েছে এবং এতে ভূমি অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থন ও সহযোগিতা আছে। উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) জানিয়েছেন, ভূমি অফিসের ইজারা দেয়ার কোনো এখতিয়ার নেই। অবিলম্বে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। খবরে একটি প্রসঙ্গ বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, নদী স্থায়ীভাবে দখল করে নেয়ার এটি একটি প্রক্রিয়া। ছোঁপ ফেলতে ফেলতে একসময় ছোঁপের জায়গা ভরাট করে স্থায়ীভাবে দখল করে নেয়া হয়। নদের আর কোনো চিহ্ন থাকে না। বলা বাহুল্য, নদনদীর বুক ঘেরাও করে এভাবে দখল প্রতিষ্ঠা করা কোনো নতুন ঘটনা নয় এবং শীতলক্ষ্যা ও বালু নদেই যে এরকম ঘটনা ঘটছে, তাও নয়। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী অন্য দুই নদী তুরাগ-বুড়িগঙ্গাসহ সারাদেশের নদনদী এভাবে দখল করে নেয়া হচ্ছে। নদনদীর পানি দখল, তীর দখল, বালুমহল দখল, ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে দখল সমানেই চলছে। দখলের একটা উৎসব চলছে যেন। এইসঙ্গে দূষণেরও কোনো সীমা নেই। দখল-দূষণে নদনদীর অস্তিত্ব মারাত্মকভাবে বিপন্ন। ইতোমধ্যে শত শত নদী বা তাদের অংশবিশেষ মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে, এমন নদীর সংখ্যাও কম নয়। বলা হয়, নদী বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। নদী না থাকলে বাংলাদেশের কী হবে, বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশের নদনদীর পানির উৎস প্রধানত সীমান্তের বাইরে। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে এমন নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এই অভিন্ন নদীগুলোর ভারতীয় অংশে ভারত বাঁধ ও প্রতিবন্ধক নির্মাণ করে পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে নির্বিচারে। ফলে বাংলাদেশ শুকনো মওসুমে ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে নদীগুলো দ্রুত ভরাট হয়ে পানিধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে। অন্যদিকে বর্ষায় একযোগে ভারত পানি ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশকে অস্বাভাবিক বন্যার শিকারে পরিণত করছে। বন্যা ও ভাঙনে বাংলাদেশের সহায়-সম্পদ, জমি-জিরাত ও ফসলাদির ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। ভারতের এই অবন্ধুসূলভ নীতি ও আচরণ বাংলাদেশের নদনদীর অস্তিত্বই শুধু বিপন্ন করছে না, তার অর্থনীতি, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যেরও অপূরণীয় সর্বনাশ করছে। দুঃখজনক হলেও স্বীকার করতে হচ্ছে, নদীগুলো যখন নাব্যতা হারিয়ে ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে, তখন দেশেরই কিছু লোক, যারা বিত্তশালী, অর্থশালী, প্রভাবশালী এবং রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী, নদী দখল করে নিচ্ছে রীতিমত প্রতিযোগিতা করে। নদীগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে শিল্পবর্জ্য, মানববর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হিসাবে। নদীর প্রতি এহেন আচরণ বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না। নদী দখলমুক্ত করা, দৃষণমুক্ত করা, নাব্য ও স্রোতস্বিনী করার তাকিদ বহুদিন যাবৎ উচ্চারিত হলেও আজ অবধি এর অর্থবহ কোনো অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। কথা অনেক হয়েছে, সিদ্ধান্ত এবং উদ্যোগও কম নেয়া হয়নি। কিন্তু নদীর দখল-দূষণের যে সমস্যা, নাব্যতা হারানোর যে সমস্যা, তার কোনো সূরাহা বেরিয়ে আসেনি। দখল-দূষণ অব্যাহত আছে। নাব্য হারানোর মাধ্যমে নদীর অকাল মৃত্যুর প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। নদীদখল পরিস্থিতি কতটা ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পর্যবেক্ষণে সেটা উঠে এসেছে। নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠক হয়েছে গত রোববার। বৈঠকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের তরফে নদীদখল ও উচ্ছেদ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, ৫৭৩৯০ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নদীদখলের সঙ্গে জড়িত। তাদের দখলের শিকার ৭৭০টি নদী। নদীদখল যে যথেচ্ছ রূপ নিয়েছে, এ তথ্যে সেটাই প্রমাণিত হয়।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জানিয়েছে, গত এক বছরে বিভিন্ন জেলা প্রশাসন ১৮৫৭৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। দখলের ব্যাপকতা বিবেচনায় নিলে উচ্ছেদের এই সাফল্য খুব বড় বলে মনে হয় না। তবে দখল উচ্ছেদ হচ্ছে, তা কম সন্তুষ্টির বিষয় নয়। যেহেতু ইতোমধ্যে দখলকৃত স্থান ও দখলদারদের চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে সুতরাং উচ্ছেদের গতি বাড়ানো মোটেই কঠিন হওয়ার কথা নয়। দখল যেমন নির্বিচারে হয়েছে, উচ্ছেদও তেমনি নির্বিচারে হতে হবে। যে কোনো মূল্যে ও ব্যবস্থায় নদী দখলমুক্ত শৃংখলামুক্ত করতে হবে। দূষণসহ নদীর ওপর সমস্ত অনাচার বন্ধ করতে হবে। অতীতে আমরা বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, শীতলক্ষ্যা, বালু নদের দখল উচ্ছেদের মহড়া দেখেছি। ‘মহড়া’ বলছি একারণে যে, অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে এসব নদনদীর অংশ বিশেষ থেকে দখল উচেছদ করা হলেও কিছুদিনের ব্যবধানে আবার দখলদারদের কবলে চলে গেছে। মাঝখান থেকে উচ্ছেদ অভিযানে ব্যায়িত জনগণের ট্যাক্সের বিপুল অংকের টাকা অপচয় হচ্ছে। এ ধরনের ইদুঁর-বেড়াল খেলা বন্ধ করতে হবে। অবৈধ দখল উচ্ছেদের পর মুক্ত জায়গা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। পুনর্দখল প্রতিরোধ করতে হবে। অতীতে আমরা নদীদখল উচ্ছেদের পর রাস্তা বা ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বিনোদনস্থান হিসাবে প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি অনেক কথা শুনেছি। কিন্তু দেখিনি কিছুই। এখন এসব দেখতে চাই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নেবে, এটাই প্রত্যাশিত। দখলদারদের বিরুদ্ধে এমন দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে আর কেউ ভবিষ্যতে নদীদখলে সাহসী না হয়। দেশের সর্বত্র স্থানীয় প্রশাসনকে আরো কঠোর হতে হবে, জবাবদিহিমূলক হতে হবে। সরকার বিষয়টি শূন্য সহিষ্ণুতা নীতির আওতায় আনবে বলে আমরা আশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।