Inqilab Logo

শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নদী ও পরিবেশ রক্ষায় অমার্জনীয় ব্যর্থতা

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার অপরিহার্য পূর্বশর্ত দূষণমুক্ত পরিবেশ । এর সাথে জড়িত রয়েছে মাটি, পানি, বায়ুর প্রাণদায়ী গুণাগুণ। বায়ু, পানি ও মাটির দূষণে বিপর্যস্ত পরিবেশে আমাদের জনস্বাস্থ্য এখন চরম হুমকির সম্মুখীন। সারাদেশে প্রায় সব নদনদী ও জলাভ‚মি এখন দূষণ, দখল ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের শিকার। বছরের পর বছর ধরে চেষ্টা করেও রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদনদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ করলে দখল ও দূষণ রোধ করা অসম্ভব নয়। মূলত শরিষার ভেতরেই ভুত থাকায় পরিবেশগত দুষণ-দখলের বিপর্যয় ঠেকানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ মন্ত্রনালয়, পরিবেশ অধিদফতর, পানিসম্পদ মন্ত্রনালয় ও শিল্প মন্ত্রনালয় ও স্থানীয় সরকারের বিভাগগুলোর ব্যর্থতার দায় রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বাংলাদেশের বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আন্তর্জাতিক হুঁশিয়ারি এবং দেশীয় বাস্তবতায় পরিবেশগত বিপর্যয় ও জনস্বাস্থ্য সংকটের প্রেক্ষাপটে নদনদী ও পরিবেশগত সুরক্ষা নিশ্চিতে সরকারের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারসহ বিশেষ সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। দেশের সব নদ-নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে উচ্চ আদালত। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে না। আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে নদনদীর দূষণ রোধে পরিবেশ অধিদফতর পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।

বুড়িগঙ্গার পানি দূষণের জন্য পুরান ঢাকার হাজারিবাগ ট্যানারিশিল্প থেকে নিঃসৃত রাসায়নিককে দায়ী করে নদী রক্ষায় প্রথমেই ট্যানারিশিল্প সরিয়ে নিয়ে আধুনিক ও পরিবেশ বান্ধব চামড়াশিল্প এলাকা গড়ে তোলার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল আরো দুই দশক আগে। বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীদের দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে ২০০৩ সালে হাজারিবাগের ট্যানারিশিল্প সরিয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত ও প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পরিকল্পিত ট্যানারি শিল্প পল্লীর জন্য সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরা গ্রামে প্রায় ২০০ একর জমি অধিগ্রহণসহ প্রায় ১১০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি পরবর্তী তিন বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ক্ষমতার পালাবদলে সরকার পরিবর্তনের পর গত ১৫ বছরেও এই প্রকল্পের পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। প্রকল্পে সিইটিপি বা কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার বাস্তবায়নে নানা ধরনের টালবাহানা, সময়ক্ষেপণ ও ব্যর্থতার অজুহাতে হাজারিবাগ থেকে ট্যানারি কারখানা সরিয়ে নিতে না পারায় ট্যানারিশিল্প থেকে বুড়িগঙ্গা দূষণ গত বছর পর্যন্ত পূর্ণমাত্রায় অব্যাহত ছিল। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরুর দেড় দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরও যখন নানা অজুহাতে টেনারিশিল্প স্থানান্তরসহ নতুন টেনারিপল্লীর সিইটিপি বাস্তবায়ণের অনিশ্চয়তার মধ্যে আদালতের নির্দেশনায় হাজারিবাগ থেকে টেনারি কারখানা স্থানান্তরের প্রেক্ষাপটে সাভারের ধলেশ্বরী নদীর ভবিষ্যত নিয়ে তখন থেকেই আশঙ্কার কথা শোনা যাচ্ছিল। এখন সেই আশঙ্কার কথা সত্যে পরিনত হয়ে সাভারের টেনারি শিল্পবর্জ্যে ধলেশ্বরী নদী দূষণের ভয়াবহ দৃশ্য স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

গতকাল ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারে প্রকাশিত একটি ছবিতে সাভারের হেমায়েতপুরে স্থানান্তরিত টেনারিশিল্পের রাসায়নিক বর্জ্য পাইপলাইনে সরাসরি নদীতে ফেলে কীভাবে নদীর পানিকে বিবর্ণ ও বিষাক্ত রাসায়নিকের নহরে পরিণত করা হয়েছে তার চিত্র ফুটে উঠেছে। ইতিপূর্বে বিভিন্ন সময়ে সাভারের টেনারিশিল্প পল্লীর আশপাশের বিভিন্ন জলাধার, নিম্নাঞ্চল ও নদ-নদী দূষণের সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে দূষণ রোধে সংশ্লিষ্টদের কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় পরিস্থিতি ক্রমে জটিল ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রকল্প গ্রহণের ১৮ বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও পরিবেশগত ও অর্থনৈতিকভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প সঠিকভাবে বাস্তবায়ন না হওয়া খুবই দুঃখজনক। বর্তমান সরকারের আমলে নানা প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে পদ্মাসেতুসহ বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের বাস্তবায়ন এগিয়ে চললেও সাভারের টেনারিপল্লীর সিইটিপি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তিন বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য একটি প্রকল্প আঠার বছরেও শেষ না হওয়ায় ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর পানি ভয়াবহ রাসায়নিক দূষণের শিকার হয়ে ব্যবহারিক উপযোগিতা হারাচ্ছে। দেশ ও সমাজের জন্য এটা অনেক বড় ক্ষতি। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক মানদন্ডে এই ক্ষতির হিসাব নিরূপণ করা সম্ভব নয়। সরকারের সংশ্লিষ্টদের সঠিক তদারকি এবং দায়িত্বহীনতাই মূলত এর জন্য দায়ী। টেনারিশিল্প প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো এ প্রশ্নে জবাবদিহিতার বাইরে থাকতে পারেনা। সাভারের টেনারিশিল্প অঞ্চল গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য ছিল বুড়িগঙ্গার দূষণ রোধ করার পাশাপাশি আধুনিক পরিবেশবান্ধব ট্যানারিশিল্প কারখানা গড়ে তোলা। অসম্পুর্ণ ও যেনতেনভাবে টেনারিশিল্প স্থানান্তরের ফলে একদিকে দেশের চামড়াশিল্পের বৈদেশিক মূদ্রা আয়ে ধস নেমেছে অন্যদিকে সিইটিপি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বুড়িগঙ্গার পর এখন সাভারের ধলেশ্বরী নদীর দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ট্যানারিশিল্পসহ শিল্পকারখানার দূষণ বন্ধে দ্রুততম সময়ে কঠোর পদক্ষেপ নিতে না পারলে ধলেশ্বরীর আশপাশের বাস্তু, জনস্বাস্থ্য ও কৃষিব্যবস্থায় বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হতে পারে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নদী

২৬ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন