Inqilab Logo

সোমবার, ২০ মে ২০২৪, ০৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমুন্নত করে তুলতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখন কি অবস্থায় আছে, তা সচেতন মানুষ মাত্রই জানেন। গণতন্ত্রের মূল যে শক্তি মানুষের বাকস্বাধীনতা, সুশাসন, আইনের শাসন এবং রাজনৈতিক ও ভোটের অধিকার কতটা রয়েছে, এ প্রশ্ন করা এখন অর্থহীন। কারণ, গণতন্ত্র বলতে যা বোঝায়, তার অনেক কিছুই দেশে অনুপস্থিত। এজন্য মাঝে মাঝে গণতন্ত্রের গেøাবাল ইনডেক্সে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ‘হাইব্রিড’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। সাধারণত তৃতীয় বিশ্বের যেসব দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা বলে দেশ পরিচালনা করা হয়, সেসব দেশের শাসকরা গণতন্ত্রকে তাদের মতো করে ব্যবহার করে। তাদের যেভাবে সুবিধা হয়, সেভাবেই গণতন্ত্রের সংজ্ঞায়ন করা হয়। আমাদের দেশও এর বাইরে নয়। এখানে শাসক শ্রেণী তার ইচ্ছামতোই দেশ পরিচালনা করে। মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও, কাজে তার প্রতিফলন খুব কমই থাকে। গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিসের ‘মাইট ম্যাইকস রাইট’ এই উক্তি তারা অবলম্বন করে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়েই তারা তাদের মত প্রতিষ্ঠা করে থাকে।

বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশের উদাহরণ টেনে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বলছে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ বা শক্ত ভিতের উপর দাঁড় করানোর জন্য তারা কাজ করছে। আক্ষরিক অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় গণতান্ত্রিক দেশের ধারা অনুসরণ ছাড়া বিকল্প নেই। তবে এ ধারা বাস্তবায়ন করতে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের রাজনৈতিক পরিবেশ প্রয়োজন, তা তারা সৃষ্টি করতে কতটা আন্তরিক, এ নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গণতন্ত্রে সরকারি দলের পক্ষ থেকে বিরোধী দলকে আস্থায় নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে এ কাজটি ক্ষমতাসীন দলকে কখনো করতে দেখা যায় না। তারা বিরোধী দলকে শত্রæ মনে করে। ক্ষমতাসীনদের আচার-আচরণ এমন থাকে যে, বিরোধী দলের সাথে রাজনৈতিক সমঝোতা, সুসম্পর্ক ও মতৈক্যের প্রয়োজন নেই। তারা একাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে ফেলবে। এ ধরনের মনোভাব নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা কখনোই সম্ভব নয়। কখনো প্রতিষ্ঠিত হয়না, কোনো দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়নি, হতেও পারে না। গণতন্ত্রের রীতি-নীতিই হচ্ছে, সব দলের রাজনৈতিক অধিকার, পারস্পরিক আস্থা, বিশ্বাস এবং সমঝোতা নিশ্চিত করা। রাষ্ট্রের অভিবাক হিসেবে সরকারি দলের দায়িত্ব, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বিরোধী দলের সাথে পারস্পরিক আস্থা ও বোঝাপড়া সৃষ্টি করা। তারা কি তা করতে পেরেছে? পারেনি। বরং ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে শেষ পর্যন্ত দমন-পীড়নের মাধ্যমে বিরোধী দলকে দূরে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় ক্ষমতাসীনদের অধীনে বিরোধী দলের নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘুরিয়ে যদি বলা হয়, বিরোধী দল যদি এখন ক্ষমতায় থাকত, তারা কি নির্বাচনে যেত?

এথেন্সে যখন থার্টি টাইরেন্টস বা ৩০ জনের স্বৈরশাসন চলছিল, সক্রেটিস নির্ভয়ে তাদের ক্রমাগত সমালোচনা করেছিলেন, এমনকি মৃত্যুদÐ মাথায় নিয়েও সমালোচনা করেছিলেন। স্বৈরশাসকরা তখন তাকে কাউন্সিলের সামনে হাজির করে শাসন ব্যবস্থা পরিচালনার পরামর্শ দিতে বলে। সক্রেটিস বলেছিলেন, ‘যেখানে নিজেই বুঝতে পারছি না কিভাবে আমার জীবন পরিচালনা করব, সেখানে জনসাধারণ কিভাবে জীবনযাপন করবে, তা কী করে বলব!’ সক্রেটিসের এ কথার মর্মার্থ সাধারণ মানুষ বুঝলেও, ক্ষমতার শক্তি পরীক্ষায় মুখোমুখি আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো যে বোঝে না, তা মনে করার কারণ নেই। তারা যথেষ্টই বোঝে এবং নিজেদেরটাই বোঝে। জনগণের স্বার্থ বুঝেও না বোঝার ভান করে। তারা ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। তাদের কাছে জনগণ নয়, ক্ষমতাই মুখ্য। তাদের বোধ-বুদ্ধি চাঙ্গা করার জন্য সক্রেটিসের মতো উচিত কথা যে কিছু সচেতন রাজনৈতিক বিশ্লেষক-পর্যবেক্ষক এবং বিদ্ব্যৎ সমাজ বলছে না, তা নয়। ক্রমাগত পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও টেলিভিশন টকশোতে বলা হয়েছে। এখন তো এসব কথা বলা এক প্রকার বন্ধই হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীনদের তীব্র সমালোচনা এবং রোষাণলে পড়ার শঙ্কায় কথা বলা বন্ধ হয়ে গেছে। ক্ষমতাসীনরা মনে করছে, তাদের সমালোচনা করা মনে বিরোধী দলের পক্ষে কথা বলা। কাজেই তারা সরকারের ভাল চায় না। এ থেকে বোঝা যায়, গণতন্ত্রের প্রতি ক্ষমতাসীন দলের এক ধরনের ভীতি রয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ মনে করে, যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, জাতির বিবেক হিসেবে সচেতন মহলের কথা বলা উচিৎ।

নব্বইয়ের পর থেকে যতগুলো সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়েছে, দেখা গেছে ক্ষমতায় থাকাকালীন জনআকাক্সক্ষা পূরণে ব্যর্থতার জন্য জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। ২০০১ সাল ছাড়া তাদের বিদায় খুব সুখকর হয়নি। ক্ষমতার শেষ দিকে হরতাল-অবরোধ এবং তা প্রতিহত করতে গিয়ে দেশের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। মানুষ মরেছে, রাষ্ট্রের সম্পদ ধ্বংস হয়েছে। বলা যায়, মানুষের মৃত্যু ও সম্পদ ধ্বংসের পথ ধরে এক দল ক্ষমতা ছেড়েছে, অন্যদল ক্ষমতাসীন হয়েছে। ক্ষমতাসীন হয়েই যে মনে করে, তারা আজীবন ক্ষমতায় থাকবে, আর কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না। তারা এতটাই ক্ষমতান্ধ হয়ে যায় যে, দেশে বিরোধী দল বলে কিছু থাকুক, তা চায় না। ক্ষমতায় থাকাকালে বিরোধী দলকে সহায়ক শক্তি বা ছায়া সরকার মনে না করে পথের কাঁটা মনে করে। অথচ ব্রিটেনে বিরোধী দলের শক্তিশালী ছায়া সরকার রয়েছে, যারা সরকারকে গাইড করছে। সরকারও গুরুত্বের সাথে তাদের মতামতের মূল্যায়ণ করছে। আমাদের দেশে বিরোধী দলকে মূল্যায়ণ দূরে থাক, কিভাবে তাদের নির্মূল করা যায়, ক্ষমতাসীনরা এ মনোভাব পোষণ করে। তাদের কথা-বার্তা সবসময়ই আক্রমণাত্মক থাকে। বিরোধীদলের প্রতি ক্ষমতাসীনদের এমন প্রতিহিংসামূলক মনোভাব ও দমন-পীড়ন এখনও অব্যাহত রয়েছে। প্রতিহিংসার রাজনীতির মাধ্যমে গণতন্ত্রকে সঙ্কুচিত করে কতদিন ক্ষমতায় থাকা যায়, তাই এখন দেখার বিষয়। মানুষের কাছে জীবনের চেয়েও স্বাধীনতার মূল্য অনেক বেশি। ’৭১-এ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য এদেশের ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, তাদের জীবনের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, তা উপভোগ করার জন্য, পুনরায় জীবন দেয়ার জন্য নয়। জনগণের নামে গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক স্বার্থে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য মানুষকে জিম্মি বা জীবন দিতে হবে কেন?

গণতন্ত্রে ব্যক্তিগত, দলীয় এবং গোষ্ঠীগত আদর্শ বা দর্শন থাকা স্বাভাবিক। কারোই যেমন তার আদর্শ বা দর্শন থেকে সরে আসা উচিত নয় এবং সে অনুযায়ী চলা উচিত, তেমনি অন্যের আদর্শ ও দর্শনকে শ্রদ্ধা প্রদর্শনও তার আদর্শিক দায়িত্ব। সক্রেটিসের যখন বিচার চলছিল, তখন তিনি কোর্টে বলেছিলেন, ‘যদি কেউ তার আদর্শ থেকে সরে আসে, তবে তা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে মৃত্যু ভয়ে একজন সৈনিকের পালিয়ে আসার মতো। এটা কাপুরুষতা ছাড়া কিছুই নয়।’ অর্থাৎ আদর্শবান ব্যক্তির আদর্শের কাছে মৃত্যু তুচ্ছ। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর আদর্শ ও গণতন্ত্র তাদের গঠনতন্ত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাস্তবে তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তাদের আদর্শ, যেকোনভাবে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়া। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষককে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো যে আদর্শ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, তা থেকে তাদের বিচ্যুতি ঘটেছে। এই বিচ্যুতির কারণেই একে অপরের প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের পরিবর্তে প্রতিহিংসার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছে। দেশের মানুষ এখন অনেক বেশি সচেতন। তারা যেমন চলমান রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রতি ভীতশ্রদ্ধ, তেমনি রাজনীতিহীন দেশও চায় না। তারা চায় হিংসা-প্রতিহিংসা এবং হানাহানির পরিবর্তে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং আস্থার রাজনীতি। জনগণের দোহাই দিয়ে ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার কথা, জনগণ এখন আর বিশ্বাস করে না। তাদের কথা জনগণের কাছে পলিটিক্যাল রেটোরিক বা বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা-বার্তায় পরিণত হয়েছে। রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকে এই বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা-বার্তা থেকে বেরিয়ে জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য ও আস্থাপূর্ণ কথা বলতে হবে। শুধু বলার জন্য বলা নয়, তাদের কথা ও কাজে মিল থাকতে হবে। জনসাধারণকে আশ্বস্ত করতে হবে, তাদের রাজনীতির লক্ষ্য নিজেদের আখের গোছানো নয়, দেশ ও জনসাধারণের উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য। আদর্শকে আদর্শ দিয়ে এবং যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করা অপরিহার্য। আদর্শিক দ্বন্ধের নামে কিংবা ক্ষমতাসীন হয়ে বিরোধী দলকে দমন-পীড়নের প্রবণতা কাম্য হতে পারে না। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক পারস্পরিক সহবস্থান ও আস্থা থাকা অপরিহার্য। উইনস্টন চার্চিলের ভাষায়, ‘পলিটিক্স ইজ এন এক্সাইটিং ওয়ার। সো, ইন পলিটিক্স ইউ ক্যান বি কিল্ড ম্যানি টাইমস।’ ক্ষমতাসীন দল তো বটেই বিরোধী দলগুলোকেও এ সত্যতা মানতে হবে এবং রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ধারায় পরাজয়ের মানসিকতা ধারণ করতে হবে। তা নাহলে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে কেউ কাউকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবজ্ঞা বা দমন-পীড়ন করে উড়িয়ে দেয়ার মনোভাব পোষণ করা উচিত নয়। একজনের অস্তিত্ব আরেকজনকে স্বীকার করতে হবে। গেøাবাল ভিলেজে পরিণত হওয়া অগ্রগামী বিশ্বে সামিল হতে গোষ্ঠীগত স্বার্থে ক্ষমতাসীন হওয়ার মতো সংকীর্ণ চিন্তা-চেতনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। গণতন্ত্রকে অর্থবহ করে তুলতে হবে। ‘ক্ষুদ্র ও সাময়িক স্বার্থের কারণে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় করণীয় এবং গণতন্ত্রকে যারা বিসর্জন দেয়, তারা কখনোই স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা পাওয়ার যোগ্য নয়’, আমেরিকান রাষ্ট্রনায়ক ও বিজ্ঞানী বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিনের এই উক্তির প্রতিফলন জনসাধারণ কখনোই দেখতে চায় না।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রাজনীতি

২৩ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন