পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নারায়ণগঞ্জের কালো রাত হলো ২০০১ সালের ১৬ জুন। প্রতিহিংসার রাজনীতি কত প্রকার ও কী কী, তা ভুক্তভোগী ছাড়া অন্য কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। প্রতিহিংসাকে কার্যকর করার জন্য পূর্ব জামানার বিভিন্ন অপকৌশলের সাথে যুক্ত হয়েছে ‘আইন’ ও ‘আইন প্রয়োগকারী সংস্থা’। আইনের অপপ্রয়োগ করে বা ইচ্ছামতো আইন প্রণয়ন করে পাবলিক সার্ভেন্টদের মাধ্যমে রাষ্ট্র নিজেই নাগরিকদের নিপীড়ন করে। কর্তারা এর মাধ্যমে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ করে। ক্ষমতা অপপ্রয়োগের বিশ্বব্যাপী বহু ঘটনা রয়েছে যার কিছু অংশ প্রকাশিত, বাকি অধিকাংশই অপ্রকাশিত। কোথাও প্রভাবশালীদের চাপে, কোথাও ভিন্ন ভিন্ন কারণে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিপীড়িতদের দুর্বলতা ও মিডিয়ার পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণের কারণে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অনেক ঘটনাই হয় চাপা পড়ে থাকে, নতুবা প্রচারিত হয় ভিন্নভাবে।
ইতিহাসের কোথাও ভিলেন হয়ে পড়ে নায়ক, আর নায়ক হয়ে পড়ে ভিলেন আবার অনেক ঘটনাই আছে যার জন্য নায়ক বা ভিলেন কেউ দায়ী নয়, বরং ঘটনা সংঘটিত হয়ে থাকে তৃতীয় পক্ষের দ্বারা। প্রসঙ্গক্রমে বলতে হয় যে, ২০০১ সালে ১৬ জুন নারায়ণগঞ্জ শহরে চাষাঢ়ায় তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অফিসে পৈশাচিক বোমা হামলায় ২২ জন নিরীহ সাক্ষাৎকার প্রার্থী (পুরুষ/মহিলা) নিহত হন, যাদের মধ্যে নজরুল ইসলাম বাচ্চু নামে সম্ভাবনাময় এক কণ্ঠশিল্পীও ছিলেন, শামীম ওসমানসহ (তৎকালীন ও বর্তমান এমপি) অনেকেই আহত হন, চন্দনশীল নামে এক সম্ভাবনাময় উদীয়মান রাজনৈতিক যুবক চিরতরে একটি পা হারান এবং আরো অনেকেই পঙ্গু হন যার সংখ্যা অর্ধশত।
এমন পৈশাচিক ঘটনার নিন্দা জানানোর কোনো সুযোগ পাইনি, কারো দুঃখের সাথে নিজের অশ্রু ঝরাতে পারিনি। কারণ, সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০৫ নং কক্ষে আমার পেশাগত কিউবিক্যালে বসে যখন ঘটনা শুনে আহত নিহতদের পাশে থাকার জন্য নারায়ণগঞ্জের উদ্দেশে রওয়ানা হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই জানতে পারি আমার নেতৃত্বে পৈশাচিক বোমা হামলার অভিযোগে আমার বাড়িতে হামলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ লোকজন আমার বাংলো বাড়ির টিনের চাল গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে, বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার প্রস্তুতি নেয়ায় আমার বৃদ্ধ পিতা-মাতা এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। পরে আরো জানতে পারি, ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে ‘তৈমূর আলম খন্দকারের নেতৃত্বে এই পৈশাচিক হামলা।’ সংবাদে আরো প্রচার হয় যে, ‘ঘটনার মূল নায়ক তৈমূর আলম খন্দকার এখনো ধরা পড়েনি।’
এ সংবাদ শুনে মুড়াপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (রূপগঞ্জ) সাবেক ইউপি সদস্য মফিজ মেম্বারের পুত্র ছাত্রদল নেতা শফিক সুপ্রিমকোর্ট থেকে হোন্ডা করে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গোপন স্থানে রেখে আসে। পরে জানতে পারি, আমাকে প্রধান আসামি করে বিএনপির আরো ২৬ জনের নাম উল্লেখ করে নারায়ণগঞ্জ থানায় ৯(৬)২০০১ ধারা ৩০২ দ. বি. এবং নারায়ণগঞ্জ থানায় ১০(৬)২০০১ ধারা ৩/৪ বিস্ফোরকদ্রব্য আইনে দুটি পৃথক মামলা করা হয়েছে। মামলা হওয়ার পর নিজের ওপর ধিক্কার জন্মে এ জন্য যে, ঘটনার সাথে যাদের সম্পৃক্ততা নেই, তাদের ২২ জন লোক হত্যায় জড়িয়ে মামলা দেয়ার নামই কি রাজনীতি? মিডিয়ার সংবাদ শুনে আমার জ্যেষ্ঠ কন্যা ভিকারুননেসা স্কুলের তৎকালীন ছাত্রী (ব্যারিস্টার মার-ই-য়াম) আত্মগোপন অবস্থায় টেলিফোনে আমাকে বলেছিল যে, ‘রাজনীতির কারণে তোমরা বোমা মেরে কি মানুষ খুন করতে পারো?’ এ ধরনের অপবাদের মানসিক যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে আমাকে কাটাতে হয়েছে ১৩টি বছর। আমাদের বিরুদ্ধে ঘটনার সম্পৃক্ততা না পেয়ে উক্ত মামলাগুলোতে পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেয়। সুপ্রিমকোর্টের একজন বিচারপতি জুডিশিয়াল ইনকুয়ারী করে নির্দোষ মন্তব্য করে ঘটনাটি তৃতীয় পক্ষ দ্বারা সংঘটিত হয়েছে বলে মন্তব্য করে প্রতিবেদন দেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বর মাসে বাদিপক্ষের আবেদনে হাইকোর্টের নির্দেশে মামলাটি আবার চালু হয়। মামলাটির অমানুষিক যন্ত্রণা মাথায় নিয়ে চলাবস্থায় ২০১৩ সালের ২ মে জানতে পারি, পৈশাচিক ঘটনার সাথে আমাদের কোনো সম্পৃক্ততা না থাকায় সিআইডি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে মোকদ্দমা থেকে আমাদের অব্যাহতি দেয়ার প্রার্থনা করা হয়েছে। এ ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ বা আহত হন তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কি না জানি না, যদিও এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার মতো নয়। তবে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেয়া উচিত ছিল। কারণ যারা নিহত বা আহত হন তারা ছিলেন সম্পূর্ণ নির্দোষ। এ মামলার অন্যতম আসামি জাহাঙ্গীর কমিশনার, রফিক কমিশনার দুনিয়া থেকে চলে গেছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন গুরুতর অসুস্থ। পৃথিবী থেকে আমরা চলে যাবো, কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের রেখে যাচ্ছি কোন অবস্থায়? আমার কোনো চিরশত্রুর এমন নৃশংস হামলার মাধ্যমে মৃত্যু চাই না, একইভাবে আমার কোনো চিরশত্রুকেও যেন এভাবে আসামি করা না হয়। পৃথিবী হয়তো একদিন সম্পূর্ণভাবে করোনামুক্ত হবে, কিন্তু প্রতিহিংসা বা বর্ণ ও ধর্মীয় বৈষম্যের ভাইরাস থেকে মুক্ত হবে কি না জানি না। দৃশ্যপট বলে প্রতিহিংসার ভাইরাস করোনা ভাইরাস থেকে আরো ঘৃণ্য ও নির্মম। মানুষ হত্যা করা এবং হত্যা মামলায় জেনে শুনে নির্দোষ ব্যক্তিকে জড়িয়ে আসামি করার পৈশাচিক সংস্কৃতি থেকে পৃথিবী মুক্তি পাক এটা দৃঢ়ভাবে কামনা করি।
হাইকোর্ট আমাকে জামিন দেয়ার প্রতিবাদে অর্ধবেলা নারায়ণগঞ্জে হরতাল হয়েছিল। ১৯৯৭ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর প্রতিহিংসার কারণে রাজপথে বিএনপির মিছিলে যে গুলি খেয়েছি, তা শরীরে এখনো বহন করছি। একই ঘটনায় নিহত হয়েছিলেন সহকর্মী ইব্রাহিম। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে আমাকে, আমার পরিবার ও সহকর্মীদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসন অকারণে মিথ্যা মামলায় জর্জরিত করেছে, বাড়িঘরে হামলা করেছে, নারায়ণগঞ্জের আমার চেম্বার পুড়িয়ে দিয়েছে, পুলিশ দ্বারা রাজপথে বারবার শারীরিকভাবে নির্যাতিত ও নিগৃহীত হয়েছি। যারা আমাদের বিরুদ্ধে গায়েবি মামলা দিয়েছে, বৈষম্যমূলক আচরণ করেছে, মিথ্যা মামলায় জেল খাটিয়েছে তাদের সবাইকে আল্লাহ মাফ করে দিন, আমি যদি কারো প্রতি প্রতিহিংসামূলক আচরণ করে থাকি, তার কাছে আমিও জোড় হাতে মাফ চাই।
নারায়ণগঞ্জ সেশন কোর্টে এই মামলায় সাক্ষী দিতে এসে ঘটনার অন্যতম জখমি শামীম ওসমান এমপি বলেন, ‘এই বোমা হামলায় তৈমূর বা তার সহযোগীরা জড়িত নয়।’ এ সরল স্বীকারোক্তি যদিও আমার ১৩ বছরের মানসিক যন্ত্রণা ও মিথ্যা অপবাদের ক্লান্তি থেকে আমাকে স্বস্তি দিয়েছে, তথাপি বলতে চাই যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষতার কারণে কারো ওপর যেন এ ধরনের অপবাদ বা অভিযোগ চাপিয়ে দেয়া না হয়।
আরো একটা কথা বলতে চাই যে, ঘটনা ঘটায় একজন বা একদল অথচ প্রতিহিংসার কারণে মামলায় জড়ানো হয় অন্যজনকে বা কোনো দল কিংবা গোষ্ঠীকে, এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের সমাজ কি সরে আসবে না? মিথ্যা আসামি দেয়ার কারণে মূল আসামি রক্ষা পেয়ে যায়? দিল্লির রেলস্টেশন বোমা মেরে উড়িয়ে দেয়ার সময় আনিসুল মোরসালিন ও মহিবুল মুত্তাকিন যদি নারায়ণগঞ্জে ১৬ জুনের (২০০১ ইং) বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার কথা স্বীকার না করত তবে হয়তো এতদিনে দেশের আইন ও আদালত আমাদের গলায় দড়ি লাগিয়ে দিত। পরম করুণাময় আল্লাহ বলেছেন যে, ‘তোমাদের ইচ্ছা কোনো বিষয় গোপন রাখা এবং আমার অভিপ্রায় তা প্রকাশ করা।’ পরম করুণাময় আল্লাহ সত্যকে প্রকাশ করে আমাদের ওপর মেহেরবানি করেছেন। তাই তাঁর দরবারে লাখো-কোটি শুকরিয়া।
আমরা যারা নিজেদের সমাজসচেতন হিসেবে দাবি করি এবং জোর গলায় মাইক ফাটিয়ে বক্তৃতার মঞ্চে বলি, ‘আমরা দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য রাজনীতি করি।’ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে কি আমরা প্রশ্ন করি যে, মঞ্চের বক্তৃতা ও আমাদের ব্যক্তিজীবনের সমন্বয় কতটুকু? মানুষসহ প্রতিটি প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। চিরন্তন সত্য যে, মানুষকে নাম, যশ, ক্ষমতা, অর্থ-সম্পদ, প্রতিপত্তি রেখে সম্পূর্ণ খালি হাতে দুনিয়া থেকে চলে যেতে হয়। আমরা রেখে যাবো আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে। আমাদের কর্মকাণ্ড, পৈশাচিকতা এবং প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতার কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ পৃথিবী কতটুকু নিরাপদ হবে? প্রতিটি কর্মের জন্য মানুষকে জবাবদিহি হতে হয়। নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য আমরা সমাজকে যে অস্বস্তিকর অবস্থায় রেখে যাচ্ছি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তা আরো বড় বিপদ হয়ে ঘুরে আসবে।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।