Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ফেরদৌস হীরার গীতল দিনগুলো সেই প্রত্ন-স্মৃতির শৈল্পিক বয়ান

প্রকাশের সময় : ১৯ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

গাউসুর রহমান

বাংলাদেশের কবিতায় অনেকটাই নিভৃতচারী অথচ নিরন্তর আবর্তিত সজীব, প্রাণময় কবি ফেরদৌস হীরা। কবিতায় তিনি কোনোভাবেই অসতর্ক কিংবা নিদ্রিত নন। নির্মাণ, পুনর্নির্মাণের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হন ষাটের দশকের উজ্জ্বল এক কবি ফেরদৌস হীরা তার কবিতায়। কবিতা নানা অবয়ব পেয়েছে তার লেখায়, বৈচিত্র্যের ভেতর দিয়ে এগিয়ে গেছেন তিনি নিরন্তর আবেগকে পুনর্নির্মাণ করে। গীতল সুরের মূর্চ্ছনায় তিনি ভাবকল্পনার জগতে পরিব্রাজন করেন। জনরুচির নানা উপাচারে সাজিয়েছেন তিনি তার কবিতা বিশুদ্ধ নান্দনিক চেতনায়, মানুষের মনোজগতের দ্বৈরথেÑ যা দার্শনিকতার মাত্রাযুক্ত। ‘গীতল দিনগুলো সেই’ ফেরদৌস হীরার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ। তার আগের কাব্যগ্রন্থগুলো হচ্ছে যথাক্রমে ‘শেকড়ের আর্তনাদ’, ‘বিসুভিয়াসে নাশপাতি,’ ‘উত্তাল ঢেউ’, ‘কোথায় ঘাসফুল কাশবন’।
জীবনের চক্রনিনাদ থেকে অনেকটাই দূরে অনেকটা আত্মমুগ্ধতায়ই ফেরদৌস হীরা কবিতা রচনা করেন। প্রেম, প্রকৃতি নিসর্গ কবির চেতনার গভীরতর স্তরে শীলীভূত। লোকমানসের উন্মুখর চেতনার পাটাতেন স্পর্শ করেছেন এই কবি। আত্মমগ্নতার কারণে খুচরা অনুভূতিসমূহও ফেরদৌস হীরার কবিতার মূলভূমি স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছে। নারী-পুরুষের বিচিত্র অথচ চিরন্তন প্রেম-বিরহ বিশেষ মর্যাদায় স্থান করে নিয়েছে :
‘কোথায় হারিয়ে গেলো গীতল দিনগুলো সেই
দল বেঁধে পাতিহাঁস সাঁতরায় পুকুরে
অমন পুকুর কই
তুলো-মেঘ ডাক দিয়ে যায়
ডাক দেয় পাখিরাও
ডাকে নদীর কলতান
ঘাস আর পাতার ভাষা বোঝে কি কেউ
কুয়াশা ছুঁয়ে যায় তোমার আমার পথরেখা
সন্তাপহারী বৃক্ষেরা সমর্পিত হয় গহন রাতে
গীতল দিনগুলো মনের বীণায় বাজে-শুধু বাজে
বসন্ত-সৌরভে ভিজে যাই দু’জনে
কখনো-বা বৃষ্টিতে কদমতলে’ (‘গীতল দিনগুলো সেই’)
কবিভাষার সহজতা ও উচ্চারণের উষ্ণ উদার ঘনিষ্ঠতা ফেরদৌস হীরার কবিতার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সহজতা আর কথোপকথনহীনতা এক কথা নয়। এ বৈশিষ্ট্য শৈল্পিক সজাগতা নিয়েই বেড়ে ওঠে। আত্মসমীক্ষা ফেরদৌস হীরার কবিতায় আত্মখনন হয়ে এসেছে। কবির অন্তর্জগৎ অন্তর্বৃত...। তাঁর অন্তর্ভূগোলের অন্ধকারও তাঁর কবিতায় এসেছে একটি সংগুপ্ত সেতারের দীর্ঘবাদনের মতো। যা সকল উচ্চারণের পিছনে সুরের পশ্চাৎপটটি তৈরি করে। অন্তর্তলের বোধ-পৃথিবী থেকে কবি তাই উচ্চারণ করেন :
‘হঠাৎ অবেলায় স্বপ্নের মতো
দেখেছি তোমায় নিবেদিতা রায়
জগডুম্বুর ডালে-বসা গানের পাখির
 সুরের আসরে নূপুর পা’য়!
পরে ধীরে ধীরে নেমে এসে নীচে
বসলে পাশে অবাক করে আমায়!
যেনো যুগ-যুগান্তর পরে ডানার ক্লান্তি ঝেড়ে
বসলে হেসে আমার-মন মোহনায়!’ (‘নিবেদিতা রায়’)
ফেরদৌস হীরার কবিতা বহু স্তরবিশিষ্ট। তার কবিতায় প্রেম, সমাজচেতনা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমকালের খোলকরতালের সঙ্গে মিশ্রিত রূপ দ্যায় মহাকাল ও মহাজীবনের দুন্দুভি। জীবনবন্দনা আছে তার কবিতায়, আছে জীবনবন্দনার ভেতরের আয়রনি। তার কবিতায় জীবনতৃষ্ণা ও জীবন- বিবমিষার করুণ ও দ্রাবী সংমিশ্রণ রয়েছে। একটি নরম, সংবেদনশীল মন আছে ফেরদৌস হীরার। যে মনে ভ্রমণ করে বেড়ায় শিশিরের মতো ক্ষণস্থায়ী ও স্বল্পপ্রভ অনুভূতিপুঞ্জ। যন্ত্রণার বোধটি তার কবিতায় সহজেই অনুভব করা যায়। জীবনের উচ্চতা-গভীরতাকে দার্শনিক প্রজ্ঞা এবং গভীরতর জীবনানুভবের আলম্ব-দ- দিয়ে পরিমাপ করেন তিনি কখনো কখনো। যা তার কবিতায় শব্দের ধনুকে টঙ্কার তোলে :
‘যেখানে ফুল আছে সেখানে সুমনা আছে-আছে
সুমনার মন-ছোঁয়া সুন্দর প্রতিবেশ, যেখানে
ফুলের গন্ধ আছে সেখানে স্বপ্ন আছে-আশা আছে- জীবন আছে স্বপ্ননিবিড়!’ (সুমনা-১)
মুক্তিযুদ্ধ ফেরদৌস হীরাকে দিয়ে দীপ্তিমান কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে। আর্তনাদ আর রক্তপাতের প্রেক্ষাপটে বিধ্বস্ত ভস্মীভূত স্বদেশ কবির কলমের আঁচড়ে হৃদ্য আবেগকে ধরে রেখেছে। তার কবিতায় সহজেই জায়গা করে নিয়েছে। রক্তাক্ত বাংলার আর্তনাদ, মুক্তিসেনার দৃপ্ত পদধ্বনি, মানবতার জয়গান, স্বদেশের প্রতি মমত্ববোধ ও ভালোবাসা এবং যুক্ত করেছে শৈল্পিক রক্তের নতুন নতুন প্রবাহ। তিনি তার কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের বাহ্যিক রক্তক্ষরণ ও পাকিস্তানী সন্ত্রাস অভিক্ষেপকেই তুলে আনেননি; বরং এর ভেতরকার চিরন্তন সংগ্রামের দিকটিও তুলে এনেছেন :
‘স্বাধীনতা তুমি, ‘গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান,’
তুমি, ‘নৃত্য-পাগল ছন্দ,’ ‘মুক্ত জীবনানন্দ,’ ‘সৃষ্টি-সুখের’ তৌর্যতান!
স্বাধীনতা তুমি, একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা অনির্বাণ,
স্বাধীনতা তুমি, মুক্তিসেনার দুর্বার উত্থান।
স্বাধীনতা তুমি, পতাকার বুকে জ্বলজ্বলে ভাস্কর-
তুমি কঠিন পাহাড়-চেরা নির্ঝর-ঝরঝর!
স্বাধীনতা তুমি, পৈতৃক ভিটে ফিরে-পাওয়া,
তুমি উত্তাল ঢেউ ভেঙে তরী বাওয়া;
তুমি নবজাতকের মাতৃস্তন্যপান-
তুমি প্রাণ খুলে গাওয়া গান!
......
স্বাধীনতা তুমি, হাজার বছর পরে প্রশান্তির ঘুম-
স্বাধীনতা তুমি, খোকার কপালে সোহাগী মা’য়ের আদর-মাখা চুম!’ (‘স্বাধীনতা তুমি’)
ফেরদৌস হীরা প্রত্যক্ষ করেন শ্বাপদ পৃথিবীর আগ্রাসন, প্রত্যক্ষ করেন মানুষের ভেতরের নেকড়ের পাল। এইসব বিষমতা ও বৈরিতা থেকে বেরিয়ে আসতে চান কবি। কবি-হৃদয়ের আর্তনাদ তাই সুস্থ, সুন্দর জীবনতৃষ্ণার গান গায়। বাস্তবতার প্রহরজর্জরিত হয়েও কবি সুন্দর চেতনাজগৎ নির্মাণের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন কবিতায়।  বাস্তবতাবোধজর্জর কবিমানস হয় কখনো কখনো স্বপ্ন প্রস্থানের অন্য নাম, অচেনা ও রহস্যময় প্রকৃতি-নিসর্গের অন্য নাম।
কবির চিন্তন-প্রক্রিয়ায় সৌন্দর্য ও জীবনবোধ তখন নতুন পৃথিবীর দিকে যাত্রা করে। মানববিশ্বের উদ্যত আগ্রাসন কবিকে বেদনাহত করে নিরন্তর :
‘ মুক্ত জগত অবারিত পথ
চেয়ে আছে তার পানে,
উদার আকাশ হাতছানি দেয়
মুক্তির আহ্বানে।
পেছনে যাহার চরণের দাগ
রহিলো না ধুলি’ পরে-
পথের ধুলার কিইবা লাভ আর
তার কথা মনে করে?
সঙ্গী-বিহীন পথিকের মনে
কেন আজি অসময়
সাথী হারাবার ব্যথা বার বার
জাগায় মিথ্যে ভয়!’ (‘পথিক’)
ফেরদৌস হীরা বিষাদ আর আনন্দকে নিজ চেতনার সন্নিকটেই দেখেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর প্রেম পঞ্চেন্দ্রিয়ের মঞ্চপ্রদীপ জ্বেলে দেহমন্দিরের জীবনের আরাধনায় ব্যস্ত-সমস্ত। দেহাত্মবাদী ও রূপতান্ত্রিক ফেরদৌস হীরা কবিতায় হৃদয়ের দাবির মূল্য যেমন চান, তেমনি চান শরীরের দাবির উপস্থিতি। কবি সব স্মৃতিকে বিসর্জন দিতে পারলেও প্রেমের স্মৃতিকে বিসর্জন দিতে পারেন না কিছুতেই। আবেগের প্রবলতায় ও মর্মজ্বালার তীব্রতায় তাঁর প্রেমের কবিতা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে। প্রেমের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের স্বাধীন সত্তাকে আত্মমুগ্ধ গ্রাহ্যতা দিয়েছেন ফেরদৌস হীরা। তাঁর কবিতায় প্রেমের দায় ও দায়িত্ব-দুই-ই আছে। ব্যক্তিসত্তা এবং সামাজিক সত্তা মিলে ফেরদৌস হীরার কবিতায় বোধের বিম্বিত দর্পণ হিসেবে এসেছে। বাস্তবতাবোধজর্জর বিধৃত কবিসত্তার মধ্যেও স্বাপ্নিকতার উদ্দাম বোরাকের যাত্রা চলতে থাকে তাঁর কবিতায়। যা কবির দুর্মর বাসনার সংরাগ ও আত্মার সমীকরণÑ ফেরদৌস হীরার পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘গীতল দিনগুলো সেই’ সেই সাক্ষ্যই বহন করে। প্রকৃতি ও নিসর্গের রূপপ্রভা ফেরদৌস হীরার কবিতায় এক নতুন রসায়ন তৈরি করে। এ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, নিসর্গ-সুন্দরীর সঙ্গে কবি মানস-সুন্দরীকে এক ও একাকার ভেবেছেন :
‘সেকি অনুপম ঝরা ঝমঝম-পরশে মুগ্ধ হই,
এমন বাদলে বাহিরে না গেলে পরাণ জুড়াবো কই?
হাসনাহেনার গন্ধে আকুল
ব্যাকুল হৃদয় করে শুধু ভুল-
কৃষ্ণচূড়ার রঙ দেখি আর মন করে ‘সই সই,’
উড়ায়ে কাজল-মেঘের আঁচল বরষা এলো রে ওই!’  (‘বরষা’)
ফেরদৌস হীরার ‘গীতল দিনগুলো সেই’ প্রতœ-স্মৃতির শৈল্পিক বয়ান-যা সমকালীন বাংলা কবিতায় একটি ঋদ্ধ ও মূল্যবান সংযোজন। গ্রন্থটির ছাপা, বাঁধাই ভালো। প্রচ্ছদ দৃষ্টিনন্দন।
গীতল দিনগুলো সেই। ফেরদৌস হীরা। প্রকাশ : মে ২০১৬। প্রকাশক : অনিত্য  প্রকাশ, ময়মনসিংহ। প্রচ্ছদ ও অঙ্গসজ্জা শামীম আশরাফ। মূল্য : ২৭৫ টাকা।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ফেরদৌস হীরার গীতল দিনগুলো সেই প্রত্ন-স্মৃতির শৈল্পিক বয়ান
আরও পড়ুন