পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আধিপত্যবাদের ঐতিহাসিক ধারাক্রমে সব দেশ ও অঞ্চল যেন একটি অনিশ্চিত গন্তব্যের চক্রে বন্দি। ঔপনিবেশিকতা থেকে মহাযুদ্ধ এবং পরবর্তী আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক এজেন্ডায় পশ্চিমা আধিপত্যবাদের যে দুর্লঙ্ঘ জাল পাতা হয়েছিল একবিংশ শতকে এসে তা ক্রমশ সঙ্কুচিত ও ছিন্ন হতে শুরু করেছে। বিংশ শতকের শুরুতে সাইকস পাইকট চুক্তি ও বালফোর ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা পরাশক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যে ভাগবাটোয়ারা করেছিল তা থেকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বেরিয়ে আসতে না পারলেও সেই ১৯৭৯ সালের ইরান বিল্পব এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদার বাহিনীর পরাজয়ের মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার যে নতুন সম্ভাবনা জেগে উঠেছিল তা এখন যেন মাতৃত্বকালীন যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছে। যে কোনো সময় সেই স্বপ্নের স্বাধীনতার আওয়াজ শোনা যেতে পারে। এহেন পরিস্থিতি আঁচ করে জায়নবাদি ষড়যন্ত্রের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা, ইসরাইল ও তাদের সহযোগী ও বশংবদ শাসকরা প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে। জাতিসংঘের নতুন পুরাতন রেজুলেশন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত সমর্থনের মধ্য দিয়ে স্বাধীন ফিলিস্তিনের সম্ভাবনা যখন বাস্তবতার খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছে গেছে, ঠিক তখনি আরব উপসাগরীয় অঞ্চলের কতিপয় পশ্চিমা বশংবদ শাসককে গোপণ সমঝোতায় এনে জেরুজালেম ও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছে আমেরিকান জায়নিস্টরা। বালফোর ডিক্লারেশনের শতবর্ষ পর ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতার স্বপ্নকে আরো শত বছরের জন্য অনিশ্চিত করে তুলতে তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চরি’র ফাঁদে জড়াতে চেয়েছিল তারা। বশংবদ শাসকরা নীরব ভূমিকা পালন করে প্রকারান্তরে জায়নিস্টদের সমর্থন করলেও এমনকি ফিলিস্তিনি নেতাদেরকে হুমকি ও প্রলোভনে দুর্বল করা যায়নি। তারা একবাক্যে একতরফা চাপিয়ে দেয়া, অসম্মানজনক চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। অন্যদিকে ইঙ্গ-মার্কিন ও জায়নিস্ট চক্র জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সেখানে মার্কিন দূতাবাস স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে রাজনৈতিকভাবে সমাধানযোগ্য একটি আঞ্চলিক আন্তজার্তিক ইস্যুকে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল আবর্তে ফেলে দিয়েছে। ইরানের সাথে সম্পাদিত ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি এবং টু স্টেট সলিউশনের পুরনো প্রতিশ্রæতি থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একতরফাভাবে সরে যাওয়ার মানে হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো থেকে পালিয়ে যাওয়া অথবা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি অবসম্ভাবী যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়া।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ১৯১৭ সালে বৃটিশ ইহুদিদের সমর্থন নিশ্চিত করতে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বালফোর ইহুদি কমিউনিটিকে যে অবাস্তব প্রতিশ্রæতি দিয়েছিলেন দুইটি মহাযুদ্ধের চরম ফলাফলের পরও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে সামরিক শক্তিতে ফিলিস্তিনি মুসলমানদের ভূমি দখল করে ১৯৪৮ সালে জায়নবাদি রাষ্ট্র ইসরাইল সৃষ্টি করেছিল ইঙ্গ-মার্কিনীরা। উসমানিয় খেলাফত ভেঙ্গে যাওয়ায় বহুধাবিভক্ত আরবরা ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের মুক্তির প্রশ্নে কখনো ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে পারেনি। জাতিসংঘ তো বটেই, মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্ধশতাধিক দেশ নিয়ে গড়ে ওঠা ওআইসি বা আরবলীগের নেতৃত্ব কর্তৃত্বও অঘোষিতভাবে পশ্চিমাদের ইচ্ছায় আবর্তিত হয়ে আসছে। ইরানে ইসলামি বিপ্লবের আগ পর্যন্ত আর কেউ ফিলিস্তিন ও আল কুদসের মুক্তির প্রশ্নে কোনো রাজনৈতিক অঙ্গিকারের ঘোষণা দেয়নি। ইমাম রুহুল্লাহ খোমেইনিই প্রথম ফিলিস্তিনের মুক্তির প্রশ্নে একটি আন্তর্জাতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে রমজান মাসের শেষ জুমাবারকে (শুক্রবার) আল-কুদস দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। সে বছর ৭ আগস্ট ইরানও লেবাননসহ কয়েকটি দেশে আল কুদস দিবস পালিত হয়। এরপর থেকে গত চল্লিশ বছরে প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে আল-কুদস দিবসের র্যালির কলেবর। ওআইসি ভুক্তপ্রায় সবগুলো দেশে এবং ফিলিস্তিন ও মুসলমানদের ডায়াসপোরার অন্তর্গত পশ্চিমা বিশ্বের প্রায় প্রতিটি বড় শহরে এখন আল-কুদস দিবসের র্যালি বের হতে দেখা যায়। ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমের মুক্তির প্রশ্নে ইরানের আপসহীন কৌশলগত ভূমিকাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জায়নবাদী ইসরাইল ও পশ্চিমাদের ইরান বিদ্বেষ ও রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনার মূল কারণ বলে মনে করা হয়।
তথাকথিত ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষিত হওয়ার আগেই গত বছর ইসরাইলী একটি পত্রিকায় প্রথমে ফাঁস হয়ে যায়। শুরুতেই এর বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে ওঠে এবং প্রায় সর্বত্র প্রত্যাখ্যাত হয়। রাজনৈতিকভাবে এই চুৃক্তির বাস্তবায়ন সম্ভব নয় বলে ধরে নিয়েই ষড়যন্ত্রের পথ ধরে এগিয়ে যায় মার্কিনী ও ইসরাইলি জায়নিস্টরা। চলতি বছরের প্রথম দিনেই বাগদাদ বিমান বন্দরে ড্রোন হামলা করে ইরানের আল কুদস বাহিনীর কমান্ডার কাসেম সুলাইমানিকে হত্যার মধ্য দিয়ে সে ষড়যন্ত্রের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তারা সম্ভবত ইরানের প্রতিক্রিয়া দেখতে চেয়েছিল। ইরান এর কঠোর প্রতিশোধের অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছিল এবং মাত্র তিনদিনের মধ্যেই ইরাকে অবস্থিত একাধিক মার্কিন সেনাঘাটিতে মিসাইল হামলা করে নজিরবিহিন ধ্বংসযজ্ঞ ঘটায়। এরপরও সুলাইমানি হত্যার প্রতিশোধ এখনো শেষ হয়নি বলে ইরানের পক্ষ থেকে একাধিক বার বলা হয়েছে। চল্লিশ বছর ধরেই ইরানের উপর বহুবিধ মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে। সেই সাথে আট বছরব্যাপী ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইন্ধন দিয়ে দু’টি ভ্রাতৃপ্রতিম মুসলিম দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়ার ষড়যন্ত্র ছিল। সুপ্রাচীন ঐতিহ্য, জনগণের ঐক্য ও আত্মমর্যাদাবোধের উপর দাঁড়িয়ে যেকোনো জাতি যেকোনো বড় শক্তির মোকাবিলায় সফল হতে পারে। ইরান তার জ্বলন্ত উদাহরণ। চল্লিশ বছর ধরে অর্থনৈতিক, বাণিজ্য ও কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্তে¡ও ইরান তার সীমিত সম্পদের উপর ভর করে আত্মরক্ষা ও আত্মনির্ভরশীলতার পথে বহুদূর এগিয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যেসব দেশের উপর দীর্ঘমেয়াদি মার্কিন ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা বলবৎ ছিল সেসব দেশ তার প্রতিবেশী অনেক দেশের চেয়ে নানা ক্ষেত্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠার বেশ কিছু উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। এ প্রসঙ্গে গণচীন, উত্তর কোরিয়া, ইরান ও কিউবার কথা উল্লেখ করা যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে এসব দেশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও অর্থনৈতিকভাবে বেশি শক্তি অর্জন করতে না পারলেও জনগণের ঐক্য ও আত্মরক্ষার অঙ্গিকারের মধ্য দিয়ে তারা বিশ্বের এক নম্বর সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তিকে টেক্কা দিয়ে স্বাধীনভাবে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। পক্ষান্তরে আমেরিকা ও পশ্চিমাদের বংশবদ ও পদলেহি শাসকরা একেকটা সম্পদশালী ও সম্ভাবনাময় দেশকে কিভাবে ঋণগ্রস্ত, ভঙ্গুর ও দুর্বল রাষ্ট্রে পরিণত করেছে তার ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। লোকে বলে আমেরিকা যার বন্ধু তার নাকি শত্রæর দরকার হয়না। ইরাক, মিশর, সউদী আরব, পাকিস্তান এবং সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের উদাহরণ দেয়া যেতে পারে।
শুরুতেই বলেছি, একবিংশ শতকে এসে পশ্চিমা আধিপত্যবাদের জাল ক্রমে সঙ্কুচিত ও ছিন্ন হতে শুরু করেছে। তারা যতই আধিপত্য বিস্তারের পথ ধরে আক্রমণাত্মক হচ্ছে, আগ্রাসন ও ষড়যন্ত্রের শিকার দেশগুলো ততই যেন প্রতিরক্ষা ও প্রত্যাঘাতের জন্য বেশি প্রস্তুত হচ্ছে। আর মার্কিনীরা নিজেদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে শোচনীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক পরাজয়ের সম্মুখীন হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কমিটমেন্ট থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বহু বছর ধরে ইরানের বিরুদ্ধে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েও যখন দেশটিকে দুর্বল বা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, পক্ষান্তরে ইরানের তেলসম্পদ এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতার উপর ভর করে মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ায় নতুন ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটতে চলেছে, ঠিক সে সময় মধ্যপ্রাচ্যে একটি শান্তি ও সমঝোতার প্রার্থমিক বার্তা হিসেবে ২০১৫ সালে জেসিপিওএ (জয়েন্ট কমপ্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন) ইরানের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন, জার্মানীসহ ৬ জাতির পারমানবিক সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে সম্পাদিত এই চুক্তি থেকে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একতরফাভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সাথে সাথে মার্কিনীরা নতুন খেল দেখাতে শুরু করে। ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে টু স্টেট সর্লিউশনের ধারণা থেকে সরে যাওয়া, ইরানের চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়ার মত মার্কিন সিদ্ধান্ত ইসরাইল ছাড়া আর কোনো দেশের সমর্থন পায়নি। বিশেষত: ইরানের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত রাখার জন্য মার্কিন চাপ ব্যর্থ হওয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন ভূ-রাজনৈতিক সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে। ২০১৮ সালে জেসিপিওএ থেকে সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পাদিত চুক্তির আওতায় ইরানের উপর চাপ সৃষ্টির সুযোগ হাতছাড়া করে। এরপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত অব্যাহত রাখেেত কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে গেলেও সম্ভবত এই প্রথম পশ্চিমারা মার্কিনীদের সরাসরি বলে দেয় চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের মতামত বা অংশিদারিত্বের যোগ্যতা হারিয়েছে। পাঁচ বছর আগে ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই সম্পাদিত ইরান চুক্তির টাইমলাইনের শর্ত অনুসারে পর্যায়ক্রমে ইরানের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথা রয়েছে। শুরুতেই কিছু বাণিজ্যিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলেও সামরিক প্রযুক্তি এবং সমরাস্ত্র কেনা-বেচা ও বিনিময়ের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরের সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। সে টাইমলাইন অনুসারে গত ১৮ অক্টোবর থেকে ইরানের উপর আরোপিত সামরিক প্রযুক্তি ও সমরাস্ত্র ক্রয়-বিক্রয়ের নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর হয়ে গেছে। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে এক নতুন সামরিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সোপানে পা রাখতে চলেছে ইরান।
মার্কিনী ও পশ্চিমা চাপের মধ্যেই সাংহাই কো-অপারেশন এবং চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভ ঘিরে চীন-রাশিয়া-ইরান তুরস্কসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণে বিশাল অর্থনৈতিক ও সামরিক কৌশলগত কর্ম পরিকল্পনা ইরানের উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা অনেকটা ব্যর্থ করে দিয়েছে। ইরানের উপর নতুন আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত চেষ্টা এবং রাশিয়ার বিরোধিতা অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে উঠেছিল। অবশেষে গত ১৪ আগস্ট জাতিসংঘের ১৫ জাতির নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে যে ভোটাভুটি হয় সেখানে শুধুমাত্র ডোমিনিকান রিপাবলিক ছাড়া আর কোনো দেশ মার্কিন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়নি। জেসিপিও থেকে একতরফাভাবে সরে যাওয়ার কারণে ইরানের উপর জাতিসংঘের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাগুলো অব্যহত রাখতে মার্কিন প্রস্তাবও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো সর্বসম্মতভাবে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছে। ১৮ অক্টোবর থেকে জাতিসংঘের ২২৩১ নম্বর রেজুলেশন অনুসারে আরোপিত নিষেধাজ্ঞা আনুষ্ঠানিকভাবে উঠে যাওয়ার প্রাক-মুহূর্তে দুই আঞ্চলিক শক্তি রাশিয়া ও ইরানের নতুন বাণিজ্যিক ও প্রতিরক্ষামুলক সামরিক বিনিময়ের প্রতিশ্রæতি নিয়ে হাজির হতে দেখা গেছে। গত ১৬ অক্টোবর মস্কোতে অনুষ্ঠিত দুই দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে যে দৃঢ়তা ও সুদূর প্রসারি প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে তাতে এটা এখন পরিস্কার যে, মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক-অর্থনৈতিক কর্মকাÐে রাশিয়া, ইরান, চীন ও তুরস্কের মেলবন্ধন একটি নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার জন্ম দিতে চলেছে। রাশান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লেভরভ এবং ইরানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফ অত্যন্ত প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে দুই দেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সম্ভাব্য মার্কিন নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলায় নিজেদের কঠোর অবস্থানের কথা তুলে ধরেছেন।
পাঁচ-সাতটি সামরিক অর্থনৈতিক পরাশক্তির বাইরে বিশ্বের যে সব দেশ এখনো রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে টিকে আছে তারা প্রায় সবাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও সামরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই টিকে আছে। দেশে দেশে অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্য টিকিয়ে রাখতেই পশ্চিমা গণতন্ত্র ও রিজিম চেঞ্জ পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য। তাদের এই অভিসন্ধির বিরুদ্ধে যারা রুখে দাঁড়াতে পেরেছে শুধুমাত্রা তারাই স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্ত¡া হিসেবে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। পঞ্চাশের দশকে ইরানের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসক মোহাম্মদ মোসাদ্দেক তেলসম্পদের উপর বিদেশি লুন্ঠন ও নিয়ন্ত্রণ বন্ধ করতে প্রথমে অ্যাংলো-ইরানিয়ান তেল কোম্পানীকে জাতীয়করণ করেছিলেন। তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বৃটিশ ও আমেরিকান গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বিত ষড়যন্ত্রের এটাই ছিল বড় কারণ। মোসাদ্দেককে সরিয়ে আবারো শাহকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পশ্চিমা সিদ্ধান্ত সাধারণ ইরানিরা মেনে নিতে পারেনি বলেই ছাব্বিশ বছরের মাথায় ইরানিরা একটি রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্ম দিয়েছিল। এবং জনগণের ঐক্য ও সংহতির মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সব ষড়যন্ত্র ও হুমকি মোকাবেলা করে টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। একইভাবে পঞ্চাশের দশকে মার্কিন সিনেটর মেকার্থি মার্কিন প্রশাসনে এবং বিভিন্ন সেক্টরে কমিউনিস্টদের খুঁেজ খুঁজে দেশ থেকে বের করতে শুরু করলে হাজার হাজার চীনা ও রাশিয়ান শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক, ব্যবসায়ী, বিনিয়োগকারি ও শিল্পোদ্যোক্তাকে আমেরিকা থেকে বের করে দেয়। এসব মেধাবী গবেষক ও উদ্যোক্তারাই পরবর্তীতে চীনকে শিল্পোন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। প্রায় ৫ দশক ধরে আমেরিকান ও পশ্চিমাদের সাথে ¯œায়ুযুদ্ধ, হুমকি-ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে এগিয়ে চলা রাশিয়া, চীন, তুরস্ক ও ইরান যদি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যায়, তাহলে বিশ্বে নতুন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও স্বাধীনতা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়াবে। গত দুই দশকে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইয়েমেনে ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেও কোথাও কোনো কৌশলগত বিজয় অর্জন করতে পারেনি। ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি এবং জেসিপিওএ তে কূটনৈতিক ভরাডুবির মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের চরম পরাজয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে গেছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।