পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কাপ-পিরিচ, ঘড়ি বা মোবাইল চুরির মামলা দিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার বাজে দৃষ্টান্তের সঙ্গে আমরা পরিচিত। এই মামলাবাজিতে সমপ্রতি আরো নতুনত্ব এসেছে। তাও একটি রাজনৈতিক সরকারের শাসনামলে। ধর্ষণের পর এবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনেও মামলা হয়েছে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুর বিরুদ্ধে। অপরাধ করলে মামলা করা যাবে না, তা নয়। তাই বলে একটি টিভি না দেখার বা বয়কটের আহবান জানালেই আইসিটি অ্যাক্টে মামলা ঠুকে দিতে হবে? অথচ পত্রিকা বা টিভি বয়কটের আহবান বিশ্ব স্বীকৃত, বহুল প্রচলিত। আসন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে ঘিরে প্রধান একটি দলের সমর্থকেরা এনবিসি টিভি নেটওয়ার্ক বয়কটের আহবান জানিয়েছে। এতে সেখানে কোনো মামলা হয়েছে বলে এখন পর্যন্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। যুক্তরাষ্ট্রে হয়নি বলে বাংলাদেশে হতে পারবে না, এমনটাও বলছি না। হতে পারে। তবে, এ ধরনের অভিযোগে মামলা হওয়া বিরল। সংবাদপত্র বা মিডিয়া বয়কটের আহŸান এর আগে আরো অনেকেই জানিয়েছে। বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকের একজন দৈনিক প্রথম আলো বয়কটের আহবান জানিয়ে ছিলেন। সংসদে সরকার দলীয় সাংসদ শামীম ওসমান অত্যন্ত কড়া ভাষায় ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর বিরুদ্ধে সমালোচনা ও বয়কটের আহবান জানিয়েছিলেন। এরও বহু আগে বিভিন্ন সময় আওয়ামী লীগের মুখপাত্র দৈনিক বাংলার বাণী (বিলুপ্ত), জণকণ্ঠ, বিএনপির দিনকাল, আমার দেশ (বন্ধ) ইত্যাদি পত্রিকার বিরুদ্ধেও বয়কটের ডাক দিয়েছিলেন বড় গোছের রাজনৈতিক নেতারা। কেবল বয়কট নয়, তারা তা বন্ধ করে দেয়ার দাবিও করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল বন্ধও করে দেয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, যার যখন স্বার্থে আঘাত লাগে, তখন তিনি বা তারা এ ধরনের আহŸান জানান। আবার পক্ষে গেলে, নিউজ কাভারেজ পেলে চুপ মেরে থাকেন। কাভারেজ পেলে ধন্য। পক্ষে গেলে আদর-সমাদর। আর নিউজ মন মতো না হলে, নিজের পক্ষে না গেলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠা, গালিগালাজ করা, পত্রিকা পুড়িয়ে প্রতিবাদ-বয়কটের বাহাদুরি করা, সুযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মীকে মারধরের ঘটনাও ঘটেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ব্যক্তিবর্গকে সংযোগ-টকশোতে বিব্রতকর প্রশ্ন করা, ইসলাম ধর্মকে আঘাত করে নিউজ, অনুষ্ঠান, টকশো ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন সময় সমালোচনার পাত্র হয়েছে দেশের একটি বিতর্কিত টেলিভিশন চ্যানেল। আর এই টিভি বয়কটের দাবি করার পর থেকেই ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুকে নিয়ে কিছু রাজনৈতিক মহলসহ দেশের সাংবাদিক কমিউনিটির অনেকেই পক্ষে-বিপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেছেন। আবার এদের একাংশ তার উপর ভীষণ চটেছেন। টেলিভিশন চ্যানেল বয়কটের ডাকে গভীর উদ্বেগ ও তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন তারা। নুরু কোনোক্রমেই টেলিভিশনকে বয়কটের আহŸান জানাতে পারেন না বলে অভিমত তাদের। তাদের মতে, নুরু এখন স্বাধীন গণমাধ্যমের জন্য হুমকি তথা বিপজ্জনক ব্যক্তি। অথচ স্মরণ করা যেতে পারে, এর আগে এই টেলিভিশনের প্রতি ক্ষোভ-বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নুরুর পূর্বসুরি কিংবদন্তী ছাত্রনেতা সরকার দলীয় প্রখ্যাত রাজনীতিক তোফায়েল আহমেদ এবং জাসদের সভাপতি আ স ম আব্দুর রব। এ টেলিভিশনে কোনো ভদ্রলোকের যাওয়া উচিত নয় বলে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন তোফায়েল আহমেদ। তারা সঠিক করেছেন, না বেঠিক করেছেন-এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। তাদের নামে কিন্তু মামলার পর্বটি আসেনি। আসা উচিৎও না। এই প্রখ্যাত রাজনীতিক এবং নুরু এক সারির নন। কেউ কারো সঙ্গে তুলনীয়ও নন। তাদের অবস্থা-অবস্থান, আঙিনা ভিন্ন। তাদের পক্ষে-বিপক্ষে এ নিয়ে সাফাই গাওয়াও জরুরি নয়। তবে পেশাদার সংবাদকর্মী মাত্রই যেকোনো সংবাদমাধ্যম বয়কটের আহŸানকে গ্রহণ করতে পারে না। বয়কট তাদেরকে ভীষণ আহত করে। তাদের কাছে তা গণমাধ্যমের কন্ঠ স্তব্ধ করার চেষ্টার মতো। প্রতিটি সংবাদকর্মী ও সংবাদমাধ্যমকে প্রতিদিন, প্রতি মূহুর্তে পাঠক-দর্শকের কাছে বহু পরীক্ষা দিতে হয়। অন্যদিকে গণমাধ্যমের মূল দায়বদ্ধতার জায়গা পাঠক-দর্শক-শ্রোতাদের কাছে। পত্রিকা পড়া না পড়া, টিভি দেখা না দেখা, রেডিও শোনা না শোনার নিরঙ্কুশ অধিকার তাদের আছে। এটা তাদের মৌলিক অধিকার। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে মানুষ কি সংবাদপত্র কিনে বা ডিশের বিল দিয়ে টিভি দেখে না? সেখানে তারা নিজে বর্জন করে অন্যকেও সেই ডাক দিতে পারবেন না কেন? আবার গ্রহণের আহŸানও কেন জানাতে পারবেন না? পথে-ঘাটে, বাসা-বাড়ি, অফিস-আদালতে গ্রহণ-বয়কটের আহŸান তো নিয়মিতই চলছে। কেবল বয়কট নয়, অপছন্দের গণমাধ্যম কর্মীকে মেরে ফেলার ঘটনাও রয়েছে। আবার নিজের পছন্দের পত্রিকা বেচতে-কিনতে বাধ্য করার খবরও আছে। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞাপন দিতে বা না দিতে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনার বিষয়ও গোপন থাকে না। এগুলো কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
নুরু ইস্যুতে রাজনীতিতে ‘বয়কট’ শব্দটি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এর জের ভালো হওয়ার কথা নয়। বয়কট রাজনৈতিক, সামাজিকসহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক প্রচলিত হলেও শব্দটির আদি সবার জানা না-ও থাকতে পারে। ‘বয়কট’ একটি বিদেশি শব্দ। এর উৎপত্তি ও প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বেশ চমকপ্রদ। বয়কট একজন আইরিশ ব্যক্তির নাম। পুরো নাম চার্লস বয়কট। তাঁর নাম থেকে ইংরেজিতে ‘বয়কট’ শব্দটি যুক্ত হয়। যার অর্থ একঘরে করা, বর্জন করা, এড়িয়ে চলা, ঘৃণা করা ইত্যাদি। বয়কট পেশায় ছিলেন সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। মেজাজ ভীষণ খিটখিটে। তিনি রয়াল মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন ১৮৪৮ সালে। চাকরিতে থাকা অবস্থায় ১৮৫২ তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাই এক পর্যায়ে ১৮৫২-তে চাকরি ছেড়ে দেন। এর পর আয়ারল্যান্ডের মেয়ো কাউন্ট্রিতে তৃতীয় আর্ল অব আনরাউর এক স্টেটের ম্যানেজার হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানকার বর্গাচাষিদের কাছ থেকে জমির ভাড়া নিয়মিত আদায় করাই ছিল তার কাজ। সে সময় দেশটিতে জমির বণ্টন ব্যবস্থা নিয়ে গোলযোগ চলছিল। এতে চাষাবাদ এবং ফলন কমে যায়। দেখা দেয় খাদ্যাভাব। চাষিরা দাবি জানায়, ন্যায্য ভাড়া, বর্গা না বদলানো এবং ফসল বিক্রির ক্ষেত্রে স্বাধীনতা দিতে হবে। ১৮৭০ সালে আইন হলো, বর্গাচাষিরা উপযুক্ত দাম দিয়ে জমির মালিক হতে পারবে। কিন্তু বয়কট যখন দায়িত্ব নিয়ে এলেন তখন চাষাবাদের অবস্থা খুবই খারাপ। কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৮৮০ সালে পার্লামেন্ট মেম্বার চার্লস পারনেলের নেতৃত্বে গঠিত হলো আইরিশ ন্যাশনাল ল্যান্ড লীগ। পারনেল ছিলেন বেশ জনপ্রিয় নেতা। তিনি আমেরিকা থেকে আইরিশদের জন্য সাহায্য নিয়ে এসেছিলেন। দেশে ফিরে পারনেল ঘোষণা দেন, কোনো বর্গাচাষি এমন কোনো জমিতে কাজ নিলে এবং সেখান থেকে তার আরেক বর্গাচাষি ভাই উৎখাত হয়ে গেলে তাকে সামাজিকভাবে একঘরে করে দেওয়া হবে। আর জমির মালিক বর্গাচাষিদের নির্ধারিত রেটে জমি বর্গা দিতে রাজি না হলে তাকেও সামাজিকভাবে একঘরে করা হবে। পারনেলের এ ঘটনার প্রথম শিকার হলেন রগচটা ক্ষেপাটে বয়কট সাহেব। বর্গাচাষিরা জমির রেট কমাতে বললেও তিনি তা করতে পারলেন না এবং চাষিদের বরখাস্ত করলেন। চাষিরা এতে ক্ষেপে যায়। তারা বয়কটকে উচিত শিক্ষা দিতে চাইলেন। তারপরই তার জীবনে নেমে এলো বিভীষিকা। চাষিরা দলবেঁধে তার বাসায় এলেন। তাদের সব কর্মচারী বয়কটকে ত্যাগ করে চলে গেল। এর ফলে জমির ফসল তোলার মতো কোনো লোক রইল না তার। চাষিরা সবাইকে তার বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলে। বাজারে গিয়ে দেখেন, কেউ তার কাছে কিছু বিক্রি করছে না। এমনকি ডাকপিয়নও তার চিঠি বিলি করছে না। রীতিমতো সবাই তাকে একঘরে করে ফেলেছে। উপায় না পেয়ে তিনি ব্রিটিশ সৈন্যদের পাহারায় ৫০ জন কৃষক এনে ফসল তোলার কাজ শেষ করেন। পরের বছর নিরুপায় হয়ে বয়কট আয়ারল্যান্ড ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু ততদিনে সামাজিকভাবে একঘরে, বিতাড়িত, এড়িয়ে চলার নিয়মটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় বয়কটের নামে। সময়ের স্রোতে দুনিয়া অনেক এগুলেও বয়কট শব্দটি দেশে-দেশে রয়ে যায়। এই উপমহাদেশেও ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটানসহ বিভিন্ন দেশ বয়কটকে মনে করে নিজস্ব ভাষার কোনো শব্দ। নুরুকে ঘিরে শব্দটি আবার যেভাবে সামনে এসেছে, তা কারো জন্য নতুন কিছুর ইঙ্গিত না হলেই ভালো।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।