Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দেশে ধর্ষণ বৃদ্ধির কারণ কি?

মীর আব্দুল আলীম | প্রকাশের সময় : ১৫ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

দেশজুড়ে ধর্ষণের প্রতিবাদে ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে। ইতোমধ্যে ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করা হয়েছে। এটি একটি ভাল উদ্যোগ। অন্যদিকে করোনা ভাইরাস আতংকের মধ্যেও ধর্ষণের ঘটনা বৃদ্ধি উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। এক প্রতিবেদনে প্রকাশ, গত ৯ মাসে দেশে ৯৭৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর ৪৩ জনকে হত্যা করা হয়েছে। এই তথ্য খুবই উদ্বেগজনক। এতে প্রমাণিত হয়, বখাটেদের হাত থেকে নারীরা রেহাই পাচ্ছে না। সিলেট এমসি কলেজে নববধূকে গণধর্ষণের পর নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে নারীকে বিবস্ত্র করে বর্বরোচিত নির্যাতনের রেশ না কাটতেই আরও অনেক ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। রাজধানীতে ১৩ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্রী, খাগড়াছড়িতে চাকমা মহিলা, বেনাপোলে দুই কিশোরী মেয়ে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। এসব ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের ঘটনার পর দেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু সময় হইচই হয়। ফেসবুকে ঝড় ওঠে, জেলায় জেলায় বিক্ষোভ হয় এবং তারপর গতি হারায়। কোনটারই বিচার হয় না।

প্রশ্ন হলো, দেশে এত ধর্ষণ হচ্ছে কেন? তা রোধের উপায় কি? ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন বন্ধে আগে মানসিকতা বদলাতে হবে। ধর্ষণ কমাতে হলে মানুষের মধ্যে মানবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ রোধে সচেতন হতে হবে। অবাধ মেলামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্ণো-সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন উত্তেজক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লীল নাটক-সিনেমা ইত্যাদি থেকে সরে আসতে হবে। এগুলো বর্জন করতে হবে। পর্ণোসাইটগুলো বন্ধ করতে হবে যেন মোবাইল কিংবা কম্পিউটারে তা দেখা না যায়। ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালিন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোষাক বর্জন করতে হবে। বলা বাহুল্য, প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে তুলে। এর অন্যতম কারণ কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণ। ফলে এগুলো থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগে খুব বেশি কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগের কথা বললেই হবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় উপসনালয়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ও সমাজের বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।

অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশী সংস্কৃতির আগ্রাসন ধর্ষণ রোধের অন্তরায় মনে করা হয়। অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে, তা হাল আমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই আন্দাজ করা যায়। শুধু ধর্ষণই নয়, ধর্ষণের পর নৃশংস হত্যার ঘটনা অহরহ ঘটছে। অপরাধীর সাজা না হলে এ জাতীয় অপরাধ বাড়তেই থাকবে। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে তার অন্যতম কারণ ধর্ষণকারীর সাজা না হওয়া। এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। ধর্ষণের শিকার বেশিরভাগই নিন্ম ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর। যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, তারা শিকার হচ্ছে কম। যারা নিম্নবর্গের, তারা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিকভাবে নেয়। ভয়ে চুপ থাকে। তাদের ধারণা, আইন আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। এ মানসিকতা এবং অন্যায় করে অপরাধির পার পেয়ে যাওয়ার কারণেই দেশে ধর্ষন বেড়ে গেছে। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদির নেতিবাচক মানসিকতার বিস্তৃতি ঘটছে। সমাজ থেকে মূল্যবোধ ও নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে।
ধর্ষণ বৃদ্ধির জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতাই দায়ী বেশি। কারণ, অন্যায়কারী জঘণ্য অন্যায় করার পরও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না। এজন্য অবশ্য রাজনৈতিক চাপও দায়ী। অনেক ক্ষেত্রে আইন সমানভাবে কার্যকর হয় না। উচ্চ শ্রেণীর নারীরা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে তারা এর শিকার কম হয়। আসল সমস্যাটা হলো একশ্রেণীর কুরুচিপূর্ণ পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও তাদের এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী ধর্ষণের শিকার হয় কি করে?

এযাবৎ যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হওয়ার নজির কমই আছে। এর কারণ, চুড়ান্ত রিপোর্টে ঘাপলা নয়তো স্বাক্ষ্যপ্রমাণ প্রভাবিত করে অপরাধী পার পেয়ে গেছে। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা পাল্টা হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়। ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডনীয় হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ডও দিতে হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দন্ডনীয় হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। উপধারা ৯(৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যুর জন্য দায়ী। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদন্ডেও দন্ডিত হবে। বলা বাহুল্য, ধর্ষণের আইন আছে ঠিকই তবে তার যথাযথ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। আইন যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাঁটে না। কখনো অর্থের লোভ কখনোবা হুমকি ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার চার্জসিট গঠনের সময় ফাঁক ফোকর থেকে যায়। তাই আদালতের রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। এসব মামলার ক্ষেত্রে চার্জসিট গঠনের সময় কোন ম্যাজিস্ট্রেট অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চূড়ান্ত রিপোর্টের সময় ভিক্টিমের স্বাক্ষাৎকার গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে চার্জসিট দাখিলের ক্ষেত্রে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে।

নারীদের জন্য ঘরের বাইরে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে বিচারহীনতার সংস্কৃতিই অপরাধীকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরী। এজন্য সততা, আন্তরিকতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিৎ। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য যা যা করা দরকার প্রশাসন তা সুনিশ্চিত করবে- এটাই সকলের প্রত্যাশা।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • Jack Ali ১৫ অক্টোবর, ২০২০, ১১:৫৮ এএম says : 0
    The reason behind rape and all the other heinous crimes are committed by people because our country is not rule by the Law of Allah.. We must rule our country by the Law of Law then all the criminal and crime will flee from our country.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধর্ষণ


আরও
আরও পড়ুন