Inqilab Logo

রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরী

সতর্কবার্তায় ৭২৩টি লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর

বজ্রপাতে দশ মাসে ২৩৯ জনের মৃত্যু

পঞ্চায়েত হাবিব | প্রকাশের সময় : ৮ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০২ এএম

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমানোর জন্য দেশব্যাপী ১০ লাখ তালগাছ লাগানো হয়েছে। চলতি বছরের দশ মাসে দেশের ৬৪ জেলায় ২৩৯ জন মানুষ বজ্রপাতে মারা গেছে। তবে বেসরকারি হিসেবে বজ্রপাতে ৬৪ জেলায় ৩৮২ জন মারা গেছে এবং আহত হয়েছে ১২৫ জন। ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ দশ বছরে বজ্রপাতের ঘটনায় ২ হাজার ৪শ’র বেশি মানুষ মারা গেছে। গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বাংলাদেশ।

এদিকে বজ্রপাতের ক্ষয়-ক্ষতি ঠেকানোর লক্ষ্যে দেশবাসীকে আগাম সতর্কবার্তা দিতে দেশের ৭২৩টি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে বজ্রপাত চিহ্নিতকরণ যন্ত্র বা লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর স্থাপন করবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। এছাড়া হাওর এলাকায় ধান কাটার শ্রমিক ও কৃষকের অবস্থানের জন্য সেল্টার নির্মাণ করবে সরকার। জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সম্প্রতি বাংলাদেশে বজ্রপাত বেশি হচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বজ্রপাতে প্রাণহানির ঘটনাও বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। তাই বজ্রপাতকেও একটি দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই লাইটনিং ডিটেকটিভ সেন্সর বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও অন্ধ্রপ্রদেশ এই সেন্সর ব্যবহার করে সুফল পেয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোহসীন।
সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, বজ্রপাত যেহেতু সাধারণত উঁচু কোন কিছুতে আঘাত করে, সেজন্য তালগাছকেই তারা বেছে নিয়েছেন বজ্রপাত ঠেকানোর জন্য। তাদের ভাষায়, বজ্রপাতে মৃত্যু ঠেকানোর জন্য এটাই সবচেয়ে কার্যকর স্থানীয় প্রযুক্তি। এর পাশাপাশি হাওর অঞ্চলে টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। দেশে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যু কমানোর জন্য ১০ লাখ তালগাছ লাগানো প্রকল্প শুরু হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রতিবছর বহু মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারায়। প্রতিনিয়ত বজ্রপাতে মৃত্যু ও আহতের ঘটনা বাড়ছে।

ভয়ঙ্কর এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের হাত থেকে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে এবার অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ নিয়ে এসেছে ভারতের পুণের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেটিয়োরোলজির (আইআইটিএম) বিজ্ঞানীরা। ‘দামিনী’ নামের এই অ্যাপ মোবাইলে ইন্সটল করা থাকলে বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগেই সতর্ক করে দেবে। গত কয়েক বছর ধরে বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। দেশে বজ্রপাতে প্রাণহানি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।

এদিকে, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এজন্য কাজের বিনিময়ে খাদ্য ও কাজের বিনিময়ে টাকা কর্মসূচির নীতিমালা পরিবর্তন করে সারাদেশে ১০ লাখ তাল গাছ রোপণ করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। কিন্তু তাল গাছ রোপণ করা প্রকল্প এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। সে কারণে অনেক জেলায় বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়ছে।

মন্ত্রণালয়ের সচিব ইনকিলাবকে বলেন, বজ্রপাতে প্রাণহানি ঠেকাতে সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানো প্রকল্প চলছে। এর পাশাপাশি বজ্রপাতের পূর্বাভাস জানাতে ৭২৩টি এলাকায় সেন্সর বসানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যাতে বজ্রপাতের ৪০ মিনিট আগে মানুষ জানতে পারে। বজ্রপাতের হাত থেকে বাঁচার কৌশল সম্পর্কে গণসচেনতা সৃষ্টির মাধ্যমে মৃত্যুর হার কমানো যেতে পারে। হাওর এলাকায় তালগাছের পাশাপাশি টাওয়ার নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

জানা গেছে, সরকারি হিসাবে ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে বজ্রপাতে ২৩৯ জন মানুষ মারা গেছে। বেসরকারি হিসেবে বজ্রপাতে ৬৪ জেলায় ৩৮২ জন মানুষ মারা গেছে এবং আহত হয়েছে ১২৫ জন। সরকারি হিসাবে ২০১৯ সালে সারাদেশে ১৯৮ জন মানুষ মারা গেছে। আর বেসরকারি হিসাবে ৩৬০ জন। আহত হয়েছে ১৭৯ জন। ২০১৭ সালে সারাদেশে বজ্রপাতে ৩৩৭ জন মানুষ মারা যায়। বেশিরভাগ মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হাওর অঞ্চলে। এর মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেলায় ১৯, সিলেট জেলায় ২৬, নেত্রকোণায় ১৮ ও দিনাজপুরে ৮ জন মারা যায়। এছাড়া বজ্রপাতে বহুসংখ্যক গবাদি পশুরও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চলতি বছরের ৩১ মার্চ কালবৈশাখী ঝড়, শীলা বৃষ্টি ও বজ্রপাতে একদিনে দেশের আট জেলায় মৃত্যুবরণ করেছে ১২ জন, আহত হয়েছে ৫৭ জন।

দুর্যোগ ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বজ্রপাতে ২০১৩ সালে ২৮৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে মারা যায় ২০১ জন। ২০১১ সালে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম ১৭৯। ২০১৩ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৪৬। ওই বছরের মে মাসেই ১২০ জন প্রাণ হারায়। এছাড়া এপ্রিলে ৫৫ ও জুনে ৭৬ জনের মৃত্যু হয়। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে ৩৩ জন। ২০১৫ সালের ২-৩ মে ১৯ জন। ২০১৬ সালে শিশু ৭৯ জন, মহিলা ৫১ জন এবং পুরুষ ২২০ জন মৃত্যুবরণ করে। ২০১৭ সালে বজ্রপাতে শিশু ৫২ জন, মহিলা ৪৩ এবং পুরুষ ২০০ জন মৃত্যুবরণ করে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বজ্রপাতকে এখনো সরকারিভাবে দুর্যোগের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগের পুরো বৈশিষ্ট্য নিয়ে বজ্রপাতের ঘটনা ক্রমে বাড়ছে। সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (এসএমআরসি) বজ্রপাতের ওপর ২০০৯ সাল থেকে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে। সার্ক স্টর্ম প্রোগ্রাম নামে একটি প্রকল্পের অধীনে এ গবেষণা হচ্ছে। এই কেন্দ্রের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতের সংখ্যা ও প্রাণহানির দিক দিয়ে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। সার্কভুক্ত অন্য দেশের তুলনায় বজ্রপাতে এখানে মৃতের হার বেশি। সংস্থাটির ঢাকা কার্যালয়ের গবেষকদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর বজ্রপাতে মৃত্যুবরণ করে এক থেকে দেড় হাজার মানুষ। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইটনিং সেফটি ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতিবছর সারা বিশ্বে বজ্রপাতে যত মানুষের মৃত্যু হয় তার এক-চতুর্থাংশই বাংলাদেশের।

আবহাওয়া অধিদফতরের প্রকল্প পরিচালক মজিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, বজ্রপাতের সতর্কতামূলক তথ্য পাওয়ার পর তা তাৎক্ষণিকভাবে আবহাওয়া অধিদফতরের ওয়েবসাইটের রিয়েল টাইমে প্রচার করা হবে। মোবাইলে ওয়েদার অ্যাপের মাধ্যমে যে কেউ সেই তথ্য পাবেন। তবে এই সতর্কবার্তার ব্যাপারে ক্ষুদেবার্তা পাঠানোর কোন পরিকল্পনা নেই। ডিটেকটিভ সেন্সরটির কোথাও ক্রটি বিচ্যুতি আছে কিনা তা জানতে যন্ত্রটি পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। সেন্সরগুলোতে ধারণ করা তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ১০-১৫ মিনিট আগেই বজ্রপাত ও বিদ্যুৎ চমকানোর মাত্রা জানানো সম্ভব।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃত্যু


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ