পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রাজার নীতি নয়, নীতির রাজার নাম রাজনীতি। এমন নীতি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুব একটা মানে বলে মনে হয় না। রাজনীতি পরিণত হয়েছে অনেকটা নীতিহীনতায়, যাকে অপরাজনীতি বলে। এই অপরাজনীতির কারণে দুর্বৃত্তায়ণ ঘটছে। বেড়ে উঠছে দুর্বৃত্তরা। রাজনীতিকে তারা ব্যবহার করছে অপরাধ-দুর্নীতির হাতিয়ার হিসেবে। নানা বাহিনী গড়ে লুটতরাজ, টেন্ডারবাজি এমনকি ধর্ষণ-গণধর্ষণের মতো ঘটনাও ঘটাচ্ছে। রাজনীতিক নামে কিছু ব্যক্তি ও গোষ্ঠী নানা স্বার্থে এসব দুর্বৃত্তদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। তাদের এই আশ্রয়-প্রশ্রয়ের কারণে জন্ম নিয়েছে বরগুণার নয়ন বন্ড, সিলেটের গণধর্ষণের হোতা সাইফুল, অর্জুন, রবিউলরা।
কিছুদিন পর পরই নানা ঘটনায় ইস্যু হয়ে আসে অপরাজনীতির বলি হওয়া এই মানব সন্তানরা। সা¤প্রতিক সময়ে আলোচিত সাহেদ-সাবরিনা, পাপলু-পাপিয়া, শামীম-সম্রাট-খালেদদের জন্ম এই অপরাজনীতির আখড়া থেকেই। দেশের সবাই জানে, করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতির কারণে সামনে এসেছে সাহেদ, পাপিয়া, আরিফের নাম। মানবপাচার করার কারণে পাপুল। এর আগে ক্যাসিনোকাÐে শামীম-সম্রাট-খালেদ। পাপিয়া যায় সাবরিনা আসে। শামিম যায়, সাহেদ আসে। আরিফ আসে। আসতেই থাকে। তাদের আসা বন্ধ হয় না। তাদের নিয়ন্ত্রণের যেন কোনো ব্যবস্থা নেই চলমান রাজনীতিতে। ঘটনাচক্রে তারা ধরা পড়ালেও কেউ আর তাদের দায় নিতে চায় না। প্রশ্রদাতা আর সেল্ফি তোলা নেতারা সাইড কাটেন। যেন অপরাধীকে তারা চিনেনই না।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন তারা এসব অপকর্মে জড়িয়েছে? সেটাও আরেক রাজনীতি। নষ্টেরও নষ্ট দিক। অপরাজনীতরি কারণে এরা ধরা পড়লেও, এদের নেপথ্যের শক্তি গড়ে তোলে অন্য কাউকে। তাত্তি¡ক রাজনীতির কথা এবং সংজ্ঞা অনেক থাকলেও বাস্তবে আমাদের দেশে রাজনীতির চিত্র অনেকটা এরকমই। আইনের শাসন ও সুরাজনীতি না থাকায় অপরাজনীতির কারণে বেড়ে ওঠা অপরাধীরা শেয়ারবাজার লুটপাট, বিদেশে টাকা পাচার, বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা লুট, সোনালী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংকের হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। এর বাইরে বিচার বহির্ভ‚ত হত্যা, গুম, খুন ধর্ষণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। অপরাজনীতির শিকার হয়ে বরগুণায় রিফাত হত্যার দায়ে ফাঁসির আসামী হয়েছে মিন্নি। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া তার জবানবন্দী পড়ে ধরে নেয়া যায় প্রকৃত ঘটনার সব কথা সে বলেনি। এড়িয়ে গেছে অনেক কিছু। তারপরও যতটুকু বলেছে, তা যেকোন মানুষেরই স্তম্ভিত হওয়ার কথা। কতই বা বয়স ছেলে-মেয়েগুলোর! কলেজ পড়–য়া। এই বয়সেই খুনের মতো ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছে। সম্প্রতি অকল্পনীয় অপকর্ম ঘটিয়েছে সিলেটের এমসি কলেজের ক্ষমতাসীন দলের ব্যানারে বেড়ে ওঠা দুর্বৃত্তরাও। গত ২৫ সেপ্টেম্বর স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার সব আসামি ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। জেলার ক্ষমতাসীন মূল ও অঙ্গ দলের নেতারা তাদের নিয়ন্ত্রক। ২০১২ সালে এই এমসি কলেজ ছাত্রাবাস থেকে শিবির তাড়াতে গিয়ে আগুন দিয়েছিল ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় একাধিক মামলা হলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে সব মামলা থেকে খালাস পেয়ে যায় সন্ত্রাসীরা। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি যে ২৯ জনকে অভিযুক্ত করে তার মধ্যে ১০ জন ছাত্রলীগ ও ১৯ জন শিবিরের ছিল। ছাত্রলীগের অভিযুক্তদের প্রায় সবাই ছিলেন রণজিৎ সরকারের অনুসারী। সিলেটে ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা নামক সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া অপকর্মে আতঙ্কিত নগরবাসী।খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগসহ অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতা-কর্মী। তবে মাথার ওপর একাধিক গডফাদার থাকায় অপকর্মের পর দলীয় প্রভাবে পার পেয়ে যায় তারা। ফলে দিন দিন আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসীরা। গোটা দেশেই চলছে এই শ্রেণির অপকর্ম। ঘটনাচক্রে বরগুনা আর সিলেট নতুন করে আলোচনায়। অন্যদিকে উন্নয়নকে কেউ কেউ লুটপাটের মচ্ছবে পরিণত করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রকে ক্ষমতায় যাওয়া এবং টিকে থাকার হাতিয়ারে পরিণত করায় পাবলিক সার্ভেন্টদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ে উঠেছে চরম দুর্নীতিবাজ। সেখানে একের পর এক গজাচ্ছে এবং বেড়ে উঠছে প্রদীপ, মালেক, আবজলরা।
বর্তমানে দেশের সুশাসন, নারী অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি নিয়ে সোচ্চার থাকা চেতনার কাÐারিরা এসব নিয়ে এখন মোটামুটি চুপই বলা যায়। তারা এসব নিয়ে কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে নাকি দলকানা সুবিদাবাদীর মুখোশ উম্মোচিত হয়ে যাওয়ার ভয় করছেন, তা বোধগম্য নয়। সার্বিক বিবেচনায়, রাজনীতিতে নীতি-মূল্যবোধের অবক্ষয় সুস্থ চিন্তা চেতনায় আর কতো ধস নামাবে? এ প্রশ্ন এখন সচেতন ও বিবেকবনদের। পরিস্থিতির অনিবার্যতায় তারাও খামোশ হয়ে রয়েছে। একদিকে তাদের নীরবতা, আরেকদিকে দুর্বৃত্তদের উত্থানের ফাঁকে দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরাতে বহুল প্রচারিত হচ্ছে সরকারের উন্নয়নের ফিরিস্তি। এসব আড়াল করতে উপস্থাপন করা হচ্ছে, রাস্তা, ব্রিজ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স, গড় আয়, ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির যত তথ্য। সাধারণ মানুষের জীবনমান, নিরাপত্তা, নীতি-নৈতিকতার অবনমন যেন কোনো বিষয়ই নয়। লোভ-লালসা ও ভোগ-বিলাস, বিদ্বেষ, প্রতিহিংসা, সততা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, অধঃপতন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার অভাব দীর্ঘদিন ধরে জেঁকে বসে আছে। এসব শিকড় জন্ম দিচ্ছে নিত্যনতুন নৈতিক, মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপরাধ। এসব অপরাধ ধ্বংস করছে সততা, নীতিনৈতিকতা ও মানবতাবোধ। শাস্তি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ, আইনের শাসনের দুর্বলতা এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়িয়ে দিচ্ছে অপরাধপ্রবণতা। দুর্বল করে দিচ্ছে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধকে। সুরাজনীতিকে নির্বাসনে পাঠাচ্ছে। রাজনীতির অর্থ পাল্টে দিচ্ছে।
নৈতিকতাবোধ কেন হারিয়ে যাচ্ছে? দেশপ্রেমের কেন এই দুর্দশা? কেন গড়ে উঠছে না ন্যায়ভিত্তিক ন্যায্য সমাজ? কারণ খুঁজতে গেলে সামনে আসে সমাজব্যবস্থা ও রাজনীতির প্রশ্ন। এসব সমস্যার সমাধান করতে হলে এগুলোর শিকড় চিহ্নিত করে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। বছরের পর বছর বা যুগ যুগ ধরে পুঞ্জীভ‚ত সমস্যা বহন করে চলার পরিণতি ভয়াবহ হয়। একপেশে রাজনীতি ও রাজনীতিকদের স্বার্থবাদী নীতি চলতে থাকলে দেশ ও জাতির ভবিষ্যত অন্ধকারে নিপতিত হবে। তখন যতই উন্নয়ন করা হোক না কেন, সব অর্থহীন হয়ে পড়বে। কাজেই সময় থাকতে দেশে সুরাজনীতি, সুশাসন, আইনের শাসন এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।